লাইফস্টাইল ডেস্ক : টমেটো, ক্যাপসিকাম, কাঁচামরিচ ও স্ট্রবেরি। গাছগুলো বেশ পরিপক্ব; কদিন পরই ফল ধরবে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো কোনো গাছের মূলেই মাটি নেই। মাটি ছাড়া কেবল নারিকেলের ছোবড়া আর পানিতে জন্মাচ্ছে গাছগুলো। এ পদ্ধতির নাম হাইড্রোপনিক।
হাইড্রোপনিক বর্তমান সময়ের অত্যাধুনিক কৃষি চাষ পদ্ধতি। জৈব চাষের বর্তমান রমরমা সময়ে মাটি ছাড়াই যা হয়ে উঠছে ভবিষ্যতের দিশারী। অতি লাভজনক ফসলের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানি এবং নারিকেলের ছোবড়ার মাধ্যমে গাছের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করে ফসল ফলানো যায়। এ পদ্ধতিতে চাষ শুরু হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে। তাতে সাফল্যও এসেছে।
ইন্সটিটিউটের চাষকৃত ক্যাপসিকাম আর স্ট্রবেরির পর মরিচ আর টমেটো গাছও বেশ বড় হয়েছে। প্রতিবছর দেশের জনসংখ্যা, বসতি, রাস্তাঘাট ও কলকারখানা ব্যাপক হারে বাড়ছে। ফলে দিন দিন কমছে আবাদযোগ্য জমি। এ অবস্থায় হাইড্রোপনিক চাষ পদ্ধতিতে বাড়ির ছাদে, আঙিনায়, বারান্দায় কিংবা চাষের অযোগ্য পতিত জমিতে সহজেই চাষাবাদ করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি গাজীপুরের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ঘুরে দেখা যায়, জালে ঘেরা ও গ্রিন হাউজ দেওয়া জায়গায় দুটি লোহার কাঠামো করা টেবিলে পাশাপাশি মাটি ছাড়া চাষাবাদ চলছে। এক সারিতে পানির লম্বা পাত্রের ওপর ককশিট দিয়ে ভাসমান অবস্থায় বিভিন্ন গাছের চারা এবং বড় গাছ রাখা হয়েছে। স্বচ্ছ পানির মধ্যে গাছগুলোর মূল দেখা যাচ্ছে। একটি পানির পাম্প দিয়ে দিনে দুবার মাটির বিভিন্ন উপাদানমিশ্রিত পানি আদানপ্রদান (রিসাইকেল) করা হয়। অন্যদিকে আরেকটি সারিতে মাটির পরিবর্তে নারকেলের ছোবড়ার মধ্যে একই ধরনের সবজি চাষ করা হয়। নারকেলের ছোবড়ার সারিটির প্রতিটি গাছের পাশে পাম্প দিয়ে মাটির উপাদানমিশ্রিত পানি দেওয়া হয়।
ইনস্টিটিউটে জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষ করতে মাটির বিভিন্ন উপাদান খনিজ, জৈব ইত্যাদি পানিতে মিশিয়ে তা পাত্রে রাখা হয়। এরপর সেখানে গাছের চারা পুঁতে দেওয়া হয়। ককশিট দিয়ে আটকানো থাকে, যাতে হেলে না পড়ে। মোটরের মাধ্যমে পানি রিসাইকেল করা হয়। উপাদানগুলোও ঘুরতে থাকে। আর নারকেলের ছোবড়ার মধ্যে গুঁজে দেওয়া চারায়ও মাটির উপাদানমিশ্রিত পানি দেওয়া হয়। ঘরের বারান্দা, বসার ঘরে পানির বালতিতেও এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়। লেটুস পাতা ২৬ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে খাওয়ার উপযোগী হয়। এ ছাড়া টমেটো, স্ট্রবেরি ও ক্যাপসিকাম দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে ফল দেয়। একই পদ্ধতিতে অন্যান্য ফুল ও সবজি চাষের বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা চলছে।
এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ কিছুটা ব্যয়সাপেক্ষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাটির উপাদানগুলো কিনতে হয়। এ ছাড়া পাম্প কেনায় খরচ রয়েছে। তবু শহরের অনেক বাগানমালিক আমাদের কাছে এসে এ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চায়। কারণ, শহরে জায়গা কম। নগরের অনেক ছাদবাগানি হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ ইতিমধ্যে শুরুও করেছেন। একই কাঠামোর মধ্যে দুয়েকটি তাক করেও এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়। তবে সূর্যালোক লাগে। পলিথিন দিয়ে ঘেরা থাকলে পোকামাকড়ের সংক্রমণ থেকেও রক্ষা করা যায়। আর কোনো প্রতিষ্ঠান বা ভেন্ডর যদি এ ব্যাপারে এগিয়ে আসে, তবে এই পদ্ধতির বিস্তার আরও দ্রুত করা সম্ভব।
স্বল্প পরিসরে মাটিবিহীন চাষাবাদ মডেলে দেখা যায়, এই পদ্ধতিতে মাটির পরিবর্তে পানিতে অথবা নারিকেলের আঁশের গুঁড়ায় ১০ ফুট/১০ ফুট সাইজের পলিহাউজে স্বল্প খরচে নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি যেমন- তেলের বোতল, পানীয় বোতল ও অন্যান্য কন্টেইনারসহ প্লাস্টিকের টবে অনায়াসে বিভিন্ন পাতা, ফল ও মূল জাতীয় সবজি ও কিছু কিছু ফলের চাষাবাদ করা যায়। এ পদ্ধতিতে ১০০ বর্গ ফুট জায়গা থেকে সারা বছর বিভিন্ন সবজি উৎপাদন করা সম্ভব; চাষাবাদে চাষযোগ্য জমির প্রয়োজন পড়ে না; নারকেলের আঁশের গুঁড়া ও পানিতে জলীয় খাদ্য উপাদান দিয়ে ফসল উৎপাদন করা যায়; রোগ পোকার আক্রমণে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না; সারা বছরব্যাপী ২-৩ সদস্যের পরিবারের জন্য সবজি ও ফল জাতীয় সবজি সরবরাহ করা সম্ভব; মাঠের চাষাবাদের চেয়ে আগাম ও ২-৩ গুণ ফসল পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চারা লাগানোর ট্রের সাইজ বিভিন্ন মাপের হতে পারে যা সেটির ধারকের ওপর অনেকটা নির্ভর করে। সাধারণত ৩ মিটার/১ মিটার মাপের ট্রে হলে ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে করা যায়। আকার অনুযায়ী তার ভেতর পরিমাণ মতো পানি নিতে হবে। পানির গভীরতা ৬-৮ সে.মি. হতে হবে। পানিতে প্রতি ১০০ লিটার পানির জন্য এক লিটারে খাদ্য উপাদান দ্রবণ যোগ করতে হবে। দ্রবণের মিশ্রণ তৈরির পর ট্রের উপর ককশিট স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি গাছ থেকে গাছ এবং সারি থেকে সারি ৩০ সেমি দূরে দূরে রাখতে হবে এবং ককশিটের ওপর এই দূরত্ব অনুযায়ী ছোট গর্ত করতে হবে। তারপর প্রতিটি গর্তে ১টি করে সুস্থ সবল চারা রোপণ করতে হবে।
এ পদ্ধতিতে যেসব ফসল চাষাবাদ করা যায় তার মধ্যে রয়েছে টমেটো, ক্যাপসিকাম, ফুলকপি, শসা, করলা, ধনিয়া, স্ট্রবেরি, লেটুস, কাঁচা মরিচ, লাউ, লালশাক, মুলা, পুদিনা মিষ্টি আলু, আলু, পিয়াজ। আর উৎপাদন খরচ হিসেবে টানেল করতে প্রাথমিকভাবে খরচ ৩ হাজার টাকা। রাসায়নিক দ্রবণ ও অন্যান্য স্থাপনা বাবদ খরচ ২ হাজার টাকা। মোট খরচ হবে ৫ হাজার। প্রতি মৌসুমে ২-৩ হাজার টাকার সবজি হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ প্রতি বছরে গড়ে ৬ হাজার টাকার সবজি পাওয়া সম্ভব। স্থাপনা বাবদ যে খরচ হবে তা দিয়ে ২-৩ বছর একই টানেলে চাষাবাদ করা সম্ভব।
সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশের জনসংখ্যা, আবাসনের জন্য ঘর-বাড়ি, যোগাযোগের জন্য রাস্তা এবং কল-কারখানা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দিন দিন কমে যাচ্ছে আবাদ যোগ্য জমির পরিমাণ। বর্ধিত জনসংখ্যার অব্যাহত খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে তাই শুধু আবাদি জমির উপর নির্ভর করা যাবে না। দেশের এমন অবস্থায় প্রয়োজন অব্যবহৃত খালি জায়গা ও পতিত স্থান শস্য চাষের আওতায় আনা। হাইড্রোপনিকস চাষ পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে আরোপযোগ্য একটি কৌশল। এ পদ্ধতি বাড়ির ছাদে, আঙিনায়, বারান্দায় কিংবা চাষের অযোগ্য পতিত জমিতে সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।