রঞ্জন বসু : পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র বিরোধিতাতেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তি আটকে আছে, এ কথা সুবিদিত। তার সরকারের সম্মতি ছাড়া ভারত যেন তিস্তা বা গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও সমঝোতা না-করে, অতি সম্প্রতিও সেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
অথচ সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই চাইছেন উত্তরের প্রতিবেশী ভুটানের সঙ্গে ভারত যেন নদীগুলোর পানির ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমঝোতা করে এবং দু’দেশের মধ্যে ‘বাংলাদেশের আদলে’ একটি যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়।
শুধু মৌখিকভাবেই নয়, গত শনিবার (২৭ জুলাই) দিল্লিতে নীতি আয়োগের একটি বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে এই প্রস্তাবের কথা তার ভাষণে উল্লেখও করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যা রীতি অনুযায়ী নথিভুক্ত করা হয়েছে। এরপর সোমবার (২৯ জুলাই) পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার অধিবেশনেও তিনি ভারত-ভুটান যৌথ নদী কমিশন গঠনের জন্য আবারও জোরালো সওয়াল করেছেন। এর আগে গত সপ্তাহে এই মর্মে বিধানসভায় একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে।
ভুটানের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে এবং হিমালয়ের কোলে ওই পার্বত্য দেশটি থেকে অন্তত ৪৫টি ছোট-বড় নদী বা জলধারা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনটি নদী হলো–তোর্সা, রায়ডাক ও সঙ্কোশ।
এছাড়া রাজ্যের আলিপুরদুয়ার জেলায় পানা ও বাসরা এবং জলপাইগুড়ি জেরায় ডায়না ও রেতি-সুকৃতি নামে আরও মোট চারটি নদীও ভুটান থেকে এসেছে, সেগুলোকেও আকারে যথেষ্টই বড় নদী বলে ধরা হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ভুটানে বৃষ্টি হলেই এই নদীগুলো হঠাৎ করে ফুলেফেঁপে ওঠে এবং ভাটিতে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলোকে বন্যায় ভাসিয়ে দেয়। প্লাবিত হয় উত্তরের বিস্তীর্ণ বনভূমি ও চা-বাগান অঞ্চল। এসব নদীতে ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা আকস্মিক বন্যাও (স্থানীয় ভাষায় ‘হড়কা বান’) প্রায়শই ঘটে থাকে, যাতে অনেক সময় জীবন ও সম্পত্তির প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বন্যায় জমির ভাঙনও খুব সাধারণ ঘটনা, নদীর দুপারে প্রচুর জমিজায়গা প্রতি বছরই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
এই সমস্যার প্রতিকারেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার চাইছে, ভারত ও ভুটানের মধ্যে একটি যৌথ নদী কমিশন কাজ করুক–যাতে ভুটানের নদীগুলোতে আচমকা পানি বাড়লেও তা মোকাবিলায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ভুটানে নদীর বাড়তি পানিকে কীভাবে ‘ম্যানেজ’ (ব্যবস্থাপনা) করা যেতে পারে, পশ্চিমবঙ্গকে কীভাবে আগাম সতর্কতা দিয়ে হুঁশিয়ার করে দেওয়া যায় – এই কমিশন সেই লক্ষ্যে কাজ করতে পারবে বলে পশ্চিমবঙ্গ মনে করছে এবং সেই জন্যই তারা দিল্লিকে এ ব্যাপারে নানাভাবে চাপ দিতে শুরু করেছে।
সোমবার (২৯ জুলাই) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বলেন, ‘আমাদের রাজ্যটা হলো নৌকার মতো। হিমালয়ের সব নদীগুলো দিয়ে জল এসে এখানে জমা হয়, আর আমাদের বন্যায় ভুগতে হয়। এই জন্যই আমি ভারত-ভুটান যৌথ নদী কমিশন চাইছি। বিধানসভা থেকে একটি কমিটি এটা নিয়ে দরবার করতে কেন্দ্রের কাছে যাবে, আমাদের এমপি-রাও পার্লামেন্টে বিষয়টা তুলবেন।’
মমতা বলেছেন, ‘ভুটান যখন পানি ছাড়ে, তখন ওরা কেন্দ্রকে জানায় – কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ কিছু জানতে পারে না। আমাদের অরণ্য, চা-বাগান সব ভেসে যায়। এই জন্যই আমি নীতি আয়োগের বৈঠকে বলে এসেছি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যেমন যৌথ নদী কমিশন আছে, ঠিক সেই আদলেই ভারত ও ভুটানের মধ্যেও যৌথ নদী কমিশন গঠন করা দরকার!’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের এই ‘দুর্দশা’ নিয়ে যে ধরনের মন্তব্য করছেন, তিস্তা নিয়েও ভাটির দেশ বাংলাদেশ কিন্তু ঠিক একই ধরনের অভিযোগ করে থাকে। বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় নীলফামারী বা রংপুর জেলায় তিস্তাপারের বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ হলো – বর্ষায় প্রলয়ংকরী তিস্তা দুকূল ভাসিয়ে দেয়, অথচ শুষ্ক মৌসুমে যখন পানির জন্য হাহাকার তখন ভারত থেকে এক ফোঁটাও পানি পাওয়া যায় না!
ঠিক এই কারণেই দিল্লিতে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা এদিন বলেন, ‘ভুটানের জন্য পশ্চিমবঙ্গকে যদি সমস্যায় পড়তে হয় এবং মুখ্যমন্ত্রী সে জন্য বিচলিত বোধ করেন, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বাংলাদেশকেও যে একই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে এটা কেন তিনি এতদিনেও বুঝলেন না কে জানে!’
পশ্চিমবঙ্গের একজন বিখ্যাত নদী বিশেষজ্ঞও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ভারত ও ভুটানের মধ্যে যৌথ নদী কমিশন এবং পানির ব্যবস্থাপনা নিয়ে অ্যারেঞ্জমেন্ট থাকলে যে ভালো হয়, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই অবস্থানে একটা পরিষ্কার দ্বিচারিতা (‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’) আছে, কারণ তিনি মানতে চাইছেন না বাংলাদেশের সঙ্গেও আমাদের একই ধরনের অ্যারেঞ্জমেন্ট দরকার!’
ভারতের একাধিক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, তিস্তা প্রকল্প রূপায়ণ ও গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতোমধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে যথেষ্ট বিপাকে ফেলেছেন, এখন ভুটান নিয়ে তার এই নতুন অবস্থান দক্ষিণ এশিয়াতে দিল্লির ‘হাইড্রো-ডিপ্লোমেসি’ বা জল-কূটনীতিকে আরও গভীর সংকটে ফেলে দিতে পারে। কারণ ভুটানের সঙ্গে ভারত অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে কোনও সমঝোতায় গেলে একই ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশের সঙ্গেও কেন নয়, তখন সেই প্রশ্ন উঠবে অবধারিতভাবে। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।