জুমবাংলা ডেস্ক : আমের রাজধানী খ্যাত রাজশাহীর শহর কিংবা গ্রাম সবখানেই এখন আম, আম আর আম। নানা কারণে এ বছর আমের ফলন কমলেও বেড়েছে দাম। গত ৩/৪ বছরের তুলনায় এবার আমের দাম প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে রাজশাহীর আমচাষিদের মুখে হাসি ফুটেছে। আমের রাজধানী খ্যাত রাজশাহীতে চলতি মৌসুমে ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আমচাষ হয়েছে। এসব বাগানে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৬ মেট্রিকটন আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই আম বিক্রির পর রাজশাহীর অর্থনীতিতে ৯০০ কোটি টাকা যোগ হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ।
চলতি মৌসুমে রাজশাহী থেকে শুধু সরকারিভাবেই প্রায় ৩ কোটি টাকার আম রপ্তানির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন কৃষি দপ্তর। আর এ লক্ষ্যে শুধু রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ২২০ চাষি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এসব চাষিরা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৩০০ মেট্রিক টন আম রপ্তানির জন্য উপযোগী করে চাষও করেছেন।
তবে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে রপ্তানিকারকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হননি এমন একজন চাষির যিনি ইতোমধ্যে ৫০০ কেজি গোপালভোগ আম সুইডেনে পাঠানোর লক্ষ্যে রপ্তানিকারকের কাছে পাঠিয়েছেন। এই আম চাষির নাম আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি রাজশাহী এগ্রো ফুড সোসাইটির সভাপতি। রাজশাহী নগরীর জিন্নানগর এলাকায় বসবাসরত আনোয়ারুল ইসলামের আমবাগান থেকে প্রতিবছরই ফ্রুট ব্যাগিং করা আম বিদেশে পাঠিয়ে থাকেন। কিন্তু সরকারিভাবে বাঘা ছাড়া অন্য কোন স্থানের চাষিদের চুক্তিবদ্ধ না করানোর কারণে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
এদিকে, শনিবার (১৮ জুন) রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের বাজার পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরে গিয়ে দেখা যায়, এ হাটটি আম বেচাকেনায় এখন পুরোদমে জমজমাট হয়ে উঠেছে। সকাল থেকেই এখানে আসছে নানা জাতের আম। তবে গোপালভোগ আম শেষের দিকে।
বর্তমানে ক্ষিরসাপাত (হিমসাগর), লক্ষ্মণভোগ ও ল্যাংড়ার দখলে রয়েছে আমের বাজার। আসছে আমের রাজা ফজলি ও আম্রপালিও। সর্ববৃহৎ এ হাটে এখন ক্ষিরসাপাত ও গোপালভোগ আম পাইকারি বিক্রি হচ্ছে প্রতিমণ ২ হাজার ৯০০ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় এবং ল্যাংড়া আম ২ হাজার ২০০ টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা। এছাড়া জাত ভেদে আঁটি জাতের আম ও লক্ষ্মণণভোগ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকার মধ্যে।
এ বিষয়ে বানেশ্বর হাটের ইজারদার ওসমান আলী বলেন, ফলন কম হওয়ায় এ বছর আমের দাম তুলনামূলক বেশি। তবে বেশি দামে ক্রেতারা অসন্তুষ্ট হলেও বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা খুশি। এটি রাজশাহীর জেলার মধ্যে সর্ববৃহৎ আমের মোকাম হওয়ায় প্রায় সব উপজেলা থেকেই বিক্রি করতে এখানে আনেন ব্যবসায়ীরা। এজন্য উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে পুলিশ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বাজার কমিটিও আম পরিবহন ও কেনাবেচা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে।
অভিযোগ তুলে রাজশাহী এগ্রো ফুড সোসাইটির এই সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, কৃষি বিভাগ শুধু বাঘা উপজেলার চাষিদের কন্টাক্ট ফার্মিংয়ের আওতায় আনে। কিন্তু আম তো বাঘা ছাড়াও রাজশাহী মহানগরীসহ অন্যান্য উপজেলাতেও চাষ হয়। এমনকি পুঠিয়া ও পবা উপজেলা থেকেও আম রপ্তানি হয়। অথচ অন্যস্থানের চাষিরা এ সুযোগ থেকে সবসময়ই বঞ্চিত।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের কাছে বাঘার চাষিদের পুরনো একটি তালিকা রয়েছে, যে তালিকার চাষিরাই শুধু কন্টাক্ট ফার্মিংয়ের আওতায় আসে। প্রতি বছর ওই তালিকা তৈরির সময় কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্টরা অন্যদেরকে অবগত পর্যন্ত করেন না। তাই নিজেদের মত করেই আমরা বিদেশে আম পাঠাই।
আনোয়ারুল আরও জানান, এনজেল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এন হোসেন সজলের মাধ্যমে তিনি সুইডেনে আম পাঠাচ্ছেন। আনোয়ারুল দাবি করে বলেন, আমার ব্যাগিং করা আম খুবই ফ্রেশ। আমের কাছে কীটনাশক তো দূরের কথা; একটা পিঁপড়াও যেতে পারে না।
এদিকে আনোয়ারুলের বাগানের আম রপ্তানির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের কাছে তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, বাঘা উপজেলার প্রায় ২২০ জন চাষি ৩০০ মেট্রিক টন আম দেবেন বলে হটেক্স ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে রপ্তানিকারকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। আমাদের অধিদপ্তরের তালিকার বাইরে থাকা এসব চাষি ও রপ্তানিকারকদের উদ্যোগে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোন সহযোগিতা করার সুযোগ নেই।
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শফিউল্লাহ সুলতান রবিবার (১৯ জুন) দুপুরে প্রতিদিনের সংবাদকে জনান, আমাদের কাছে থাকা তালিকাভুক্ত চুক্তিবদ্ধ চাষিদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের বাগানের সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা শেখানো হয়। ব্যাগিং পদ্ধতিতে ফ্রেশ আম উৎপাদনের বিষয়টিও তাদের শেখানো হয়। আর এখন পর্যন্ত বাঘা উপজেলা থেকে প্রায় ৬ মেট্রিকটন আম বাইরে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বাঘা উপজেলার রপ্তানিতে তালিকাভুক্ত আমচাষি শফিকুল ইসলাম সানা জানান, গত কয়েকবছর ধরেই তিনি রপ্তানিকারকের মাধ্যমে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে আম পাঠাচ্ছেন। এবারও ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে রপ্তানি উপযোগী করে আম চাষ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা রপ্তানি উপযোগী বেশি আম উৎপাদন করতে পারলেও সম্পূর্নটা রপ্তানিতে যোগ হয়না। তবে এবার অন্য বছরের চেয়ে আমাদের আমের চাহিদা বেশি থাকায় আগের চেয়ে রপ্তানির পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, চুক্তিবদ্ধ চাষিরা লক্ষণভোগ বা লখনা, হিমসাগর বা ক্ষিরসাপাত এবং ল্যাংড়া আম বিদেশে রপ্তানির উপযোগী করে উৎপাদন করেন। জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ মে থেকে লক্ষণভোগ বা লখনা ও হিমসাগর ২৮ মে থেকে নামানো শুরু হয়েছে। আর ৬ জুন থেকে নামানো হচ্ছে ল্যাংড়া এবং ১৫ জুন থেকে শুরু হয়েছে আম্রপালি ও ফজলি আম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব মতে চলতি মৌসুমে রাজশাহী থেকে শুধুমাত্র চুক্তিবদ্ধ ২২০ চাষির ৩০০ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করা গেলেই প্রায় তিন কোটি টাকা এসব চাষিদের পকেটে ঢুকবে।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্র আরও বলছেন, রাজশাহীতে এ বছর ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আমচাষ হয়েছে। এসব বাগানে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৬ মেট্রিকটন আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই আম নিয়ে রাজশাহীর অর্থনীতিতে যোগ হতে পারে ৯০০ কোটি টাকা। আর রাজশাহী জেলা প্রশাসকের বেঁধে দেয়া সম্ভাব্য সময় অনুযায়ী আম চাষী ও বাগান ব্যবসায়ীরা আগামী ১০ জুলাই বারি-৪ ও আশ্বিনা, ১৫ জুলাই গোলমতী, ২০ আগস্ট ইলমতি আম নামাতে পারবেন। এর আগে গত ১৩ মে থেকে রাজশাহী জেলা প্রশাসনের বেধে দেওয়া সময় অনুসারে জাত ভেদে আম নামানো শুরু হয়। রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) উত্তম কুমার কবিরাজ বলেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকদের আম ঢাকায় সেন্ট্রাল প্যাকেজিং হাউজে নিতে হয়। সেখানে আমের মান যাচাই করে গুণগত প্যাকেটিং হয়, যাতে আম বেশি সময় ভাল থাকে। তারপরই তা রপ্তানির জন্য ছাড়পত্র পায়।
তিনি বলেন, গতবছর চাষিরা রপ্তানি করা আমে কেজি প্রতি দাম পেয়েছিলেন ৯০ টাকা। এবার ফলন একটু কম বলে দাম বেশি পাবেন। যে দামের পরিমাণ ও আয়কৃত অর্থের সঠিক তথ্য মৌসুমের বাজারজাত শেষে জানা যাবে। তবে সব চাষির আম যদি রপ্তানি না-ও হয়, সেক্ষেত্রেও তারা ভাল দাম পাবেন। কারণ, ব্যাগিং করা ফ্রেশ আমের দাম এমনিতেই বেশি হয়। তবে এবার কোভিডের সংক্রমণ না থাকায় বেশি পরিমাণে আম রপ্তানি করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
শুধু বাঘা উপজেলার আম চাষিদেরকে রপ্তানীতে যুক্ত করার বিষয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন রবিবার বিকেলে প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, বাঘা ছাড়া অন্য উপজেলার আমচাষিরাও যদি রপ্তানীযোগ্য আম উৎপাদন করতে পারে তাহলে তাদেরকেও রপ্তানিকারকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করানো হবে। তবে তিনি একটি কর্মশালায় রয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, এ মুহুর্তে এর বেশি বলা সম্ভব নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।