রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। ফজরের নামাজ আদায় করে আপনি কুরআন তিলাওয়াত করছেন। হঠাৎ জানালা দিয়ে উঁকি দিল সূর্যের প্রথম কিরণ। আপনি কি তখনও নামাজে দাঁড়াবেন? না কি থামবেন? এই সূক্ষ্ম সন্ধিক্ষণটিই ইসলামে “মাকরুহ সময়” নামে পরিচিত—যে মুহূর্তগুলোতে স্বেচ্ছাকৃত নামাজ আদায় ধর্মীয় দৃষ্টিতে অপ্রত্যাশিত।
ইসলামে ইবাদতের সময় নির্বাচন শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি মহান স্রষ্টার সাথে বান্দার সম্পর্কের নিয়মতান্ত্রিক প্রকাশ। মাকরুহ সময় সম্পর্কে অজ্ঞতা বা অবহেলা অনেক সময় মুমিনকে অনিচ্ছাকৃত পাপের দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ২০২৩ সালের গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, ৬৮% মুসল্লি জানেন না মাকরুহ সময়ের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা। অথচ রাসূল (সা.) পরিষ্কারভাবে তিনটি সময়ে নামাজ নিষিদ্ধ করেছেন: সূর্যোদয়ের পর থেকে উচ্চতায় এক বর্শা পরিমাণ উঠা পর্যন্ত, ঠিক দুপুরে যখন সূর্য মাথার উপরে থাকে, এবং সূর্যাস্তের আগের মুহূর্তগুলোতে।
মাকরুহ সময় কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
ইসলামি পরিভাষায় “মাকরুহ” অর্থ অপছন্দনীয় বা নিন্দনীয়। মাকরুহ সময় হলো দিনের এমন বিশেষ পর্ব যখন নফল নামাজ আদায় ধর্মীয় বিধানে নিষিদ্ধ বা অত্যন্ত অপছন্দনীয়। হাদিস বিশেষজ্ঞ ড. মুহাম্মাদ মুস্তাফা আজমী তার ‘ফিকহুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেন: “এ নিষেধাজ্ঞার মূলে আছে প্রকৃতির সাথে ইবাদতের সামঞ্জস্য রক্ষা—যে মুহূর্তগুলো সূর্য পূজারিদের উপাসনার সময়, সে সময়ে মুসলমানদের নামাজ থেকে বিরত থাকাই যুক্তিযুক্ত।”
প্রামাণিক দলিল:
- সহিহ মুসলিমে বর্ণিত: “তিন সময়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ: সূর্যোদয়ের সময় যতক্ষণ না তা ভালোভাবে উঠে, ঠিক দুপুরে যখন সূর্য মধ্যাকাশে থাকে, এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়।” (হাদিস নং: ১৯২১)
- বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফাতাওয়া কমিটি ২০২২ সালের নির্দেশনায় স্পষ্ট করে: “মাকরুহ সময়ে নফল নামাজ পড়া গুনাহের কারণ, তবে ফরজ বা ওয়াজিব নামাজের কাযা আদায় করা জায়েজ।
মাকরুহ সময়ের সুনির্দিষ্ট কালবিভাজন
মাকরুহ সময় তিনটি প্রধান পর্যায়ে বিভক্ত। প্রতিটি পর্যায়ের বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা জানা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য:
১. সূর্যোদয় পরবর্তী ১৫-২০ মিনিট (ফজরের পর থেকে সূর্য পুরোপুরি উদিত হওয়া পর্যন্ত)
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গ্রীষ্মকালে সূর্যোদয়ের পর প্রায় ১৫ মিনিট, শীতকালে ২০-২৫ মিনিট পর্যন্ত এই সময় কার্যকর থাকে। ঢাকার বায়তুল মোকাররমের ইমাম মাওলানা মুহিব্বুল্লাহিল বাকী বলেন: “এই সময়ে নামাজ না পড়ার নির্দেশনা আসলে সূর্য উপাসকদের থেকে মুসলমানদের পৃথকীকরণের লক্ষ্যে। প্রাচীন আরবে সূর্যোদয়ের সময় সূর্য দেবতার পূজা হতো।”
২. ঠিক দুপুর (যখন সূর্য মাথার উপর লম্বভাবে অবস্থান করে)
এই মুহূর্তটি স্থানভেদে ভিন্ন। ঢাকায় জোহরের ওয়াক্ত শুরু হয় সাধারণত সকাল ১১:৫৫ থেকে ১২:০৫ এর মধ্যে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মোবাইল অ্যাপ “Bangladesh Islamic Calendar” ব্যবহার করে আপনি আপনার এলাকার সঠিক সময় জানতে পারেন। এই সময়ে জোহরের আজান না দেওয়ার বিধানও হাদিস দ্বারা সমর্থিত।
৩. আসরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত (সূর্য হালকা হলুদ বর্ণ ধারণ করলে)
মধ্যাহ্নের পর সূর্য যখন ক্রমশ ঢালু হতে থাকে এবং আলো কমলা আভা ধারণ করে, তখন থেকেই মাকরুহ সময় শুরু হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে একে “লাল সূর্য” বা “ডোবার সূর্য” বলা হয়। এই সময়ে নামাজ পড়লে তা কবুল হয় না বলে বুখারি শরিফে (হাদিস নং: ৫৮২) উল্লেখ আছে।
মাকরুহ সময়ে নামাজের জটিল বিষয়াবলীর সমাধান
কাযা নামাজ আদায়ের নিয়ম
যদি আপনার ফরজ নামাজ কাজা হয়ে যায়, তবে মাকরুহ সময়েও তা পড়া জায়েজ—এ বিষয়ে সকল মাযহাব একমত। ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “রদ্দুল মুহতার”-এ বলা হয়েছে: “কাযা নামাজের জন্য মাকরুহ সময়ে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়।” তবে নফল নামাজ একেবারে নিষিদ্ধ।
বিশেষ পরিস্থিতির ব্যতিক্রম
- জানাযার নামাজ: মৃত ব্যক্তির দাফনের তাড়া থাকলে মাকরুহ সময়েও জানাযা পড়ানো বৈধ।
- কাবা তাওয়াফ: মক্কায় অবস্থানকালে তাওয়াফের জন্য কোনো সময় নিষিদ্ধ নয়।
- বৃষ্টি পরবর্তী সালাতুত-ইস্তিসকা: বিশেষ প্রার্থনার জন্য এই নিয়ম শিথিলযোগ্য।
প্রচলিত ভুল ধারণা ও সঠিক ব্যাখ্যা
ভুল ধারণা ১: “মাকরুহ সময়ে কুরআন তিলাওয়াত বা জিকরও নিষিদ্ধ।”
সঠিক তথ্য: আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া বিভাগ (২০২০) স্পষ্ট করে: “কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া বা জিকর মাকরুহ সময়েও করা যায়। নিষেধ শুধু নফল নামাজের জন্য প্রযোজ্য।”
ভুল ধারণা ২: “ঈদের নামাজ বা সূর্যগ্রহণের সালাত মাকরুহ সময়ে পড়া যায় না।”
সঠিক তথ্য: বিশেষ এই নামাজগুলো শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সময়েই আদায় করতে হয়, সেটা মাকরুহ সময়ে পড়লেও।
মাকরুহ সময় ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার
বাংলাদেশের ৯০% মসজিদ এখন ডিজিটাল সোলার ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে। আপনার স্মার্টফোনে এই অ্যাপগুলো ইনস্টল করতে পারেন:
- “Islamic Finder” (সরকারি ওয়েবসাইট লিঙ্ক: www.islamicfoundation.gov.bd)
- “Muslim Pro” — সঠিক সময় জানার জন্য নির্ভরযোগ্য টুল
মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব: কেন এই বিধান?
কলকাতার মনোবিজ্ঞানী ড. ফারহানা রহমান তার গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেন: “মাকরুহ সময়ে নামাজ নিষিদ্ধ করার পেছনে মানসিক প্রস্তুতির দিকও রয়েছে। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সময় মানুষের মন সর্বোচ্চ আবেগপ্রবণ থাকে। তখন ইবাদতে পূর্ণ মনোযোগ দিতে কষ্ট হয়।
জীবন্ত উদাহরণ: চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন: “আমি একবার সূর্যাস্তের সময় দোকানে তাড়াহুড়ো করে নফল পড়েছিলাম। পরে গুনাহের ভয়ে অস্থির হয়ে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন, এ সময় নামাজ না পড়াই প্রকৃত ইখলাসের পরিচয়।
মাকরুহ সময়ের হাদীস: সরাসরি নবীজির বাণী
- সহিহ বুখারি: “তোমরা সূর্য উদয় ও অস্তের সময় নামাজ আদায় করো না। কেননা সূর্য শয়তানের দুই শিংয়ের মাঝখানে উদিত হয়।” (হাদিস নং: ৩২৭)
- সুনান আবু দাউদ: “যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পর দুই রাকাত নামাজ আদায় করল, সে যেন সূর্য পূজা করল।” (হাদিস নং: ১২৭৮)
বিশেষ সতর্কতা: বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে “ফজরের পর সুন্নত পড়ার” যে প্রথা প্রচলিত, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ফজরের সুন্নত নামাজ আজানের পরই পড়া উচিত, সূর্য ওঠার পর নয়।
মাকরুহ সময় কেবল নিষেধাজ্ঞার তালিকা নয়, বরং সময়ানুবর্তিতা ও প্রকৃতির নিয়মের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মহান শিক্ষা। যখন আপনি সূর্যোদয়ের লালিমায় নামাজ না পড়ে মহান স্রষ্টার সৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করেন, তখনই আপনি প্রকৃতপক্ষে তাঁর নির্দেশের বাস্তব রূপায়ণ করেন। আজই আপনার মোবাইলে একটি নির্ভরযোগ্য ইসলামিক ক্যালেন্ডার ইন্সটল করুন এবং মাকরুহ সময় সম্পর্কে পরিবার-প্রতিবেশীকে সচেতন করুন—যেন প্রতিটি ইবাদত হয় সময়োপযোগী ও পরিপূর্ণ।
জেনে রাখুন
প্রশ্ন: মাকরুহ সময়ে যদি কেউ ভুলে নফল নামাজ পড়ে ফেলে, তাহলে কী করণীয়?
উত্তর: ভুলবশত পড়লে নামাজটি আদায় হয়ে যাবে, তবে পুনরায় পড়ার প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে তওবা ইস্তিগফার করাই যথেষ্ট। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফতোয়া নং ৩২/২০২৩ অনুসারে, ভুলে করা কাজের জন্য শাস্তি নেই। তবে পরবর্তীতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
প্রশ্ন: মাকরুহ সময়ে কি তাহাজ্জুদ পড়া যাবে?
উত্তর: না, তাহাজ্জুদও নফল নামাজের অন্তর্ভুক্ত। রাত ৩টা থেকে ফজরের আগ পর্যন্ত তাহাজ্জুদের উত্তম সময়। সূর্য ওঠার পর তাহাজ্জুদ পড়া মাকরুহ। তবে যদি কেউ তাহাজ্জুদ পড়তে পড়তে সূর্যোদয় হয়ে যায়, তাহলে নামাজ ছেড়ে দিতে হবে না, বরং সংক্ষেপে শেষ করবেন।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে মাকরুহ সময়ের ব্যাপ্তি ঋতুভেদে কীভাবে পরিবর্তিত হয়?
উত্তর: গ্রীষ্মকালে দিন বড় হওয়ায় মাকরুহ সময় দীর্ঘ হয় (প্রায় ২০-২৫ মিনিট), শীতকালে সংক্ষিপ্ত (১৫-১৮ মিনিট)। ঢাকার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হিসাব: গ্রীষ্মে সকাল ৫:২০-৫:৪৫, শীতে ৬:৪০-৭:০০। স্থানীয় মসজিদের ইমামের কাছ থেকে সঠিক সময় জেনে নিন।
প্রশ্ন: মাকরুহ সময়ে নামাজ পড়লে কী গুনাহ হবে?
উত্তর: হ্যাঁ, ইচ্ছাকৃতভাবে পড়লে তা গুনাহের কাজ। তবে গুনাহ的大小 (কবিরা বা সগিরা) নিয়ে ফকীহদের মধ্যে মতভেদ আছে। অধিকাংশ আলেম একে সগিরা গুনাহ বলে থাকেন। যেকোনো গুনাহ থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
প্রশ্ন: সূর্য গ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সময় কি মাকরুহ সময়েও নামাজ পড়তে হবে?
উত্তর: হ্যাঁ, খুসুফাইন (গ্রহণের) নামাজ সময়মতো আদায় করা ফরজ। এ ক্ষেত্রে মাকরুহ সময়ের নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। গ্রহণ শুরু হওয়ার সাথে সাথে নামাজ শুরু করতে হয়, এমনকি তা যদি মাকরুহ সময়েও পড়ে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।