জুমবাংলা ডেস্ক : দিনাজপুরে আমন মৌসুম একেবারে শেষের দিকে। ক্ষেতে এখন যে ধান রয়েছে সেগুলো সুগন্ধি জাতের ধান। সেই ধান ক্ষেতে দলবেঁধে ইঁদুরের গর্ত খুঁজছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী ও শিশুরা। ইঁদুরের গর্ত খুঁজে পেলেই শুরু করছেন খোঁড়াখুঁড়ি।
সেই গর্তের ভেতর থেকে বের করে আনছেন ইঁদুরের রাখা ধানের শীষ। এ ধান শুকিয়ে তার তৈরি করবেন আতব চাল। যা দিয়ে তৈরি করে খাবেন শীতকালিন পিঠা পুলি ও খেজুরের রস দিয়ে তৈরি পায়েশ। ইঁদুরের গর্ত থেকে ধানের শীষ বের করছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক নারী।
গত শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) দুপুরে দিনাজপুরের সদর, চিরিরবন্দ ও খাসমামা উপজেলার বিভিন্ন মাঠে গিয়ে দেখা মেলে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধানের শীষ বের করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের। তাদের বাড়ি দিনাজপুরের সদর, চিরিরবন্দর ও খানাসাম উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। সবাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।
মৌসুমে ধান কাঁটা শুরু হলে সকালে তারা দুমুঠো ভাত খেয়েই বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন মাঠে। প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত চলে তাদের ধানের শীষ সংগ্রহের কাজ। এসব নারী শিশুদের কারো হাতে খোন্তা, কারো হাতে কোদাল, কারো হাতে শাবল আবার কারো হাতে বস্তাও দেখা গেছে।
ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করতে আসা সদর উপজেলার মহারাজপুর গ্রামের আদিবাসী লিপা টুটু (৫৫)। তিনি ধান সংগ্রহ করতে মাঠে এসেছেন তান নাত্নি সমি টুডুকে সঙ্গে নিয়ে।
তিনি বলেন, ‘আমন মৌসুমে যে সব জমিতে ধান কাঁটা হয়ে যায় সে সব ক্ষেত খামার থেকে আমরা ধানের শীষ সংগ্রহ করি। তবে বছরের অন্য সময় রাস্তাঘাটে এবং হাট-বাজারে কাজ করে পেট চালাই। সুগন্ধি ধান গুলো শুকিয়ে আতব চাল করি আর অন্যান্য ধান গুলো সিদ্ধ করে চাল তৈরি করি। আতব চাল দিয়ে পিঠা পুলি, খেজুর রসের পায়েশ ও পোলাও খেয়ে থাকি। সিদ্ধ চাল দিয়ে ভাত।’
তিনি আরো বলেন, ‘সব গর্ত খুঁড়ে ধান পাওয়া যায় না। কোনো কোনো গর্তে ভালো ধান পাওয়া যায়। আবার কোনো গর্তে কিছুই পাওয়া যায় না। তবে এ কাজ করতে সাপের ভয়ও আছে। কারণ ইঁদুরের গর্তের মধ্যে অনেক সময় আবার সাপ থাকে। পরিশ্রমও অনেক। তারপরও পেটের দায়ে জীবন বাজি রেখে আমাদের এই কাজ করতে হয়।’
এই দলের আরেক সদস্য রেখা রানী মন্ডল বলেন, ‘কষ্ট হলেও আমরা এই কাজ করে মৌসুমে ১০ মণ পর্যন্ত ধান জোগাড় করতে পারি। আমরা অন্য মানুষের মাঠে দিনমজুরের কাজও করি।’
দুর্গা রানী হেমরন নামে আরেক নারী বলেন, ‘আমার স্বামী ভ্যান চালায়। আর আমি এখন এটা করছি। কয়দিন পর আমি আবার বোরো চারা রোপনের কাজ করব। সারাবছর আমরা এটা-ওটা করেই সংসার চালাই।’
গৃহস্থ পরিবারের যখন ধান কাটা-মাড়াই ঘিরে উৎসব চলছে। ঠিক তখনই ভূমিহীন পরিবারগুলোর শিশুরা খুঁজে বেড়াচ্ছে কৃষকের কেটে নেওয়ার সময় ঝরে পড়া ধান। সকাল বা বিকেল কিংবা মিষ্টি রোদে হাতে ব্যাগ ও কাঁধে কোদাল আর বাশিলা নিয়ে মাঠে ছুঁটছে তারা। সারাদিন সংগ্রহ করছে ৫ থেকে ৬ কেজির মতো ধানের শিষ। যখন ধানের পরিমাণ বেশি হয় তারা বেঁচে দেয়। অনেকে আবার পিঠাপুলি খাওয়ার জন্য জমিয়ে রাখে সেই ধান। এ ধান কুড়িয়ে কারো আবার বছরের একবেলা খাবার কিংবা বছরে অন্তত একদিন পিঠা খাওয়ার সুযোগ হয়।
শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) সকালে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার খামারপাড়া ইউনিয়নের নেউলা গ্রামের কাউয়ার দোলায় ধান কুড়াতে ব্যস্ত শিশু সেলিম, গুলজার ও সাদেকুল। ওদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলে, কৃষকরা যখন ক্ষেত থেকে ধান কেটে নিয়ে যাওয়ার পর অনেক ধানের ছড়া এমনিতেই পড়ে থাকে সেগুলো আমরা কুড়িয়ে থাকি। এছাড়াও ক্ষেতে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে পাওয়া যায় অনেক ধান।
ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান সংগ্রহ করতে আসা শিশু লাপল হেমরন (১১) জানায়, আমার বাবা-মা পরের জমিতে কাজ করেন। আমন মৌসুমে আমরা ক্ষেত-খামার থেকে ধানের শিষ সংগ্রহ করি। অভাব অনটনের সংসারে ধান কুড়িয়ে শীতের সময় পিঠা খাব।’
কৃষক জাকারিয়া বলেন, ‘আগে মাঠ জুড়ে ধান কুড়ানি শিশুদের আনাগোনা ছিল অনেক বেশি। এক সময়ে ধান কাটার একটা উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল। এখন সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে, শিশুরা এখন নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে। আগের সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না।’
এ বিষয়ে চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দর এলাকার স্বেচ্ছাসেবী মো. ফজলুর রহমান বলেন, মূলত দারিদ্র্যের কারণেই এসব নারীরা খেত-খামার থেকে ধান সংগ্রহ করেন। তবে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধানের শীষ সংগ্রহ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ অনেক সময় ইঁদুরের গর্তে সাপ থাকতে পারে। আর এতে যে কারও জীবন মৃত্যুর মুখেও পড়তে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।