স্বাধীনতা লাভের ৫৪ বছরেও মেলেনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি। বাঙালি নদীপাড়ে ঝুপড়ি ঘরে অন্যের জমিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ৭৫ বছর বয়সী জহুরা বেগম। যিনি শেষ বয়সে বীরাঙ্গনার সরকারি স্বীকৃতির খবরটুকু শুনে মারা যেতে চান। পাক হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতনের শিকার জহুরা এখনো সরকারি ঘোষণার প্রতীক্ষায় আছেন।

জহুরা বেগমের বাড়ি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি গ্রামে। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের একদিন দুপুরে বাঙালি নদীতে গোসল করতে যান জহুরা। সবেমাত্র তার বিয়ে হয়েছে। এদিকে উপজেলার চন্দনবাইশা ক্যাম্প থেকে ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের বাঁশহাটা গ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা টহলে ঢুকেছে। তখন বাঙালি নদীর ঘাটে গোসলরত অবস্থায় জহুরা মিলিটারিদের কবলে পড়েন। মিলিটারিরা তাকে জোর করে গ্রামের একটি বাড়ির ঘরের ভিতরে নিয়ে যায়। ভয়ে জহুরা ওই ঘরের একটি খাটের নিচে লুকিয়ে পড়েন। পরে হানাদার বাহিনী বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে খাটের নিচে থেকে বের করে এবং সাতজন মিলে তাকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে। জহুরা বেগম তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
এরপর পাকবাহিনী চলে গেলে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে। প্রায় ৩ মাস ধরে চিকিৎসা চলে জহুরা বেগমের। এ ঘটনায় জহুরার স্বামী তাকে ত্যাগ করেন। পরে জহুরা বেগম যখন সুস্থ হন, তখন পরিবারের মধ্যস্থতায় তার স্বামী পুনরায় তাকে গ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি গ্রামে মুখ দেখাতে পারেন না। গ্রামের সবাই তাকে দেখে হাসাহাসি করতো এবং মানুষ ঠাট্টা তামাশা করত।
এ দুঃখে জহুরা বেগম গ্রাম ছেড়ে বগুড়া শহরে চলে যান। সেখানে তিনি মানুষের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। ইতোমধ্যেই তিনি বাঙালি নদীর ভাঙনে তার ভিটেমাটি হারিয়ে ফেলেন। তার স্বামী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দুই মেয়েকে তিনি বিয়ে দিয়েছেন। গত কয়েক বছর আগে তিনি জানতে পারেন সরকার বীরাঙ্গনাদের সহায়তা করছেন।
এ খবর শুনে তিনি আবারও বগুড়া শহর থেকে গ্রামে ফিরে আসেন। ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি গ্রামের বাঙালি নদীর তীরে একটি ঝুপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করেন। তারপর থেকেই উপজেলায় এবং বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেন নিজেকে সরকারের খাতায় বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পেতে। কিন্তু প্রায় একযুগ প্রশাসনের দ্বারে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ঘুরে হয়রান হয়েও পাননি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি।
তিনি এখন ঠিকমতো চোখে দেখেন না। তারপরও সারাদিন বহু কষ্টে মাঠে ধান কুড়ান। কুড়ানো ধান সিদ্ধ করে তিনি শুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু টাকার অভাবে ভাঙতে পারছেন না। বাড়ির পাশে থেকে শাক তুলে খেয়েই চলছে তার জীবন। জহুরা বেগমের বীরাঙ্গনা স্বীকৃতির আবেদন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মূলত তার নাম জহুরা বেগম, পিতার নাম-মৃত ময়েজ প্রামানিক এবং মাতার নাম-মৃত আয়মন বিবি।
জহুরা বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘বেশ কয়েকবছর ধরেই ছাপরা ঘরে বসবাস করছি। টিনের চালা দিয়ে পানি পড়ে। বৃষ্টির দিনে রাতে ঘুমাতে পারিনা, বিছানায় বসে থাকি। আগের মতো আর হাঁটাচলা করতে পারিনা, চোখেও ঠিকমতো দেখিনা, তাই স্বীকৃতির জন্য আর দৌড়ঝাঁপ করতেও পারছি না। মানুষের জমিতে বসবাস করছি। জমিওয়ালা বারবার বাড়ি ভাঙার হুমকি দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামের মানুষও আমাকে নিয়ে নানা ধরনের কটু কথা শোনায়। আর পারছি না, মনে হয় ফাঁস দিয়ে মরে যায়। তবে মরে যাওয়ার আগে সরকারের বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি নিয়ে মরে যেতে চাই।’
স্থানীয় ও বাঁশহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক নূর মোহাম্মদ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘বাড়ির পাশে বাঙালি নদীর তীরে কাশবনে ওৎ পেতে থাকা পাক ক্যাপ্টেন সোহেল খান ও তার দোসরদের পাশবিকতার শিকার হয়ে জহুরা তার সম্ভ্রম হারান।’
বাঁশহাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত আরেক সহকারী শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক (ডাবলু), প্রতিবেশী আব্দুর রাজ্জাক রেজা বলেন, ‘১৯৭১ সালে পাক-হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে জহুরা তার সম্ভ্রম হারিয়েছেন।’ মরহুম ছাত্তার প্রামাণিকের স্ত্রী রুপিয়া এবং মরহুম কবেজ প্রামাণিকের স্ত্রী কোহিনুরসহ গ্রামের অনেকেই জহুরার সঙ্গে পাক-হানাদার বাহিনীর অমানবিক নির্যাতনের কথা স্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে সারিয়াকান্দি উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল আলিম বলেন, ‘বীরাঙ্গনার দাবিদার জহুরাকে উপজেলা কার্যালয়ে দেখা করতে বলা হয়েছে। আপাতত বয়স্ক বা বিধবা ভাতা প্রদানের মাধ্যমে তাকে সরকারি সহায়তার আওতায় নিয়ে আসা হবে। বীরাঙ্গনা স্বীকৃতির প্রয়োজনীয় আবেদনপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



