বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক: রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মোবাইলসেবার মান নিয়ে গ্রাহক অভিযোগ, অসন্তোষ আছে। এর জন্য মোবাইল ফোন অপারেটরদের সদিচ্ছা ও তরঙ্গসংকটকে দায়ী করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য দিয়ে অপারেটররা বলছে, নেটওয়ার্ক সচল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। এর কারণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে যত্রতত্র জ্যামার, রিপিটার ও বুস্টারের ব্যবহার। দৈনিক কালের কন্ঠের প্রতিবেদক কাজী হাফিজ-এর প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে ।
তাদের হিসাবে, রাজধানীতে এক হাজারের বেশি স্থানে এসব বেতারযন্ত্রের ব্যবহার মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো স্থানে জ্যামার থাকলে আশপাশের প্রচুর গ্রাহক নেটওয়ার্ক সংযোগ পায় না। অবৈধ বুস্টার বা রিপিটারও একই ধরনের সমস্যা তৈরি করে। মোবাইল প্রযুক্তি একটি প্রকৌশল পরিকল্পনা ও মানদণ্ড মেনে করা হয়, যাতে গ্রাহকরা নির্বিঘ্নে সেবা পেতে পারে। কিন্তু কেউ যদি অবৈধভাবে নিজের নেটওয়ার্ক সবল করার জন্য বুস্টার বা রিপিটার বসায়, তাহলে তার আশপাশের সব মোবাইল ফোন অপারেটরের গ্রাহকেরই সেবায় বিঘ্ন ঘটে।
অপারেটররা বলছে, ব্যক্তি উদ্যোগে অবৈধভাবে স্থাপিত এসব প্রযুক্তির কারণে অসংখ্য গ্রাহক ভোগান্তি পোহাচ্ছে। হুটহাট কল ড্রপ ও নেটওয়ার্ক না পাওয়ার সমস্যা কোনোভাবেই দূর হচ্ছে না। তৈরি হচ্ছে নিরাপত্তাসংকটও।
রাজধানীর পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম। মোবাইল ফোন তাঁকে অনেক সুবিধা দিয়েছে। বাটন টিপেই তিনি অনেক কাজ সেরে ফেলেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে এই সেবা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, ‘কল ড্রপ হচ্ছে। আবার কোনো কোনো জায়গায় নেটওয়ার্ক পাই না, তখন বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়। ’ শহীদুল ইসলামের মতো এ সমস্যার সম্মুখীন ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানের গ্রাহকরা।
ঘন ঘন কল ড্রপ বা নেটওয়ার্ক না পাওয়ার ঘটনায় অপারেটররা মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করেছে। তাদের গবেষণার ফলাফল যথেষ্ট উদ্বেগের। তারা দেখে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ জ্যামার, বুস্টার ও রিপিটার অবাধে ব্যবহার করা হচ্ছে। বুঝে না বুঝে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এসব প্রযুক্তি কিনে ব্যবহার করছে।
গবেষণায় রাজধানীর যেসব এলাকায় জ্যামার, বুস্টার ও রিপিটারের বেশি ব্যবহার লক্ষ করা গেছে তার মধ্যে রয়েছে পল্লবী থানার একটি অংশ, বনানী থানার দুটি আবাসিক এলাকা, নিকুঞ্জ, মহাখালী ডিওএইচএস ও পুরান ঢাকা। এ ছাড়া পুরানা পল্টন, বনশ্রী ও ধানমণ্ডিতে এসব অবৈধ প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে।
বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা জানান, সাধারণত এসব প্রযুক্তি সরকারি নিরাপত্তামূলক কাজে আমদানি ও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মার্কেট, স্টেডিয়াম মার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে ও অনলাইনে বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে এসব প্রযুক্তি বিক্রি করা হচ্ছে। আইন অমান্য করে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে এগুলো আমদানি ও বিক্রি করছেন।
নিরাপত্তাঝুঁকি অনেক আগে থেকে : ২০১৮ সালের এপ্রিলের ঘটনা। রাজধানীর কাকরাইলে তাবলিগ জামাতের মারকাজ মসজিদে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন রাখতে গোপনে জ্যামার বসিয়েছিলেন এক প্রকৌশলী। এলিফ্যান্ট রোডের একটি দোকান থেকে তিনি জ্যামার দুটি কেনেন। মারকাজের দক্ষিণ পাশের ভবনের তৃতীয় তলার দুটি কক্ষে সেগুলো স্থাপন করেন।
পুলিশ সে সময় বলেছিল, ‘বড় ধরনের ক্ষতিসাধনের লক্ষ্যে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করার উদ্দেশ্যে’ এসব জ্যামার বসানো হয়েছিল। এ নিয়ে সে সময় রমনা থানায় একটি মামলা করা হয়।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর উত্তরায় নিষিদ্ধ সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) তিন সদস্যকে মোবাইল জ্যামারসহ গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। সে সময় জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজরদারি এড়াতে তারা জ্যামার ব্যবহার করত।
মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন ‘এমটব’-এর মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অব.) বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী জ্যামার, রিপিটার বা বুস্টারজাতীয় রেডিও উপকরণ অবৈধভাবে আমদানি করা বা স্থাপন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব রেডিও উপকরণ যত্রতত্রভাবে ব্যবহারের জন্য মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে বিঘ্ন তৈরি হয়। কল ড্রপসহ নেটওয়ার্কের মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। আমরা বিটিআরসির সঙ্গে এটা নিয়ে কাজ করছি। ’
গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) হোসেন সাদাতও প্রায় একই কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য, অবৈধ জ্যামার, রিপিটার বা বুস্টার মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে অযথা সমস্যা তৈরি করে, যা কল ড্রপ, ইন্টারনেট গতি না পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। তিনি বলেন, ‘অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান না বুঝেই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ এসব প্রযুুক্তি অবৈধভাবে ব্যবহার করছে, যা গ্রাহকের ভোগান্তির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, গ্রাহকের স্বার্থে অবৈধভাবে আমদানীকৃত এসব প্রযুক্তি ব্যবহার বন্ধে আইন প্রয়োগকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ’
রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, ‘অবৈধ টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা এরই মধ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এসব অবৈধ যন্ত্রপাতির ব্যবহার যদি বন্ধ করা সম্ভব না হয় তাহলে বিভিন্ন স্থানে নেটওয়ার্কের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে না এবং তা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘মোবাইল অপারেটররা এ সমস্যার কথা আমাদের জানিয়েছে বলে আমার জানা নেই। এ ধরনের সমস্যা যদি হয় তাহলে মোবাইল অপারেটরদেরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোথায় কিভাবে এসবের ব্যবহার হচ্ছে, ডিভাইস কোথায় পাওয়া যাচ্ছে তা আমাদের স্পষ্ট করে জানালে বিটিআরসি ব্যবস্থা নিতে পারে। ’
বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর সিকদারও বলেন, ‘মোবাইল অপারেটররা বিষয়টি বিটিআরসিকে জানিয়েছে এবং তারা এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের সঙ্গে কাজ করছে—এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই। এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকলে তা সমাধানের উদ্যোগ মোবাইল ফোন অপারেটরদেরই নিতে হবে। গ্রাহকদের জন্য মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদেরই। ’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ব্যক্তি পর্যায়ে জ্যামার ব্যবহার হচ্ছে—এ তথ্য আমাদের জানা নেই। ’
অনুসন্ধানে যে তথ্য মিলছে : তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, এমটব ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর ও ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর এ সমস্যার কথা জানিয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছিল এবং বিটিআরসি ওই চিঠি প্রাপ্তির রসিদ নম্বরও দিয়েছিল এমটবকে। এমটব ওই চিঠির সঙ্গে জ্যামার, বুস্টার, রিপিটার সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা দেয়। এসব ডিভাইসের অবৈধ ব্যবহার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোন কোন এলাকায়, কোন কোন স্থাপনায় বহাল আছে সে বিষয়ে চার মোবাইল ফোন অপারেটরের দেওয়া চারটি তালিকাও সংযুক্ত করা হয়। তালিকায় চিহ্নিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে কয়েকটি ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামও ছিল।
বিটিআরসিও এ সমস্যা নিয়ে জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে জনসচেতনতা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সতর্ক করার উদ্যোগ নেয়। ২০১৯ সালের ৯ জুলাই বিটিআরসির স্পেকট্রাম ম্যানেজমেন্ট পরিচালক লে. কর্নেল মো. আমিনুল হক স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি বিটিআরসির অনুমতি ব্যতিরেকে ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফোন অপারেটরদের অনুকূলে বরাদ্দকৃত তরঙ্গে (টুজি-থ্রিজি ইত্যাদি) কর্ডলেস টেলিফোন সেট এবং নেটওয়ার্ক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী জ্যামার, জিএসএম-থ্রিজি নেটওয়ার্ক বুস্টার, রিপিটারসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করছে, যা মোবাইল ফোন অপারেটরদের নেটওয়ার্কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
এসবের কারণে কল ড্রপ হচ্ছে, ইন্টারনেটের গতি কমছে এবং সংযোগ পেতে গ্রাহকের সমস্যা হচ্ছে। তাই কর্ডলেস টেলিফোন সেট, ওয়াকিটকি সেট, নেটওয়ার্ক আটকানো জ্যামারসহ বিভিন্ন বেতারযন্ত্র আমদানি, কেনাবেচা ও ব্যবহারে বিরত থাকতে বলা হয়। অন্যথায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১ অনুযায়ী দায়ী ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে হুঁশিয়ার করা হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।