বিনোদন ডেস্ক : জন্মনাম আশরাফুল আলম সাঈদ। ছিপ ছিপে গড়নের এই মানুষটি দেশব্যাপী পরিচিত হিরো আলম নামে। এ নাম তার নিজের দেওয়া। কোনো পরিচালক বা প্রযোজক দেননি। বলার মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই স্বঘোষিত এই হিরোর। অভাব অনাটনের কারণে অল্প বয়সে ধরেন পরিবারের হাল।
বগুড়ার ছেলে হিরো আলম একসময় বিক্রি করতেন সিডি। সেটির দিন যখন শেষ, তখন আসেন ক্যাবল নেটওয়ার্কের ব্যবসায়। একটু পয়সার মুখ দেখতেই তার হিরো হওয়ার শখ জাগে। নিজ খরচে বানাতে থাকেন অসংখ্য মিউজিক ভিডিও। সেগুলো ছড়াতে থাকেন ফেসবুক এবং ইউটিউবে। তাতেই রাতারাতি ভাইরাল হিরো আলম।
স্বঘোষিত এই হিরোকে এখন এক নামে চেনে সারাদেশের মানুষ। তাকে নিয়ে হয় নানা মহলে আলোচনা, সমালোচনা। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে নাম জড়িয়েছে তার। সেই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি চিত্রনায়িকা পরীমনি, মডেল পিয়াসা, মৌ এবং সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে নিয়ে বিকৃত গান গেয়ে বিতর্কে জড়ান হিরো আলম।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে উঠেছে রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত এবং লোকসংগীতকে বিকৃত করে গাওয়ার অভিযোগ। এ ঘটনার জেরে হিরো আলমকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন এক আইনজীবী। পাশাপাশি এক সাংবাদিকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে তা ফেরত না দেওয়ার অভিযোগেও মামলা খেয়েছেন তিনি।
হিরো আলম ছাড়েননি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও চিত্রনায়ক জায়েদ খানকেও। এ দুজনের ব্যক্তিগত রেষারেষি নিয়ে একসময় সরগরম ছিল চলচ্চিত্রপাড়া। এছাড়া মনি চৌধুরী নামে এক সংগীতশিল্পীকে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগও আছে তার নামে। মোটকথা, হিরো আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই।
আলমের বিরুদ্ধে ভুরি ভুরি সেই অভিযোগের একটি হলো, আকাশ নিবিড় নামে এক বিনোদন সাংবাদিকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত না দেওয়া। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করা হয় আকাশের সঙ্গে। তিনি ঢাকা দাবি করেন, ‘হিরো আলমকে দেড় লাখ টাকা ধার দিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ পর দেওয়ার কথা ছিল, দেয়নি।’
আকাশ জানান, ‘পরে আমি হাতিরঝিল থানায় জিডি করি। পুলিশ হিরো আলমকে ডাকলে সে সবকিছু অস্বীকার করে। একপর্যায়ে আমাদের হাতাহাতি হয়। আলম আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এক মাস সময় নেয় টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেয়নি। এরপর আমি হাতিরঝিল থানায় মামলা করি। পরে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে একটি সিআর মামলাও করি।’
হিরো আলমকে প্রতারক আখ্যা দিয়ে আকাশ নিবিড় বলেন, ‘ও বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়। পরে চাইতে গেলে অস্বীকার করে, প্রমাণ চায়, নানাভাবে মামলা-হামলার হুমকি দেয়। ওর প্রতারণার শিকার অনেকে। কিন্তু তারা মিডিয়ার সামনে আসতে চায় না। ও অভিনেতা চিকন আলীর একটা ব্যক্তিগত ভিডিও নিয়ে তাকেও ব্ল্যাকমেইল করেছে।’
আকাশ নিবিড় আদালতে হিরো আলমের নামে মামলাটি করেছেন অ্যাডভোকেট শেখ শামিনুর রহমান সানির সহযোগিতায়। বিষয়টি জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভিডিও কনটেন্ট বানানোর নামে আকাশ নিবিরের কাছ থেকে টাকা ধার নেন হিরো আলম। পরে ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। উল্টো হত্যার হুমকি দেন।’
পরে আকাশ নিবিড় মুখ্য হাকিম আদালতে মামলা করেন বলে জানান শামিনুর রহমান। তিনি বলেন, ‘মামলাটি তদন্তের জন্য হাতিরঝিল থানাকে আদেশ দেন আদালত। গত ২৭ জুলাই আদালতে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশ তা দেয়নি।’
এ ব্যাপারে হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রশিদ বলেন, ‘অর্থ জালিয়াতি ও ফোনে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে হিরো আলমের নামে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের একটি সিআর মামলা তদন্তের জন্য এসেছে। সেটি এসআই সুজা নূরের কাছে হস্তান্তর করেছি। তিনি সবার সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।’
এদিকে, প্রথমবার মা হতে যাওয়া চিত্রনায়িকা পরীমনিকে জড়িয়ে হিরো আলমের বিকৃত গান প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হয় তার স্বামী অভিনেতা শরীফুল রাজের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ নেই, কিছু বলারও নেই। হিরো আলমকে আমরা সেভাবে চিনি না। ও যা করেছে তার জন্য আইন আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। তারা যা করার করেছে।’
মডেল পিয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমিসহ বেশ কিছু মডেলদের নিয়ে হিরো আলম অপমান ও কটাক্ষ করে গান গেয়েছে। এ ধরনের কাজ সে করতে পারে না। আমরা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে অভিযোগ দিয়েছি। পরে ডিবি থেকে তাকে ডাকলে সে ভুল স্বীকার করে এবং এমন কাজ আর করবে না বলে মুচলেকা দেয়।’
কিন্তু যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই হিরো আলমের বক্তব্য কী? যোগাযোগ করা হয় তার সঙ্গে। টাকা ধার নিয়ে ফিরিয়ে না দেওয়া, উল্টো প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হিরো আলম বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই না। আকাশ নিবির কী করবে করুক। ওর দৌঁড় কতদূর দেখি। ওকে নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। সবকিছুর জবাব আদালতে দেব।’
মডেলদের নিয়ে আপত্তিকর গান গাওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করলে হিরো আলম বলেন, ‘পিয়াসা ও মৌ ডিবিতে অভিযোগ করেছে। তাদের নিয়ে ‘রাতের রানি’ শিরোনামে একটি গান গেয়েছি। পিয়াসা, মৌ আর ডা. মুরাদকে নিয়ে তো অনেকেই অনেক কিছু বলেছে। তাদের নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। আমাকে নিয়ে তারা অভিযোগ করেছে। কেন করেছে জানি না।’
স্বঘোষিত এই হিরোর অতীত ঘেটে জানা গেছে, অভাবের কারণে আলমের পরিবার ছোটবেলায় তাকে একই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের হাতে তুলে দেয়। আব্দুর রাজ্জাক তাকে নিজের ছেলের মতো আদর, স্নেহে বড় করেন। তবে অভাব একসময় হানা দেয় সেই সংসারেও। বাধ্য হয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া আলমকে নামতে হয় জীবিকার সন্ধানে।
প্রথমে সিডি বিক্রি এবং পরে ডিশ ব্যবসা করে সফলতার মুখ দেখেন হিরো আলম। এ ব্যবসা থেকে তার মাসে আয় ৭০-৮০ হাজার টাকা। বর্তমানে হিরো আলমের ঠিকানা রাজধানীর মালিবাগ। সেখানে স্ত্রী সুমী এবং দুই সন্তান আবির ও আলোকে নিয়ে থাকেন। ২০০৯ সালে বিয়ে হয় হিরো আলম ও সুমীর। বগুড়ায় তাদের বাড়ি পাশাপাশি গ্রামে।
তবে শুধু সুমী নন, হিরো আলমের আরও একজন স্ত্রী আছেন। নাম নুসরাত। পেশায় মডেল। হিরো আলমের সঙ্গে তিনি বেশ কিছু মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করেছেন। সেখান থেকে ভালো লাগা, প্রেম, তারপর বিয়ে। হিরো আলমের এই দ্বিতীয় স্ত্রী অন্য বাসায় থাকেন। মাঝে তাদের ডিভোর্সের গুঞ্জন উঠেছিল। তবে এখন সবকিছু ঠিক আছে বলে জানান হিরো আলম।
ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে ব্যাপক পরিচিতি পাওয়া হিরো আলম শুধু মিউজিক ভিডিও করেই থেমে থাকেননি। দুটি সিনেমাতেও তিনি অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে আবার একটি সিনেমা প্রযোজনা করেছেন। বর্তমানে মুক্তির অপেক্ষায় আছে তার তিনটি সিনেমা। কাজ শুরু হবে আরও দুটির। দেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও বেশ পরিচিত মুখ এই ভাইরাল তারকা।
হিরো আলমকে নিয়ে আরেকটি আলোচনা না করলেই নয়। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বগুড়া-৪ আসন থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রথমে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। না পেয়ে সতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। কিন্তু এমপি হওয়ার খায়েশ তার পূরণ হয়নি। নির্বাচনে হেরে যান বিপুল ভোটে। সঙ্গে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও হন।
এসবের কিছুই দমাতে পারেনি স্বঘোষিত হিরোকে। তিনি ছুটে চলেছেন আপন গতিতে। তবে হিরো আলম যে শুধু নিন্দিত, তা কিন্তু নয়। নানা কারণে তিনি অনেকের কাছে নন্দিতও। বগুড়ায় নিজ এলাকার বন্যা কবলিত বহু মানুষকে তিনি একাধিক বার খাদ্যসামগ্রী দিয়েছেন। নগদ অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। সে সব ছবি এবং ভিডিও ইন্টারনেটে সার্চ করলেই মিলবে।
এছাড়া করোনায় বহু মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন হিরো আলম। শিল্পী সমিতি থেকে সদস্যপদ হারানো দেড় শতাধিক শিল্পীর ভোটাধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলনও করেছেন। তাই অন্যদের নিয়ে গাওয়ার মতো হিরো আলম বিখ্যাত শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর এই গানটাও গাইতে পারেন, ‘কে বলে আমি ভালো না, আমি তো মানুষ, থাকবে কিছু দোষ। আমাকে মন্দ বলো না।’
সূত্র : ঢাকা টাইমস
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।