স্পোর্টস ডেস্ক : ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিনের চালু করা ব্যালন ডি’অর ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। ১৯৫৬ সালে প্রথমবার এ পুরস্কার জিতে নেন ইংলিশ ফুটবলার স্ট্যানলি ম্যাথিউজ। গত সোমবার ৬৭তম ব্যালন ডি’অর পুরস্কার উঠল আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি লিওনেল মেসির হাতে। তবে এটাই প্রথম নয়। রেকর্ড অষ্টমবারের মতো ব্যালন ডি’অর ট্রফি জিতলেন ৩৬ বছর বয়সী ফুটবলার!
তিনটি ভিন্ন দশকে মোট আটবার ব্যালন ডি’অর জয় করলেন মেসি। আর্জেন্টাইন সুপারস্টার এ ট্রফিটি জিতলেন ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৫, ২০১৯, ২০২১ ও ২০২৩ সালে। ট্রফিটি টানা জয়ের রেকর্ডও তার দখলে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টানা চারবার বিশ্বের সেরা ফুটবলারের মুকুট জিতেছেন তিনি। এবার জিতে রেকর্ডটা আরেকটু সংহত করলেন। পাঁচবার জিতে তার নিকটতম দূরত্বে পর্তুগিজ সুপারস্টার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। মেসির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রোনালদো ব্যালন ডি’অর জিতেছেন ২০০৮, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে। এছাড়া ফরাসি গ্রেট মিশেল প্লাতিনি, ডাচ গ্রেট ইয়োহান ক্রুইফ ও মার্কো ফন বাস্তেন তিনবার করে ব্যালন ডি’অর ট্রফির স্বাদ পেয়েছেন।
মেসির রেকর্ড ভাঙা রোনালদোর পক্ষে সম্ভব নয়; প্লাতিনি ও বাস্তেন সাবেক, আর ক্রুইফ পরপারে। কাজেই মেসির রেকর্ড ভাঙতে হলে কাউকে নতুন করে শুরু করতে হবে।
মেসি বলেছেন, এটাই সম্ভবত তার ক্যারিয়ারের সর্বশেষ একক শিরোপা। তবে এরই মধ্যে যত ট্রফি তিনি জিতেছেন তা নজিরবিহীন এবং কিছু রেকর্ড আছে যা হয়তো অনেকদিন অক্ষত থাকবে।
গত ডিসেম্বরে বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়েই মূলত মেসির নামে ব্যালন ডি’অর ট্রফিও লেখা হয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক এক মাসের পারফরম্যান্স! কাতারের সবুজ গালিচায় ফুল ফুটিয়ে প্রথমবারের মতো আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে। ফাইনালে দুটিসহ মোট সাত গোল করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন তিনি। তারই হাত ধরে এলো আরেকটি ব্যালন ডি’অর ট্রফি।
মেসির শোকেসটা ট্রফিতে ঠাসা। বার্সেলোনার হয়ে খেলার সময় দলীয় ও ব্যক্তিগত সম্ভাব্য সব ট্রফিই জিতেছেন। ছিল না শুধু বিশ্বকাপ ট্রফিটা। আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের আজীবনের সেই স্বপ্নটাও তার পূরণ হয় কাতারের মাঠে। কিলিয়ান এমবাপ্পের ফ্রান্সকে উত্তেজনাপূর্ণ ফাইনালে হারিয়ে শিরোপার স্বাদ পান মেসি ও তার সহযোদ্ধারা। সেই সাফল্যের স্বীকৃতি মিলল এবার ব্যালন ডি’অর জয়ে। তবে মেসি জানেন, তাকে খুব শিগগিরই থামতে হবে।
৩০ অক্টোবর প্যারিসে ব্যালন ডি’অর জয়ের পর এক সাক্ষাৎকারে মেসি বলেছেন, ‘আমি মনে করি হ্যাঁ, এটাই আমার শেষ ব্যালন ডি’অর।’
সেটা মেসি ভালো করেই জানেন ও মানেন। তিনি এখন আলো থেকে অনেক দূরে। ইউরোপে দুই দশকের বন্ধন ছিন্ন করে নাম লিখিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ ফুটবলে। এর মধ্য দিয়ে ব্যালন ডি’অর জয়ের সম্ভাবনাও যে শেষ হতে চলল, সেটি মেসি বুঝতে পারছেন।
মেসি এটিকে শেষ ব্যালন ডি’অর বললেও এখন পর্যন্ত যা করেছেন সেই রেকর্ডও টিকে থাকতে পারে বহু বছর। এর পুনরাবৃত্তি কঠিনই। তার পেছনেই আছেন আরেক ফুটবল জায়ান্ট রোনালদো। তিনি ব্যালন ডি’অর জিতেছেন পাঁচবার। তবে তিনিও ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে চলে এসেছেন। মেসির মতোই ৩৮ বছর বয়সী রোনালদোও ইউরোপ ছেড়েছেন। তিনি এখন খেলেন সৌদি আরবের আল নাসের ক্লাবের। এখনো ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন, গোলও করছেন। তবে ব্যালন ডি’অর জয়ের রেস থেকে হয়তো দূরেই সরে যাচ্ছেন।
মিশেল প্লাতিনি, ইয়োহান ক্রুইফ ও মার্কো ফন বাস্তেন তিনবার করে জিতেছেন ব্যালন ডি’অর। কাজেই, মেসির জন্য হুমকি এ মুহূর্তে কেউই নেই।
শুধু ব্যালন ডি’অরই নয়, আরো পাঁচটি রেকর্ড আছে মেসির, যা ভাঙা অদূর ভবিষ্যতে ‘অসম্ভব’ই।
এক পঞ্জিকাবর্ষে ৯১ গোল: ২০১২ সালে ক্লাব ও জাতীয় দল মিলে ৯১ গোল করেছিলেন মেসি। তার কাছাকাছি আসতে পেরেছেন গোল স্কোরিং জায়ান্ট রোনালদো ও রবার্ট লেভানডভস্কি। রোনালদো ২০১৩ সালে রিয়াল মাদ্রিদে খেলার সময় ও লেভা ২০২১ সালে বায়ার্ন মিউনিখে খেলার সময় ৬৯ গোল করেন। আরো বললে, চলতি বছর আর্লিং হালান্ড ৪৪ ও কিলিয়ান এমবাপ্পে ৪০ গোল করেছেন। এখনো সামনে দুই মাস বাকি আছে। যদিও মেসির রেকর্ড ছোঁয়ার জন্য তা যথেষ্ট সময় নয়। নরওয়েজিয়ান অবিশ্বাস্য একটি বছর কাটানোর পরও এখনো মেসি থেকে ৪৭ গোল দূরে!
৮২ গোলের মৌসুম (৭৩ গোল ক্লাবের হয়ে): ২০১১-১২ মৌসুমে ক্লাব ও জাতীয় দল উভয়ের হয়েই রেকর্ড গড়েন মেসি। ক্লাবের হয়ে গড়েন ৭৩ গোলের রেকর্ড। আর দেশের জার্সিতে সেবার করেন ৯ গোল। তুলনা করলে দেখা যাবে, তার কাছাকাছি যেতে পেরেছেন শুধু রোনালদো। পর্তুগিজ তারকা ২০১৪-১৫ মৌসুমে ক্লাবের হয়ে ৬১ গোল করলেও জাতীয় দল মিলে মোট গোল দাঁড়ায় ৬৬টি। জার্মান গ্রেট গার্ড মুলার ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে ৬৭ গোল ও পেলে ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে ৬৬ গোল করেন।
এক মৌসুমে ৫০ গোল: একটি সময় তেলমো জারা ও হুগো সানচেজের ৩৮টি লিগ গোল নিয়ে প্রায় ২০ বছর ধরে আলোচনা ছিল। ১৯৫০-৫১ মৌসুমে জারা ও ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে সানচেজ রেকর্ড গড়েন। প্রশ্ন ছিল, কেউ কখনো তাদের এ রেকর্ড ভাঙতে পারবে কিনা। কিন্তু ২০১০ সালের পর মেসি ও রোনালদো তিনবার করে ও লুই সুয়ারেজ একবার এ রেকর্ড ভেঙেছেন। এর মধ্যে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ৫০টি লিগ গোল করেছেন মেসি। রোনালদো ২০১৪-১৫ মৌসুমে ৪৮ গোল পর্যন্ত যেতে পেরেছেন।
টানা ১৯ ম্যাচে ন্যূনতম এক গোল: এটি মেসির আরেক রেকর্ড। রোনালদো নাজারিও ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো টানা ১০ ম্যাচে গোল করেছেন। ২০১২-১৩ মৌসুমে টানা ১৯ ম্যাচে গোল করেন মেসি। চোটে না পড়লে রেকর্ডটি আরেকটু প্রলম্বিত হতো। যদিও ইনজুরি থেকে ফিরে আবার টানা দুই ম্যাচে গোল করেন। ফলে তিনি খেলেছেন এমন টানা ২১ ম্যাচে গোলের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন মেসি।
লা লিগায় ৪৭৪ গোল: মেসি ও রোনালদোর আগমনের আগ পর্যন্ত তেলমো জারা ২৫১ গোল নিয়ে লা লিগায় রেকর্ড ধরে রেখেছিলেন। এখন তিনি পড়ে গেছেন ৩ নম্বরে। মেসি ৪৭৪ গোল করে রেকর্ডধারী, আর রোনালদো করেছেন ৩১১ গোল। রোনালদোর চেয়ে ১৬৩ ও জারার চেয়ে ২২৩ গোলে এগিয়ে মেসি।
অন্যান্য লিগের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় প্রিমিয়ার লিগে ২৬০ গোল করে অ্যালান শিয়েরার, সিরি-এ লিগে ২৭৪ গোল করে সিলভিও পিওলা, বুন্দেসলিগায় ৩৬৫ গোল করে গার্ড মুলার ও লিগ ওয়ানে ২৯৯ গোল করে দেলিও ওন্নিস রেকর্ডধারী।
এছাড়া আরো কিছু রেকর্ড মেসি গড়েছেন, যা ভাঙা অসম্ভব নয়, তবে কঠিন। যেমন, লা লিগায় ছয়বার গোল্ডেন বুট জয়। অনেকে মনে করেন, অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত হালান্ড বেশকিছু গোল্ডেন বুট জিতবেন।
মেসির কিছু রেকর্ড ভাঙা হবে, কিছু টিকে থাকবে। তবে তিনি যা অর্জন করেছেন, তা তাকে অমরত্ব এনে দিতে যথেষ্ট। সোমবার থিয়েটার দু শ্যালেতে আরেকটি স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে সেটাই ফুটে উঠল। মার্কা, নিউইয়র্ক টাইমস, ইউরোস্পোর্টস
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।