ধর্ম ডেস্ক : ‘আত্মা’ ও ‘শুদ্ধি’ শব্দ দুটির সমন্বয়ে গঠিত ‘আত্মশুদ্ধি’ শব্দটি। মানবজীবনে আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যধিক। মানুষের চরিত্র মাধুর্যের মূল ভিত্তি হলো আত্মশুদ্ধি। আত্ম অর্থ নিজ, শুদ্ধি পবিত্রকরণ। সুতরাং আত্মশুদ্ধি অর্থ নিজের নফস বা জীবাত্মাকে পরিশুদ্ধ করা। আত্মশুদ্ধির মর্ম হচ্ছে নিজের নফসকে ষড়রিপুর বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা। মানুষ জীবাত্মার কারণেই নানা পাপে জড়িয়ে পড়ে।
জীবাত্মাকে বেষ্টন করে রাখে ষড়রিপু হচ্ছে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। কামের কারণে মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয় এবং অন্যায় পথে সম্ভোগেচ্ছা চরিতার্থ করে থাকে। ক্রোধের প্রভাবে মানুষ দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও রক্তপাত ঘটায়। লোভের প্রভাবে দুর্নীতি ও অন্যায় পথে সম্পদের মালিক হওয়ার চেষ্টা করে।
মোহের ফলে পৃথিবীর মায়ায় মানুষ এমনভাবে ডুবে যায় যে নিজের স্রষ্টাকে ভুলে যায়। মদ রিপুর কারণে মানুষ অশ্লীল আনন্দ-স্ফুর্তিতে মেতে ওঠে। মাৎসর্যের প্রভাবে ঈর্ষা, হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা প্রবৃত্তি সৃষ্টি হয়। ষড়রিপু হলো আত্মার রোগ। ষড়রিপুতে আক্রান্ত ব্যক্তি আল্লাহর বান্দা বলে দাবি করলেও চরিত্রের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সে পাপাচারী।
সুতরাং এরূপ ব্যক্তি বাহ্যিক সুরতে মানুষ হলেও আত্মার বিচারে সে নিকৃষ্ট জীবতুল্য।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য এমন অনেক জিন ও মানুষ। যাদের ক্লালব বা অন্তর আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে তারা বোঝে না; তাদের চোখ আছে, তা দিয়ে তারা দেখে না এবং তাদের কান আছে কিন্তু তা দিয়ে শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতোই এবং তার চেয়ে নিকৃষ্টতম। তারাই গাফেল উদাসীন (সুরা আল আ’রাফ ৭ : আয়াত ১৭৯)।’
ষড়রিপু প্রভাবিত ব্যক্তি ইবাদত-বন্দেগি করলেও তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না, সে জীবনভর ইবাদত করেও প্রভুর সন্ধান পাবে না। বর্তমান সমাজের অধিকাংশ মানুষ ষড়রিপুতে মত্ত হওয়ায় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের পরিবর্তে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
আল্লাহ নির্দেশিত পথকে উপেক্ষা করে নিজের মন গড়া মতবাদ সৃষ্টি করায় ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে অশান্তি বিরাজ করছে। সমাজে শান্তির পরিবর্তে আত্মকলহ, সংঘাত ও পারস্পরিক হানাহানি সৃষ্টি হচ্ছে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি তারা আল্লাহ দীনের পরিবর্তে অন্য দীন অন্বেষণ করে। অথচ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে আসমান ও জমিনে যা কিছু স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে (সুরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ৮৩)।’
মহান আল্লাহ অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘আর যখন ফিরে যায়, তখন সে চেষ্টা করে যেন পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং শস্যক্ষেত ও জীবজন্তুর বংশ বিনাশ করতে পারে। আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না (সুরা আল বাকারাহ ২ : আয়াত ২০৫)।’
মূলত ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মশুদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। একজন আত্মশুদ্ধি লাভকারী ব্যক্তিই সফল ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে আত্মশুদ্ধি লাভ করে (সুরা আল আ’লা ৮৭ : আয়াত ১৪)।’
আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে সেই ব্যক্তি, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর ব্যর্থ হয়েছে সেই ব্যক্তি, যে নিজেকে পাপাচারে কলুষিত করেছে (সুরা আল শামস ৯১ : আয়াত ৯ ও ১০)।’
হজরত মুহাম্মদ (সা.) আরব জাতিকে আত্মশুদ্ধির সুমহান শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি যে যুগে এসেছিলেন, সেই যুগকে বলা হতো ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বা অন্ধকার অজ্ঞতার যুগ। অজ্ঞতার যুগের বর্বর মানুষেরা রসুল (সা.)-এর সহবতে গিয়ে তাঁর সুমহান শিক্ষা, আদর্শ গ্রহণের মাধ্যমে আদর্শ চরিত্রবান হতে সক্ষম হন। চরিত্রবান হওয়ার জন্য নিজের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করতে হয়।
রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন মানুষের ক্লালব (হৃদয়) ভালো অর্থাৎ পরিশুদ্ধ হয়ে যায়, তখন তার গোটা শরীর পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর যখন মানুষের ক্লাবব খারাপ তথা দুষ্কর্মময় হয়ে পড়ে, তখন পুরো মানুষটিই খারাপ হয়ে যায় (তাফসিরে মিজান ১৫নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৮)।’
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি কোনো কাজে আসবে না, সেদিন উপকৃত হবে কেবল সে, যে আল্লাহর কাছে আসবে ক্লালবে সালিম তথা বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে (সুরা আশ শু’আরা ২৬ : আয়াত ৮৮ ও ৮৯)।’
পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। তাই আল্লাহর তত্ত্বের জ্ঞানী হক্কানি ওলামায়ে কেরামের সান্নিধ্যে গিয়ে সঠিকভাবে ইবাদত বন্দেগি ও কুরিপুসমূহ তথা জীবপ্রবৃত্তি দূর করতে পারলে আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব হবে।
লেখক : ড. মুহাম্মদ নাছিরউদ্দীন সোহেল
Get the latest News first— Follow us on Zoombangla Google News, Zoombangla X(Twitter) , Zoombangla Facebook, Zoombangla Telegram and subscribe to our Zoombangla Youtube Channel.