স্পোর্টস ডেস্ক : সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান খুঁজে পাওয়া এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। সবচেয়ে দ্রুততর, উচ্চতর আর সবচেয়ে শক্তিধর খোঁজার এই উৎসবে পদক জয়ীই হন সেরা। আর আধুনিক অলিম্পিকের সবচেয়ে বেশি পদক যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু মাইকেল ফেলপসের থলেতে। ২৩টি স্বর্ণপদকসহ সর্বমোট ২৮টি অলিম্পিক মেডেল জয় করেছেন তিনি।
ছেলে বিশ্বজয় করবে এমনটা স্বপ্ন না দেখলেও বাবা মাইকেল ফ্রেড ফেল্পস ও মা ডেবোরাহ স্বপ্ন দেখেছিলেন তিন ছেলে-মেয়ে সাঁতারে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়বে। মাইকেল ফেলপস ১৯৮৫ সালের ৩০ জুন জন্মগ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টমোর স্টেটের মেরিল্যান্ড শহরে। তার মা ছিলেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। আর বাবা ছিলেন মেরিল্যান্ড স্টেট ট্রুপার।
মা ডেবি ফেলপসের স্বপ্নই ছিল, তার সন্তানরা দেশসেরা সাতারু হবে। সে আশাতেই ছেলে মাইকেল আর মেয়ে হুইটনিকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন বাল্টিমোর সুইমিং ক্লাবে। তাকে আশাহত হতে হয়নি। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই মেয়ে হুইটনি যখন ২০০ মিটার বাটারফ্লাইতে দেশের মধ্যে দশম স্থান অর্জন করে। কিন্তু ফেলপসকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কমছিল না। তার যেন লক্ষ্য স্থির হচ্ছে না। সে তখন ক্যাথি লিয়ার্সে অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। টসন হাইস্কুলের পুলে প্রায়ই নানা বিভিন্ন কা- ঘটাত ফেলপস। তাতে ক্যাথি বুঝতেন ফেলেপস এখন পানির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেনি। সে সময় ফেলেপস অ্যাটেনশন ডেফিসিট অ্যান্ড হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার নামের একটা রোগের শিকার বলে চিহ্নিত হন। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি স্থির থাকতে পারে না। তারা নির্দিষ্ট কাজ ধারাবাহিকভাবে করতে পারে না। শিশু মাইকেল ফেলেপস এই রোগের চূড়ায় অবস্থান করছিল। সেই সময়ে এক স্কুলশিক্ষক তার মাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে কখনোই জীবনে একটি স্থির লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। তার মাও তাই দেখেছিলেন। স্কুলের পড়াশোনা, বাড়ির কাজ, খেলাধুলা সব জায়গাতে যেন ফেলেপস শেষ করতে পারে না। হঠাৎ করে হাল ছেড়ে দেয়। বিরক্ত হয়ে ওঠে।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন ক্যাথি লিয়ার্সও। তিনি সেজন্য তাকে অন্য কোনো সাঁতার না শুধু ব্যাকস্ট্রোকেই সময় বেশি দিতে বলতেন। যেন পানির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি জানতেন একবার যদি পানির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে এরপরে সাঁতারু নিজেই জেনে যায় তাকে কী করতে হবে। হলো তাই। ধীরে ধীরে পানিকে বশ মানালেন শিশু মাইকেল। এরপরে ফ্রিস্টাইল, বাটারফ্লাইতে আনন্দ খুঁজে পেতে থাকেন। সাঁতার ছিল তার কাছে আশীর্বাদের মতো। নিজেকে যেখানে উচ্ছ্বলভাবে মেলে ধরতে শুরু করেছিলেন। দেখেছিলেন বড় বোন এখানে সুনাম অর্জন করেছে। নিজের জন্য এই প্রথম একটি লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হলেন।
এরপর মা ডেবি তাকে ভর্তি করে দেন শার্টলের প্রশিক্ষণালয়ে। শার্টলের এই দলে মূলত আট থেকে এগারো বছরে শিশুদের একটি দল। ফেলেপসের বয়স তখন আট বছর। দলের মধ্যে সবচেয়ে ছোত। এ কারণে প্রায়ই দেখা যেত, প্রতিযোগিতায় সে শেষের দিকে থাকছে। কিন্তু হারতে তার ভালো লাগত না। তাই এই অবস্থান পরিবর্তনের জন্য সে চেষ্টা চালাত নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে। পরিবর্তন আসতে সময় বেশি লাগল না।
এক বছর পরেই দেখা গেল সেই চঞ্চল, অল্পতেই রেগে যাওয়া ফেলপস শার্টলের সাঁতারের আটটি রেকর্ড নিজের নামে করে নেন ফেলপস!
‘সে জিততে পছন্দ করত। আমার মনে হয়, সে খেয়ালই করত না যে দেশেই তার অবস্থান প্রথম। তার একমাত্র চিন্তা-চেতনা ছিল পুলেই প্রথম হওয়া।
একজন সাঁতারুর পানিকে নিজের আয়ত্তে আনতে পারলে কখন কোথায় গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রোক ফেলা উচিত, কিংবা কখন গতি বা ত্বরণ বাড়াতে হবে, তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকেন।
ফেলপসের মধ্যে এই গুণাবলি ছিল সবচেয়ে তীব্র। এ কারণেই ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে ফেলপস পুরো দেশে বয়সভিত্তিক সাঁতারুদের মধ্যে সেরা দশের মধ্যে চলে আসেন। তার বোন হুইটনি ফেলপস ১৯৯৫ প্যান প্যাসিফিক ২০০ মিটার বাটারফ্লাইতে ব্রোঞ্জ পদক নিয়ে ফিরেছেন!
ফেলপসের তখন দরকার ছিল এমনই একজন পথপ্রদর্শকের।
বোনের কাছ থেকে ফেলেপস বুঝলেন আন্তর্জাতিক অঙ্গন আর বাল্টিমোর সুইমিং ক্লাব একই জিনিস নয়।
মাইকেল ফেলপস বয়সভিত্তিকে দেশ সেরা সাঁতারু। হুইটনি ততদিনে জায়গা করে নিয়েছেন ১৯৯৬ সালের অলিম্পিক দলে। আরেক বোন হিলারিও সুইমিং স্কলারশিপ নিয়ে পড়ছেন কলেজে।
১৯৯৬ সালের ইস্টার্ন জোন চ্যাম্পিয়নশিপে সবাইকে তাক লাগিয়ে ফেলপস। ৫০০ গজ ফ্রিস্টাইল শেষ করেন ৬ মিনিটের নিচে। মাত্র এগারো বছর বয়সে যেটা করেন সেটা বিশ বছরের নিচে আর কেউ করতে পারেনি।
সেই চ্যাম্পিয়নশিপেই ফেলপসের বন্দনা বাল্টিমোর ক্লাব পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে।
নিজের ১১তম জন্মদিনের কিছুদিন আগেই যোগ দেন বব বাউম্যানের গ্রুপে। বাউম্যানের অধীনে নিজেকে সবচেয়ে শাণিত করেন ফেলপস। দৃঢ়চেতা মনোভাব কিংবা সংকল্প, কিছুরই অভাব ছিল না ঠিক ফেলপসের মধ্যে। তাই বাউম্যানের অধীনে খুব দ্রুতই নিজেকে ছাড়িয়ে যান। শিষ্যের প্রতিভার ব্যাপারটি আগেই ধরতে পেরেছিলেন বাউম্যান। ফেলপসকে তাই বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথম রেকর্ডটি করার পর যাতে তাকে ফোন করতে না ভোলেন ফেলপস।
২০০১ সালের, ২৪ জুলাই, মাত্র ১৫ বছর ৯ মাস জাপানের ফুকৌকোতে ২০০ মিটার বাটারফ্লাইতে বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে ফেলপস ফোন করেন প্রিয় প্রশিক্ষককে।
এরপর ফেলপসের জয় রথ থামেনি। এরপরের ইতিহাস শুধুই জয়ের। অবসরের ঘোষ্ণা দিয়ে এসেছেন ফিরে। জয় করেছেন আরও স্বর্ণ। হয়েছেন সেরাদের সেরা। সেই ইতিহাস সবাই জানে। কিন্তু যারা তৈরি হচ্ছে সেরা হতে তাদের জানতে হবে সেরাদের সেরা কীভাবে হতে হয়। তাদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে মাইকেল ফেলেপসের জীবনী। লক্ষ্যস্থির করতে না পারা যে ছেলেটি হয়েছে সর্বকালের সর্বসেরা অলিম্পিয়ান।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।