বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : মোবাইল রিচার্জে ভয়েস বা ইন্টারনেট প্যাকেজ সাধারণত রাউন্ড ফিগারে কম হয়। বেশি হয় ৩৯, ৪৮, ৪৯, ৫৯, ৬৮, ৮৯, ১১৪, ১৪৮, ৩৯৭, ৫৯৯ টাকা ইত্যাদিতে অঙ্কে। কেন রাউন্ড ফিগারে হয় না, অপারেটররা এমনটা কেন করে— এসব তথ্য খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিটিআরসি এই নিয়ম চালু করে রেখেছে। কারিগরি কারণে এমনটা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিটিআরসি। আর এই সূত্র ধরেই মোবাইল রিচার্জ খুচরা দোকানগুলো (রিটেইলার শপ) থেকে রিচার্জ করলে ‘খুচরা টাকা নেই’ অজুহাতে বাকি টাকা বেশির ভাগ দোকানি গ্রাহকে ফেরত দেন না। এভাবে বিপুল অঙ্কের টাকা প্রতিদিন গ্রাহকের পকেট থেকে চলে যাচ্ছে রিচার্জ ব্যবসায়ীদের পকেটে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ম এবং মোবাইল অপারেটরদের প্যাকেজ অনুমোদন করার কারণে খুচরা রিচার্জ ব্যবসায়ীরা এই কাজটি করার সুযোগ পাচ্ছে বলে মনে করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। প্যাকেজগুলো রাউন্ড ফিগারের (যেমন ২০, ৫০, ৮০, ১০০, ৩০০ ইত্যাদি) হলে গ্রাহককে খুচরা পয়সার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এমনকি তাদের রিচার্জের ক্ষুদ্র পরিমাণ অর্থ সব মিলিয়ে যা কোটি টাকা হয়ে দোকানিদের পকেটে যায় না। বাংলাদেশ ‘মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন’ বলছে— এই খুচরা টাকা মোবাইল রিচার্জ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গ্রাহকরা না পাওয়ায় প্রতি মাসে ক্ষতির পরিমাণ ২৭ কোটি টাকার বেশি, যা বছরে হয় ৩২৪ কোটি টাকা।
জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনে প্রতিদিন ৮০ লাখের বেশিবার মোবাইল রিচার্জ (ভয়েস, ডেটা ও এসএমএস মিলিয়ে) হয়। রবি, বাংলালিংক ও টেলিটকের এ বিষয়ক তথ্য জানা যায়নি। তবে টেলিকম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে সব মিলিয়ে প্রতিদিন পৌনে দুই থেকে দুই কোটিবার মোবাইল রিচার্জ হয়। এর অর্ধেকই হয় মোবাইলে- মোবাইল ব্যালেন্স থেকে সরাসরি, বিভিন্ন এমএফএস (মোবাইল আর্থিক সেবা)-এর মাধ্যমে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মোবাইল অপারেটরের অ্যাপ থেকে, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড দিয়ে, রিচার্জ কার্ড স্ক্র্যাচ করে এবং রিচার্জ পয়েন্ট ও রিচার্জের দোকান থেকে মোবাইল ফোনে রিচার্জ করতে গিয়ে।
গ্রামীণফোন জানিয়েছে, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী নিজেই বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল চ্যানেল ব্যবহার করে রিচার্জ করেন— এমন সংখ্যা মোট মোবাইল রিচার্জের ৬৬ শতাংশ। এই হার রবির ৩৮ শতাংশ বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বিটিআরসি থেকে জানানো হয়, মোবাইল অপারেটররা ভয়েস বা ইন্টারনেটের প্যাকেজ গ্রাহকরা তিনভাবে গ্রহণ করতে পারে। মূল ব্যালেন্স থেকে এসএমএস ইউএসএসডি ডায়ালের মাধ্যমে, বিভিন্ন ডিজিটাল চ্যানেল থেকে কার্ডের মাধ্যমে সরাসরি প্যাকেজ কেনার মাধ্যমে এবং নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টের রিচার্জের মাধ্যমে। এরমধ্যে নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টের রিচার্জ— যা রিচার্জ অফার রিচার্জ ক্যাম্পেইন নামেও পরিচিত। এ ক্ষেত্রে গ্রাহককে রিটেইলারের কাছ থেকে বা ডিজিটাল চ্যানেল থেকে উক্ত প্যাকেজের জন্য নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টেররিচার্জ করেতে হয়।
কর্তৃপক্ষ জানায়, আগে অপারেটররা রিচার্জ ক্যাম্পেইনের ক্ষেত্রে ৫-এর গুণিতক সংখ্যাও ব্যবহার করতো। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকরা সেই পরিমাণ টাকা রিচার্জ করলে তাদের অজান্তেই কোনও বান্ডেল অফারে ‘অপট ইন’ হয়ে যায়। এ বিষয়ে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিটিআরসি রিচার্জের মাধ্যমে সার্ভিস ‘অপট ইন’র এ ধরনের ব্যবস্থায় ৫-এর গুণিতক সংখ্যা ব্যবহার না করার নির্দেশনা প্রদান করে। এ কারণে রিচার্জের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত প্যাকেজ চালু রোধে অপারেটররা ৫-এর গুণিতক নয় এরূপ সংখ্যা ব্যবহার করে। বিটিআরসি আরও জানায়, যেকোনও গ্রাহক ইন্টারনেট প্যাকেজ ইন করার ক্ষেত্রে উক্ত প্যাকেজের রিচার্জ অ্যামাউন্ট রিটেইলার থেকে রিচার্জ করলে ওই ভয়েস বা ইন্টারনেট প্যাকজ ক্রয় করতে সম্মত হয়েছেন প্রতীয়মান হবে এবং প্যাকেজটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, ‘গ্রাহকের ক্রয় সুবিধাকে মাথায় রেখেই মোবাইল অপারেটররা সাধারণত বিভিন্ন সেবা বা প্যাকেজ ও এর মূল্যমান নির্ধারণ করে থাকে। মূলত রিচার্জ এবং প্যাকেজের মূল্যমানের মধ্যে পার্থক্য রাখতেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে রাউন্ড ফিগার বিষয়টি নিয়ে আসা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রাহক সাধারণত রাউন্ড ফিগারেই যেমন ২০, ৪০, ৫০ ইত্যাদি অথবা পাঁচের গুণিতক পরিমাণ টাকায় রিচার্জ করে থাকেন। তাই, যেকোনও ধরনের বিড়ম্বনা এড়ানোর জন্য এবং গ্রাহকের সুবিধার কথা মাথায় রেখে রাউন্ড ফিগারে কোনও প্যাকেজের মূল্যমান নির্ধারণ করা হয় না, যাতে রাউন্ড ফিগারে কেউ রিচার্জ করলে অন্যকোনও প্যাকেজ ক্রয় অথবা চালু হয়ে না যায়।’
জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশন্স খায়রুল বাসার বলেন, ‘গ্রাহকরা সাধারণত রিচার্জ করার সময় রাউন্ড ফিগারে করেন। একারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশে প্রযোজ্য প্যাকেজের ক্ষেত্রে রাউন্ড ফিগার ব্যবহার করা হয় না।’
বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড সাস্টেইনিবিলিটি আংকিত সুরেকা বলেন, ‘আমাদের মূল উদ্দেশ্য গ্রাহকরা যেন তাদের নিয়মিত অ্যাকাউন্ট টপ-আপ এবং প্রোডাক্ট টপ-আপগুলোর মধ্যে থেকে তাদের সুবিধা মতো বেছে নিতে পারেন। এছাড়া বিটিআরসি প্রদত্ত ট্যারিফ নির্দেশিকা অনুসারে ৫-এর গুণক হয়— এমন পরিমাণ কোনও অফার অপারেটররা চালু করতে পারবে না। যেমন- আপনি ৪০ টাকা রিচার্জ করে থাকলে আপনার মূল অ্যাকাউন্টে ৪০ টাকা যোগ হবে। কিন্তু আপনি যদি ৩৯ টাকার রিচার্জ করে থাকেন, তাহলে শুধু সেই অফারের সঙ্গে সম্পৃক্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ ডেটা, ভয়েস, এসএমএস পাবেন। কোনও অতিরিক্ত টাকা আপনার অ্যাকাউন্টে যোগ হবে না। গ্রাহকদের সুবিধা এবং সচেতনতার কথা বিবেচনা করে আমরা স্পষ্টভাবে ক্রয় মূল্যের তথ্য এবং ক্রয় পরবর্তী নোটিফিকেশন্স এসএমএস দিয়ে জানাই, যাতে গ্রাহকরা অবগত থাকেন।’
ভয়েস বা ইন্টারনেটের বেশিরভাগ প্যাকেজ রাউন্ড ফিগারে না হওয়া, খুচরা বিক্রেতারা রিচার্জের বাকি টাকা (এক বা দুই টাকা) ফেরত না দেওয়া, ইত্যাদি বিষয়ে অভিমত জানতে চাইলে ‘বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন’র সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যেহেতু রিটেলাররা মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে কমিশন কম পেয়ে থাকে, তাই তা পুষিয়ে দিতে বিজোড় অঙ্কের টাকার প্যাকেজ বাজারে ছাড়ে। আর খুচরা না থাকার অজুহাতে গ্রাহকদের রিটেইলাররা অবশিষ্ট টাকা ফেরত দেন না। এই অর্থের পরিমাণ বেশিরভাগ সময় এক বা দুই টাকা। এই সমস্যার কারণে আমরা গণশুনানিতে বিটিআরসির কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম— কোনোভাবেই বিজোড় অঙ্কের টাকায় প্যাকেজ অনুমোদন যেন না দেওয়া হয়। কিন্তু কমিশন এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। বর্তমান সময়ে দেখা যায়, প্যাকেজ রিচার্জ করতে গেলে রিটেইলাররা বলে এরকম প্যাকেজ নেই। রিটেলারদের দেওয়া রিচার্জের মাধ্যমে গ্রাহকরা প্রতারিত হন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ৬৫ শতাংশ ফিচার ফোন ব্যবহারকারীরা। কারণ, টক-টাইম এবং ডাটা কম্বাইন্ড থাকাতে ফিচার ফোন ব্যবহারকারীরা ডেটা (ইন্টারনেট) ব্যবহার করতে পারেন না।’
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।