লাইফস্টাইল ডেস্ক : পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘর সবার ভালো লাগে। চারপাশ পরিষ্কার গোছানো থাকলে মনও ভালো থাকে। অগোছালো ঘর প্রভাব ফেলে মানসিক স্বাস্থ্যে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই থাকি না কেন দিন শেষে বাড়ি ফেরার তারা সকলেরই থাকে। নিজের বাড়িতে নিজের মতো করে থাকার চেয়ে আরাম আর কিছু নেই। কিন্তু কাজের চাপে বা অলসতার কারণেই হোক সেই বাড়ির দিকেই সব সময় নজর দিতে পারি না আমরা। ফলে জিনিসপত্র অগোছালো অবস্থায় রয়ে যায়।
বাড়িতে এসে দুটি ঘরের একটিতে ঢুকেই আপনি দেখতে পেলেন জামাকাপড় সব এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মোবাইল, ল্যাপটপের চার্জারগুলোও সব একটির সাথে আরেকটি পেঁচিয়ে গেছে। বিছানার চাদর ঠিক নেই, বালিশের কভারও খুলে গেছে। পড়ার টেবিলে বইগুলোও ওলটপালট হয়ে আছে। মেঝেতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ধূলা-ময়লা, চুলসহ বিভিন্ন আবর্জনা। অন্য ঘরটি একেবারেই পরিপাটি। জামাকাপড় সব ওয়্যারড্রোবে ভাজ করে গুছিয়ে রাখা। পড়ার টেবিলে বই-খাতা সাজানো। বিছানার চাদর টানটান হয়ে আছে। বালিশও সুন্দরভাবে রাখা ঠিক সেখানে, যেখানে তার থাকার কথা। মেঝেতেও কোনো ময়লার ছাপ নেই। এখন যদি আপনাকে বলা হয় ঘর দুটির একটি হলো কোনো মেয়ের, অপরটি কোনো ছেলের, নিঃসন্দেহে আপনি ধরে নেবেন প্রথম ঘরটি কোনো ছেলের আর দ্বিতীয়টি কোনো মেয়ের। কেননা এটি দেখেই আপনি অভ্যস্ত যে ছেলেদের ঘর নোংরা-অগোছালো, আর মেয়েদের ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আর তা হবে না-ই বা কেন। পরিসংখ্যান তো বলছেই, কোনো একটি সাধারণ দিনে একজন নারী তার ঘর পরিষ্কারে যে সময় ব্যয় করে, একজন পুরুষ ব্যয় করে তার তিন ভাগের এক ভাগ সময়।
পুরুষদের অগোছালো স্বভাবকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য ইংরেজিতে একটি পরিভাষাও রয়েছে, ‘ডার্ট ব্লাইন্ড’। অর্থাৎ ধূলা-ময়লা কিংবা অগোছালো কোনোকিছু চোখে পড়ে না যাদের। বিজ্ঞান কিন্তু তা বলছে না। কেননা গবেষণার মাধ্যমেই প্রমাণ হয়ে গেছে, কোনো জিনিস বা জায়গার অপরিচ্ছন্নতা পুরুষদের ঠিক ততটাই চোখে পড়ে, যতটা পড়ে নারীদের। সুতরাং জিনগত কারণে পুরুষরা এগুলোতে কম খেয়াল দেয়, সেই অজুহাত দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। বরং খুঁজতে হবে অন্য এমন কোনো কারণ, যে কারণে অপরিচ্ছন্নতা দেখা সত্ত্বেও তা দূরীকরণে খুব একটা উদ্যোগী হয় না পুরুষরা। সম্প্রতি এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন ইউনিভার্সিটি অভ ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা বারবারার সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সারাহ থিবো ও তার দল। তারা জানার চেষ্টা করেছেন, কেন নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি অগোছালো-অপরিচ্ছন্ন হয়।
প্রথমেই ঘরের কাজে নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিষয়টি উঠে আসে। বর্তমান সময়ে নারীরা শিক্ষা থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র, সকল জায়গায় যতই উন্নতি করুক না কেন, ঘরের কাজে আজও তাদেরকে পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়। কেউ যেন না ভাবেন, এই বিষয়টি শুধু তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই বিদ্যমান। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো সর্বাধুনিক দেশেও দেখা যায় এমন চিত্র। সেখানে একজন নারী দৈনিক গড়ে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় ব্যয় করে রান্না, ঘর ঝাঁরা ও কাপড় ধোয়ায়। তাদের এই সময়ের এক-তৃতীয়াংশ খরচ হয় কেবল ঘর গোছানো তে। অপরদিকে পুরুষরা মাত্র আধাঘণ্টায় সব কাজ সেরে ফেলে, যার মধ্যে ১০ মিনিট তারা ব্যয় করে ঘরের জিনিসপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ও গোছানোর কাজে।
নারীদের আত্মনির্ভরশীলতা, পেশা, দৈনিক ঘরের বাইরে কাজ প্রভৃতি কোনোকিছুর ফলেই হ্রাস পায় না ঘরের কাজে নারী-পুরুষের এই বৈষম্য। এমনকি সুইডেনের মতো দেশেও, সরকারী নীতিমালাই রয়েছে লিঙ্গ-বৈষম্য দূরীকরণের নিমিত্তে, সেখানেও নারীদেরই ঘরের কাজ বেশি করতে হয়। বরং বলা যায়, সেখানকার নারীদের অন্যান্য দেশের নারীদের চেয়ে বেশিই কাজ করতে হয়। কারণ একে তো সুইডেনের অধিকাংশ নারীই ঘরের বাইরে ফুল-টাইম কাজ করে, পাশাপাশি বাসায় ফিরেও তারা পুরুষদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি কাজ করে। নারীদের যত বেশি সময় ব্যয় করতে হয় ঘরের কাজে, ততই তাদের সুযোগ কমে যায় প্রধান অর্থকরী পেশায় সময় দানে। এছাড়া পুরুষদের চেয়ে তারা অবসর সময় কাটানো, বিশ্রাম নেওয়া এবং পরিমিত ঘুমের সুযোগও পায় অনেক কম। ঘরের টুকটাক কাজ সেরে তাদের ঘুমাতে যেতে যেমন দেরি হয়, তেমনই ঘরের কাজ সারার লক্ষ্যে তাদের সকালেও আগে আগে ঘুম থেকে উঠতে হয়। আবার সারাদিন শেষে বাসায় ফিরে পুরুষরা কিছুটা জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলেও, নারীদের লেগে পড়তে হয় ঘরের কোনো একটি কাজে।
ডার্ট-ব্লাইন্ডনেস’ যদি দায়ী না হয়, তাহলে কেন নারীরা পুরুষদের চেয়ে ঘরের কাজ বেশি করে? কেন পুরুষরা অপেক্ষাকৃত বেশি অগোছালো হয়?
এ ব্যাপারে একটি প্রচলিত কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় নারী ও পুরুষদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক প্রত্যাশা। অর্থাৎ নারীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সমাজ আশা করে, পুরুষদের কাছ থেকে তা করে না। এ ব্যাপারে মনোবৈজ্ঞানিক বই ‘Why Men Like Straight Lines and Women Like Polka Dots‘ এর রচয়িতা গ্লোরিয়া মসের রয়েছে নিজস্ব তত্ত্ব। তিনি বলেন, ‘এই ভিন্নতাগুলো তৈরি হয়েছে মানব ইতিহাসের ৯৯ শতাংশ সময় ধরে। কারণ সেই সময়টায় মানুষ বাস করত শিকারি ও সংগ্রাহক হিসেবে। পুরুষরা ছিল শিকারী, তারা বিভিন্ন খাদ্যবস্তু শিকার করে আনত। আর নারীরা ছিল সংগ্রাহক, তারা প্রধানত ঘরে থাকত ও পুরুষদের শিকার করে আনা খাদ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করত।’
অর্থাৎ মানবসভ্যতার শুরু থেকে সিংহভাগ সময় যেহেতু পুরুষরা ঘরের বাইরের কাজে বেশি সক্রিয় থেকেছে আর নারীরা ঘরের অভ্যন্তরীণ কাজে, তাই স্বাভাবিকভাবেই ঘরের কাজে তাদের কাছ থেকে অধিক নিপুণতার প্রত্যাশা গড়ে উঠেছে। সেই প্রত্যাশা বাড়তে বাড়তে এখন এমন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে যে, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের যুগেও ঘরের কাজের বেলায় বৈষম্যটা রয়েই গেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।