আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধই এখন প্রতিদিন আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনাম হচ্ছে। কিন্তু এসব যুদ্ধ থেকে দূরে আরব সাগরের এককোণে ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে চলছে অদ্ভুত এক কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব, যা দিল্লির কৌশলগত স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশ দুটি কোনোভাবেই একে অন্যের প্রতিপক্ষ নয়। ১ কোটি ২০ লাখ বর্গমাইলজুড়ে বিস্তৃত ভারত ১১৫ বর্গমাইলের মালদ্বীপের চেয়ে অন্তত ১১ হাজার গুণ বড়। ভারতের জনসংখ্যা যেখানে ১৪০ কোটি, সেখানে মালদ্বীপের মাত্র ৫ লাখ।
এছাড়াও মালদ্বীপ প্রায় সব ধরনের সংকটে সহায়তার জন্য তার নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ১৯৮৮ সালে শ্রীলঙ্কার ভাড়াটে সেনারা মালদ্বীপে একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। সে সময় ভারতীয় সেনারা প্যারাশুটে করে নেমে সেই অভ্যুত্থানচেষ্টা ঠেকিয়ে দেয়।
২০০৪ সালে যখন ভয়াবহ সুনামি দ্বীপদেশটিতে আঘাত হানে, তখন ভারতীয় জাহাজ এবং উদ্ধারকর্মীরা সেখানে উদ্ধার অভিযানে নেমেছিল। ২০১৪ সালে যখন মালদ্বীপের একমাত্র পানি শোধনাগার ভেঙে পড়ে, ভারত পানি ভর্তি বিমান এবং নৌবাহিনীর ট্যাঙ্কার পাঠায়।
এই ধারাবাহিক সহযোগিতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গভীরতাকেই প্রতিফলিত করে। ১৯৬৫ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর মালদ্বীপের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া প্রথম দেশগুলোর একটি ভারত। এবং দুটি দেশ তখন থেকেই একটি বহুমুখী সম্পর্ক গড়ে তুলেছে যা কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিস্তৃত।
অভিন্ন সমুদ্র সীমার প্রেক্ষিতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা বজায় রাখতে ভারতের ভূমিকা মালদ্বীপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উভয় দেশই দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) স্বাক্ষরকারী। এছাড়া ভারত মালদ্বীপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার।
ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে জাতিগত, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংযোগ কয়েক শতাব্দী থেকে চলে আসছে। দেশ দুটির মধ্যে সদ্ভাব ও ভালো বোঝাপড়া থাকুক, যে কেউ এমনটা আশা করতেই পারেন।
কিন্তু যখন ভূরাজনীতির কথা আসে, তখন সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায়। মনে হচ্ছে, মালদ্বীপ সেই চিরকেলে ‘ছোট-প্রতিবেশী সমস্যা’য় ভুগছে যা উনবিংশ শতাব্দীর মেক্সিকান নেতা পোরফিরিও দিয়াজ বিস্ময়করভাবে প্রকাশ করে গেছেন: ‘দরিদ্র মেক্সিকো- ঈশ্বর থেকে বহু দূরে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অতি কাছাকাছি!’
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু গত সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে ভারতবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে জয়লাভ করেন। দায়িত্ব নেয়ার পরপরই তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, ‘ইন্ডিয়া আউট’ শুধুমাত্র প্রচারণামূলক স্লোগান নয়। আরও বেশি কিছু।
মুইজ্জুই মালদ্বীপের প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি প্রথম সরকারি বিদেশ সফরে ভারতে যাননি। তার বদলে তিনি সফর করেন তুরস্ক। যে দেশটি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নেতৃত্বে আরও বেশি ইসলামপন্থী এবং ভারতের প্রতি ক্রমশ কম বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তুরস্কের পর ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীন সফর করেন মুইজ্জু।
সোশ্যাল মিডিয়া কূটনৈতিক উত্তেজনাকে আরও উসকে দিচ্ছে। যখন অনলাইনকর্মীদের ভারতের লাক্ষাদ্বীপের পর্যটন বিষয়ক প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন তার মধ্যে বেশ কয়েকজন মালদ্বীপকে বয়কট করার আহ্বান জানিয়ে বসেন।
প্রতিক্রিয়ায় মুইজ্জুর সরকারের তিন উপমন্ত্রী- মাহজুম মজিদ, মালশা শরিফ ও মরিয়ম শিউনা – ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ভাঁড়’ ও সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করেন। ভারতীয় সোশ্যাল-মিডিয়া ব্যবহারকারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং দ্রুতই যে শব্দ যুদ্ধ শুরু হয় এক পর্যায়ে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
যদিও মালদ্বীপের ওই মন্ত্রীদের বরখাস্ত করা হয়েছিল। তবে এটা সম্ভবত কোনো দুর্ঘটনা নয় যে তারা মুইজ্জুর চীন সফরের ঠিক আগে আগে মোদিকে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। মূলত ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মালদ্বীপকে একটি নতুন পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র খুঁজে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
চীন সফরকালে মুইজ্জু বেইজিংকে মালদ্বীপের ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন অংশীদার’ হিসেবে উল্লেখ করেন। বাণিজ্য সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে নিজের অভিপ্রায়ও স্পষ্ট করেন তিনি, যা তার মতে, ভারতের ওপর প্রবলভাবে ঝুঁকে আছে।
মুইজ্জু বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির আগে চীন ছিল মালদ্বীপের এক নম্বর বাজার এবং সেই অবস্থান ফিরে পেতে প্রচেষ্টাকে জোরদার করার জন্য চীনা নীতিনির্ধারকদের প্রতি আবেদন জানান তিনি। শুধু তাই নয়, দুই দেশের মধ্যে একটি মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তির কাজ চলছে।
চীন ও মালদ্বীপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বিস্তৃত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বে উন্নীত করেছে। পাশাপাশি মুইজ্জু চীনের গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ-এ যোগদান করেছেন।
এর ফলে মালদ্বীপে চীনের উপস্থিতি আরও বাড়বে এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বেইজিংকে ডিজিটাল ও সরাসরি নজরদারির ক্ষমতা প্রসারিত করার সুযোগ করে দেবে। এরই মধ্যে একটি চীনা গবেষণা জাহাজ জিয়াং ইয়াং হং ০৩ মালদ্বীপের জলসীমায় পৌঁছেছে।
এদিকে ভারত মালদ্বীপকে তার কৌশলগত অপশনগুলো নিয়ে সাবধানে চলার জন্য সতর্ক করেছে। বিশেষ করে চীনের ঋণের জালে আটকা পড়ার ব্যাপারে। কিন্তু ভারতের এই সতর্কবার্তা মুইজ্জুকে আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তুলেছে বলেই মনে হয়।
মালদ্বীপ এরই মধ্যে ভারতের সাথে যৌথ হাইড্রোগ্রাফিক সমীক্ষা বন্ধ করেছে এবং কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ বয়কট করেছে, যার উদ্দেশ্য ছিল ভারত, মালদ্বীপ ও ভারত মহাসাগরের অন্য দুটি দেশ মরিশাস ও শ্রীলঙ্কাকে কাছাকাছি আনা।
এখানেই শেষ নয়, গত কয়েক বছর ধরে যেসব ভারতীয় সেনা মালদ্বীপে অবস্থান করছে, তাদের বহিষ্কারে তার প্রচারাভিযানের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে চলেছেন মুইজ্জু।
আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে ৭৭ জন সেনাকে প্রত্যাহার করার জন্য ভারতকে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। মালদ্বীপের জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দেয়া দুটি ধ্রুব অ্যাডভান্সড লাইট হেলিকপ্টার এবং একটি ডর্নিয়ার বিমান পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এসব সেনা দেশটিতে অবস্থান করছে।
হেলিকপ্টারগুলো প্রধানত প্রত্যন্ত দ্বীপগুলো থেকে রোগীদের রাজধানী মালে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক জীবন বাঁচিয়েছে।
মালদ্বীপের সামরিক বাহিনী অস্ত্র ও মাদক পাচারকারীসহ সমুদ্রে সন্দেহভাজন জাহাজগুলোর ওপর নজরদারির জন্য ডর্নিয়ার ব্যবহার করে। ভারতকে এখন সেনাবাহিনীর জায়গায় ‘বেসামরিক প্রযুক্তিগত সহায়তা’ পাঠাতে হবে।
এদিকে খুব শিগগিরই তুর্কি সামরিক ড্রোন মালদ্বীপের চারপাশে সাগরে টহল দিতে যাচ্ছে। যে কাজটি এতদিন ভারত মালদ্বীপ ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (এমএনডিএফ)-এর সহযোগিতায় পরিচালনা করে আসছিল।
তুরস্ক সফরকালে মুইজ্জু সামরিক ড্রোন কেনার জন্য ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এরদোগানের মতো মুইজ্জুও মালদ্বীপকে ইসলামের পথে নিয়ে যেতে চান। মালদ্বীপের জিহাদিরা ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধ করার জন্য ইসলামিক স্টেটে যোগ দিয়েছে।
তবে পরিস্থিতি এমনভাবে চলতে থাকলে, ভারতকে এমন এক চীনপন্থি দেশের (মালদ্বীপ) প্রতিবেশি হয়েই থাকতে হবে, যে দেশ ইসলামি কট্টরপন্থাকে লালন করে; যা ভারতের কৌশলগত স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।