অন্ধকারে ঝিলমিল করা কোটি কোটি নক্ষত্র। অসীমের দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা নীহারিকা, গ্যালাক্সি, কৃষ্ণগহ্বর। এই অতলান্ত মহাসাগরের বুকে কি আমরা একা? নিঃসঙ্গ? এই প্রশ্ন শুধু বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়; এটা মানুষের অস্তিত্বের মূলে লেগে থাকা এক গভীর, প্রায় আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা। মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে জিজ্ঞাসা কেড়ে নেয় আমাদের ঘুম। মহাকাশের নিস্তব্ধতা কি প্রকৃতই নিস্তব্ধ? নাকি অদেখা কোনও দূর নক্ষত্রপুঞ্জে, কোনও অচেনা গ্রহের অরণ্যে, সমুদ্রে, পাথরের আড়ালে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো সভ্যতার শ্বাস-প্রশ্বাস, অন্য কোনো প্রাণের তরঙ্গ? এই অনুসন্ধান শুধু টেলিস্কোপ আর রেডিও সিগন্যালের গল্প নয়; এটা আমাদের নিজেদের পরিচয় খোঁজার, এই সুবিশাল ক্যানভাসে মানবজাতির স্থান বুঝে নেওয়ার এক অনন্ত অভিযাত্রা।
মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব: বিজ্ঞানের অনন্ত অনুসন্ধান
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, ফ্রাঙ্ক ড্রেক নামে এক তরুণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী একটি সমীকরণ লিখেছিলেন যা চিরতরে বদলে দিয়েছিল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। ড্রেক সমীকরণ। দেখতে সরল, কিন্তু এর প্রতিটি চলরাশি (N = R × fp × ne × fl × fi × fc × L) ধারণ করে একেকটি গভীর প্রশ্ন, একেকটি অজানা সম্ভাবনা। মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব কতটা সম্ভব? এই সমীকরণ ছিল তারই একটি গাণিতিক রূপরেখা। R হলো আকাশগঙ্গায় নক্ষত্র গঠনের হার। fp হলো সেই নক্ষত্রগুলোর মধ্যে কতটার গ্রহ আছে। ne হলো সেইসব গ্রহের মধ্যে কতগুলো ‘গোল্ডিলক্স জোন’-এ অবস্থিত – যেখানে তরল পানির অস্তিত্ব সম্ভব। এরপর আসে আসল জাদুর পর্ব: fl – সেইসব উপযুক্ত গ্রহগুলোর মধ্যে কতটায় প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। fi হলো সেই প্রাণ থেকে কতটায় বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটেছে। fc হলো সেই বুদ্ধিমান প্রাণী কতটা যোগাযোগপ্রযুক্তি গড়ে তুলেছে। আর L হলো সেইসব সভ্যতার গড় আয়ু।
ড্রেকের সময়ে এসব চলরাশির মান ছিল অন্ধকারে তীর ছোঁড়ার মতো। কিন্তু আজ? হাবল স্পেস টেলিস্কোপ থেকে শুরু করে কেপলার, টিএসএস (TESS), এবং সর্বশেষ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) আমাদের দিয়েছে অভূতপূর্ব তথ্য। আমরা এখন জানি:
- গ্রহের প্রাচুর্য: প্রায় প্রতিটি নক্ষত্রেরই গ্রহমণ্ডলী আছে। শুধু আকাশগঙ্গাতেই শতকোটি গ্রহ থাকার সম্ভাবনা।
- গোল্ডিলক্স জোনের প্রাচুর্য: টিএসএস মিশন সহজেই শনাক্ত করেছে এমন বহু গ্রহ (যেমন TRAPPIST-1 সিস্টেমের কিছু গ্রহ) যারা তাদের নক্ষত্র থেকে এমন দূরত্বে আছে যেখানে তরল পানি থাকা তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব।
- জীবনের উপাদানের সার্বজনীনতা: জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিঃরসায়ন আমাদের শিখিয়েছে যে মহাবিশ্ব জীবনের মৌলিক উপাদানে পরিপূর্ণ। জটিল জৈব অণু (Complex Organic Molecules – COMs) যেমন অ্যামিনো অ্যাসিড, নিউক্লিওবেস, এমনকি সুগার অণুও (গ্লাইকলালডিহাইড) পাওয়া গেছে নক্ষত্র-জন্ম নেওয়া মেঘ (স্টেলার নার্সারি), ধূমকেতু (যেমন 67P/চুরিউমভ-গেরাসিমেঙ্কো, যেখানে রোসেটা মিশন গ্লাইসিন পেয়েছে), এবং এমনকি অন্যান্য গ্রহের বায়ুমণ্ডলে (যেমন শনির চাঁদ টাইটানে হাইড্রোকার্বন হ্রদ ও জটিল জৈব রসায়ন)!
তবুও, সেই গুরুত্বপূর্ণ ধাপ – fl, অর্থাৎ জটিল জৈব অণু থেকে স্ব-অনুলিপনকারী, কোষ-ভিত্তিক প্রাণের উৎপত্তি – এখনো রহস্যাবৃত্ত। পৃথিবীতে প্রাণ কীভাবে শুরু হয়েছিল? ছিল কি কোনও মহাজাগতিক বীজ (প্যানস্পার্মিয়া)? নাকি ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত উদ্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর শুধু পৃথিবীর জন্যই নয়, মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব কতটা সাধারণ বা বিরল, তারও চাবিকাঠি।
বহির্জাগতিক প্রাণ: সম্ভাব্য রূপ ও রূপকথা
যখন আমরা ‘এলিয়েন’ বা বহির্জাগতিক প্রাণের কথা ভাবি, প্রায়ই হলিউডের ছবির মতো শিংওয়ালা, সবুজ মানবাকৃতির চরিত্র বা অতিকায় কীট চোখে ভাসে। কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের শেখায়: প্রকৃতির সম্ভাবনা সীমাহীন এবং আমাদের কল্পনার চেয়েও অদ্ভুত। মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব মানেই যে কার্বন-ভিত্তিক, ডিএনএ/আরএনএ দিয়ে চালিত, পানি-নির্ভর প্রাণী হবে, তার কোনও গ্যারান্টি নেই।
- ভিন্ন রসায়ন, ভিন্ন জীবন?
- সিলিকন-ভিত্তিক প্রাণ: কার্বনের পর সিলিকনই একমাত্র মৌল যা জটিল, দীর্ঘ শৃঙ্খল গঠনে সক্ষম। যদিও পৃথিবীর পরিবেশে সিলিকন জৈব অণুর জন্য উপযুক্ত নয়, কিন্তু অতি উচ্চ তাপমাত্রা বা চাপের পরিবেশে (যেমন বৃহস্পতির মতো গ্যাসীয় দানবের গভীরে, বা উত্তপ্ত ভূ-পৃষ্ঠ বিশিষ্ট এক্সোপ্ল্যানেটে) সিলিকন ভিত্তিক জীবনরূপ কল্পনা করা যায়।
- অমেরুদণ্ডী প্রাণের আধিপত্য: পৃথিবীতেই জটিল প্রাণের বড় অংশই অমেরুদণ্ডী। মহাবিশ্বেও হয়তো মেরুদণ্ডী প্রাণীর চেয়ে অমেরুদণ্ডী বা সম্পূর্ণ ভিন্ন গঠনের প্রাণের প্রাধান্য বেশি হবে।
- এককোষী থেকে সুপার-অর্গানিজম: পৃথিবীতে মাইক্রোবায়াল জীবনই সর্বত্র বিদ্যমান। বহির্জাগতিক প্রাণও হয়তো প্রধানত অণুজীবীয় স্তরে সীমিত, অথবা এমনকি ‘গেইয়া হাইপোথিসিস’-এর মতো কোনও গ্রহব্যাপী সুপার-অর্গানিজম হিসেবে বিরাজ করছে, যাকে পৃথক ‘প্রাণী’ হিসেবে চিহ্নিত করা কঠিন।
- বুদ্ধিমত্তার সংজ্ঞা: আমরা প্রায়শই বহির্জাগতিক বুদ্ধিমত্তাকে মানব-সদৃশ প্রযুক্তিগত সভ্যতার সমতুল্য ধরে নিই। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা নানা রূপ নিতে পারে:
- সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী (ডলফিন, তিমি) বা শিম্পাঞ্জিদের গভীর সামাজিক বুদ্ধিমত্তা ও আবেগ।
- অক্টোপাসের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ও জটিল স্নায়ুতন্ত্র।
- উদ্ভিদজগতের নেটওয়ার্কিং ও যোগাযোগ (উড ওয়াইড ওয়েব)।
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) উত্থান – কি কোনও গ্রহে অজৈবভাবে তৈরি AI সভ্যতা বিরাজ করছে?
মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব শুধু মানবাকৃতির নয়, তা অদৃশ্য অণুজীব, শিলার ফাটলে লুকানো অদ্ভুতুড়ে জীব, বা এমনকি শুদ্ধ শক্তির রূপেও থাকতে পারে – যা আমাদের ধারণার বাইরে।
শনাক্তকরণের প্রযুক্তি: বায়োসিগনেচার ও টেকনোসিগনেচারের সন্ধানে
কোনও বহির্জাগতিক সভ্যতার সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ বা রেডিও বার্তা পেতে আমাদের আরও বহু বছর, হয়তো শতাব্দীও লেগে যেতে পারে। তাই, বর্তমান গবেষণার মূল লক্ষ্য মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব এর পরোক্ষ প্রমাণ খোঁজা, বিশেষ করে নিকটবর্তী এক্সোপ্ল্যানেটগুলোর বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করে।
- বায়োসিগনেচার (Biosignatures): এগুলো হলো এমন রাসায়নিক বা ভৌত নিদর্শন যা জৈবিক প্রক্রিয়ার ফল। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) এর সবচেয়ে বড় মিশনগুলোর একটি এটি।
- অক্সিজেন (O₂) + মিথেন (CH₄): পৃথিবীতে, এই দুটি গ্যাস একসাথে দীর্ঘস্থায়ী হলে তা শক্তিশালী বায়োসিগনেচার (জীবনের লক্ষণ), কারণ তারা রাসায়নিকভাবে দ্রুত বিক্রিয়া করে এবং একে অপরকে ধ্বংস করে ফেলে। তাদের স্থায়ী উপস্থিতি প্রয়োজন জীবনের মাধ্যমে তাদের ক্রমাগত পুনঃউৎপাদন।
- ফসফিন (PH₃): পৃথিবীতে, এই গ্যাস প্রধানত অণুজীব বা মানুষের শিল্প কার্যক্রমে তৈরি হয়। ২০২০ সালে শুক্রের মেঘে ফসফিন শনাক্তের খবর (যদিও বিতর্কিত) সাড়া ফেলে দিয়েছিল, কারণ সেখানে প্রচণ্ড তাপ ও অম্লতা থাকায় তা প্রাকৃতিকভাবে দীর্ঘস্থায়ী হওয়া অসম্ভব, প্রাণের ইঙ্গিত দিতে পারে।
- ক্লোরোফিল সিগনেচার: যদি কোনও গ্রহে সালোকসংশ্লেষণকারী উদ্ভিদ বা ব্যাকটেরিয়া থাকে, তারাও আলোর নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ বা প্রতিফলন করবে, যা টেলিস্কোপে ধরা পড়তে পারে (‘রেড এজ’)।
- টেকনোসিগনেচার (Technosignatures): এগুলো উন্নত সভ্যতার প্রযুক্তিগত কার্যকলাপের লক্ষণ।
- রেডিও/অপটিক্যাল সংকেত: SETI (Search for Extraterrestrial Intelligence) ইনস্টিটিউট দশকের পর দশক ধরে শোনার চেষ্টা করছে মহাকাশ থেকে আসা কৃত্রিম রেডিও সংকেতের জন্য। Breakthrough Listen প্রকল্প বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপগুলো ব্যবহার করে এই অনুসন্ধানকে নতুন গতি দিয়েছে।
- মেগাস্ট্রাকচার: ডাইসন গোলক বা অনুরূপ কল্পিত কাঠামো যা নক্ষত্রের শক্তির বড় অংশ ব্যবহার করে, তা থেকে নির্গত তাপের স্বতন্ত্র সিগনেচার থাকতে পারে।
- বায়ুমণ্ডলে দূষণ: পৃথিবীর মতো শিল্পায়িত সভ্যতার বায়ুমণ্ডলে সিএফসি (CFCs) বা নাইট্রোজেন অক্সাইডের মতো কৃত্রিম দূষক শনাক্ত হওয়া একধরনের টেকনোসিগনেচার।
- লেজার পালস: অপটিক্যাল SETI অন্যান্য সভ্যতা প্রেরিত শক্তিশালী লেজার পালস শনাক্ত করার চেষ্টা করে।
এই অনুসন্ধান সহজ নয়। দূরত্ব অসীম, সংকেত ক্ষীণ, এবং প্রাকৃতিক ঘটনা (যেমন পালসার, কোয়াসার, বা রাসায়নিক বিক্রিয়া) কৃত্রিম সংকেতের মতো দেখা দিতে পারে। তবুও, জেমস ওয়েবের মতো প্রযুক্তি আমাদের আগের চেয়ে বহুগুণ কাছে নিয়ে এসেছে মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণের সম্ভাবনার কাছাকাছি।
বিশ্বাস, দর্শন ও সংস্কৃতি: প্রাণের রহস্যে মনুষ্যত্বের প্রতিচ্ছবি
মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব শুধু বিজ্ঞানের প্রশ্ন নয়; এটি গভীরভাবে জড়িত আমাদের বিশ্বাস ব্যবস্থা, দার্শনিক ভাবনা এবং সাংস্কৃতিক আখ্যানের সাথে।
- ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা: অনেক ধর্ম বিশ্বাস করে সৃষ্টিকর্তা শুধু পৃথিবীতেই নয়, মহাবিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও প্রাণ সৃষ্টি করেছেন। কেউ কেউ এটিকে ঈশ্বরের অসীম সৃজনশীলতার প্রকাশ বলে দেখেন। আবার অন্যরা ভাবেন, বহির্জাগতিক প্রাণের ধারণা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সংঘাতপূর্ণ হতে পারে। পোপ ফ্রান্সিস একবার বলেছিলেন, “যদি এলিয়েনরা আসে… আমি তাদের বাপ্তিস্ম দিতে প্রস্তুত।”
- ফার্মি প্যারাডক্স: ‘তারা সব কোথায়?’ পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির এই সহজ কিন্তু গভীর প্রশ্ন আজও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মহাবিশ্ব এত বিশাল ও পুরনো, এবং আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রাণ-উপযোগী গ্রহের সংখ্যা এত বেশি – তাহলে কেন আমরা এখনো কোনও বহির্জাগতিক সভ্যতার কোনও নিশ্চিত প্রমাণ পেলাম না? এর উত্তর হিসেবে নানা তত্ত্ব আছে:
- মহা ছাঁকনি (The Great Filter): হয়তো প্রাণের উদ্ভব বা বুদ্ধিমত্তার বিকাশের পথে এমন কোনও বিপদজনক ধাপ আছে যা খুব কম সভ্যতা পার হতে পারে (যেমন পারমাণবিক যুদ্ধ, জলবায়ু বিপর্যয়, বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ)।
- সময় ও স্থানের বিশালতা: হয়তো সভ্যতাগুলো দূরে, বা অন্য সময়ে বিদ্যমান ছিল/হবে। আমাদের সময়রেখা মিলছে না।
- উন্নত সভ্যতার অনাগ্রহ: হয়তো তারা আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে, কিন্তু যোগাযোগ করতে বা হস্তক্ষেপ করতে চাইছে না (‘চিড়িয়াখানা হাইপোথিসিস’)।
- আমরা সত্যিই প্রথম: হয়তো জটিল প্রাণের বিকাশের জন্য অনুকূল অবস্থা তৈরি হতেই এতটা সময় লেগেছে যে আমরা মহাবিশ্বে প্রথম প্রজন্মের বুদ্ধিমান প্রাণী।
- সাংস্কৃতিক প্রভাব: এলিয়েনদের নিয়ে গল্প, সিনেমা, সাহিত্য আমাদের আশা, ভয়, এবং অজানার প্রতি মুগ্ধতার প্রতিফলন। স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘E.T.’ থেকে ডেনিস ভিলেনুভের ‘অ্যারাইভাল’ পর্যন্ত – এই গল্পগুলো আমাদের মানবিকতার দর্পণ।
মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের প্রতিক্রিয়া আমাদের নিজেদের সম্পর্কে অনেক কিছু বলে – আমাদের একাকীত্ব, কৌতূহল, আতঙ্ক এবং মহাজাগতিক নাট্যে আমাদের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের গভীর অনিশ্চয়তা।
ভবিষ্যতের অভিযাত্রা: নতুন প্রজন্মের টেলিস্কোপ ও গভীর মহাকাশ মিশন
বর্তমান গবেষণা শুধু শুরু। আগামী দশকগুলোতে একের পর এক শক্তিশালী প্রযুক্তি মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব এর সন্ধানে নিযুক্ত হবে:
- জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST): ইতোমধ্যেই এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাইঅক্সাইড, এমনকি সম্ভাব্য ডাইমিথাইল সালফাইডের (DMS, পৃথিবীতে ফাইটোপ্ল্যাংকটন দ্বারা উৎপাদিত) মতো অণুর সন্ধান পেয়েছে। এর শক্তি ক্রমাগত নতুন তথ্য দেবে।
- নাসার ন্যান্সি গ্রেস রোমান স্পেস টেলিস্কোপ (২০২৭): হাবলের চেয়ে ১০০ গুণ বিস্তৃত দৃশ্যক্ষেত্র নিয়ে হাজার হাজার এক্সোপ্ল্যানেট খুঁজবে এবং তাদের বায়ুমণ্ডলীয় বৈশিষ্ট্য প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করবে।
- বৃহৎ ভূমি-ভিত্তিক টেলিস্কোপ:
- এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ (ELT – চিলি, ~২০২৮): ৩৯-মিটার ব্যাসের প্রাথমিক আয়না নিয়ে এক্সোপ্ল্যানেটের সরাসরি ছবি তোলার চেষ্টা করবে এবং তাদের বায়ুমণ্ডলের বিশদ বিশ্লেষণ করবে।
- থার্টি মিটার টেলিস্কোপ (TMT – হাওয়াই, বিতর্কিত): অনুরূপ ক্ষমতা সম্পন্ন।
- মহাকাশে জীবনের সরাসরি অনুসন্ধান:
- ইউরোপা ক্লিপার মিশন (নাসা, ~২০৩০): বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপার বরফাবৃত সমুদ্র অনুসন্ধান করবে, যেখানে তরল পানির বিশাল ভাণ্ডার ও সম্ভাব্য হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট আছে – পৃথিবীর গভীর সমুদ্রের প্রাণের অনুকূল পরিবেশের মতো।
- ড্রাগনফ্লাই মিশন (নাসা, ~২০৩৭): শনির চাঁদ টাইটানে একটি ড্রোন প্রেরণ করবে, যার জটিল জৈব রসায়ন প্রাক-জৈবিক অবস্থা বা ভিন্নধর্মী জীবন সম্পর্কে জানাতে পারে।
- SETI-র উন্নত পদ্ধতি: Breakthrough Listen এর মতো প্রকল্প আরও সংবেদনশীল ডিটেক্টর এবং AI-চালিত ডেটা বিশ্লেষণ ব্যবহার করে দুর্বল বা অস্বাভাবিক সংকেত ধরার চেষ্টা করবে।
এই অভিযাত্রায় বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের তরুণ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছেন। জাতীয় পর্যায়ে মানমন্দির উন্নয়ন ও মহাকাশ বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ বাড়ছে।
জেনে রাখুন (FAQs)
১। পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও কি প্রাণের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে?
এখনও পর্যন্ত মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব এর কোনও নিশ্চিত ও প্রত্যক্ষ প্রমাণ (যেমন এলিয়েন জীবের নমুনা বা স্পষ্ট যোগাযোগ সংকেত) পাওয়া যায়নি। তবে, অনেকটা পরোক্ষ প্রমাণ ও সম্ভাবনার সূত্র মিলেছে। যেমন, বহু এক্সোপ্ল্যানেট প্রাণের উপযোগী পরিবেশে আছে, মহাশূন্যে প্রাণের মূল উপাদান প্রচুর, এবং শুক্র, মঙ্গল, ইউরোপা, এনসেলাডাস, টাইটান প্রভৃতি স্থানে প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা চলছে। শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে বায়োসিগনেচার খোঁজাই এখন মূল লক্ষ্য।
২। বহির্জাগতিক প্রাণের সাথে যোগাযোগ হলে পৃথিবীর কী অবস্থা হবে?
মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব শনাক্ত হলে তা হবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিপ্লব। এর প্রভাব অপরিসীম। বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, সমাজনীতি – সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন আসবে। এটি মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে (বহির্জাগতিক হুমকির মুখে), অথবা সামাজিক বিভাজনও বাড়াতে পারে। যোগাযোগের ধরন (শান্তিপূর্ণ না হুমকিমূলক), প্রযুক্তিগত পার্থক্য এবং সাংস্কৃতিক ব্যবধান কী প্রভাব ফেলবে, তা অনুমান করা কঠিন। জাতিসংঘের UNOOSA (United Nations Office for Outer Space Affairs) ইতোমধ্যেই এই সম্ভাব্য ঘটনা মোকাবেলায় প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছে।
৩। আমাদের সৌরজগতে কি প্রাণ থাকতে পারে?
হ্যাঁ, পৃথিবী ছাড়াও সৌরজগতের অন্যান্য স্থানে প্রাণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মঙ্গলে অতীতে তরল পানি ও উষ্ণ পরিবেশ ছিল, সেখানে অতীতের অনুজীবীয় প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপা ও শনির চাঁদ এনসেলাডাসের বরফের নিচে বিশাল তরল পানি সমুদ্র আছে, যেখানে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট জীবনের জন্য শক্তি জোগাতে পারে। শনির চাঁদ টাইটানের হাইড্রোকার্বন হ্রদ ও জটিল জৈব রসায়নও একধরনের ‘অদ্ভুত’ জীবনের সম্ভাবনার কথা মনে করায়। এসব স্থানে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে।
৪। বহির্জাগতিক প্রাণের খোঁজে সবচেয়ে বড় বাধা কী?
মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণের পথে প্রধান বাধাগুলো হলো:
- অতিবিপুল দূরত্ব: নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরিও ৪.২৪ আলোকবর্ষ দূরে। আলোর গতিতেও তথ্য যেতে সময় লাগে।
- প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: দূরের গ্রহের বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ বা ক্ষীণ সংকেত শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন।
- জীবনের সংজ্ঞা ও রূপের অনিশ্চয়তা: আমরা যা খুঁজছি, তার থেকে জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপেও থাকতে পারে।
- সময়ের স্কেল: মানব সভ্যতা মাত্র কয়েক হাজার বছর পুরনো। মহাবিশ্বের ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে সভ্যতাগুলোর আবির্ভাব ও বিলুপ্তির সময়রেখা মিলানো ভাগ্যের ব্যাপার।
৫। পৃথিবীতে প্রাণ কীভাবে শুরু হয়েছিল? এটা কি মহাজাগতিক?
পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি (‘অরিজিন অফ লাইফ’) এখনও বড় রহস্য। প্রধান তত্ত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- প্রাথমিক সাগরে রাসায়নিক বিবর্তন: তরল পানিতে শক্তি (আলো, তাপ, তড়িৎ) প্রয়োগে সরল জৈব অণু থেকে জটিল স্ব-অনুলিপনকারী অণুর (RNA World Hypothesis) উদ্ভব।
- প্যানস্পার্মিয়া: মহাকাশ থেকে আগত ধূমকেতু, উল্কা বা মহাজাগতিক ধূলিকণার মাধ্যমে প্রাণের মূল উপাদান বা এমনকি আদিম জীবাণু পৃথিবীতে পৌঁছেছে। মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব থাকলে তা উল্কার মাধ্যমে পৃথিবীতেও ছড়িয়ে পড়তে পারত।
পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি বুঝলে মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব কতটা সম্ভব, তা অনুমান করা সহজ হবে।
৬। সাধারণ মানুষ কীভাবে এই গবেষণায় অংশ নিতে পারে?
মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব এর অনুসন্ধানে আপনি সরাসরি অংশ নিতে পারেন!
- SETI@home: বোল্ডার, কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রকল্পে (যদিও বর্তমানে সক্রিয় নয়, অনুরূপ ভবিষ্যত প্রকল্প আসতে পারে) আপনার কম্পিউটারের অব্যবহৃত ক্ষমতা ব্যবহার করে রেডিও টেলিস্কোপ ডেটা বিশ্লেষণে সাহায্য করা যেত।
- Planet Hunters TESS: জিএফজেড (Zooniverse) প্ল্যাটফর্মের এই নাগরিক বিজ্ঞান প্রকল্পে টিএসএস টেলিস্কোপের ডেটা দেখে নতুন এক্সোপ্ল্যানেট খুঁজতে পারেন যে কেউ।
- সচেতনতা ও শিক্ষা: মহাকাশ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা এবং জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে জানুন, অন্যকে জানান। বাংলাদেশের জ্যোতির্বিজ্ঞান চক্র (বিএএস) বা স্থানীয় বিজ্ঞান ক্লাবগুলোর সাথে যুক্ত হোন।
- তথ্য আদান-প্রদান: জেএসটির নতুন আবিষ্কার বা SETI-র খবর সম্পর্কে আপডেট থাকুন এবং আলোচনায় অংশ নিন।
মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব – এই চিরন্তন প্রশ্নের উত্তর আমরা হয়তো আগামীকাল পাব, হয়তো হাজার বছর পর, হয়তো কখনোই না। কিন্তু এই অনুসন্ধান নিজেই আমাদের মহিমান্বিত করে। এটা বলে দেয়, আমরা কতটা ক্ষুদ্র হয়েও কতটা বড় স্বপ্ন দেখতে পারি। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের চোখ ধরা ছবি, কিউরিওসিটি রোভারের মঙ্গলে পাঠানো তথ্য, ইউরোপার বরফের নিচে লুকানো সমুদ্রের সম্ভাবনা – এগুলো শুধু বৈজ্ঞানিক ডেটা নয়; এগুলো মানব আত্মার জয়ের গল্প, আমাদের অদম্য কৌতূহলের জয়গান। পৃথিবীর বাইরে প্রাণের খোঁজ মানে পৃথিবীতে প্রাণের মূল্য নতুন করে উপলব্ধি করা। প্রতিটি নতুন নক্ষত্র, প্রতিটি প্রাণ-উপযোগী গ্রহের খবর আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই নীলাভ বিন্দুর প্রতিটি প্রাণ, প্রতিটি মুহূর্ত কতটা বিরল ও মূল্যবান। মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নের উত্তর যাই হোক না কেন, এই যাত্রা আমাদের বদলে দিচ্ছে, আরও সংযুক্ত করছে এই মহাবিশ্বের প্রতি, আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করাচ্ছে আমাদের ভূমিকা। তাই, টেলিস্কোপে চোখ রাখুন, তারাদের দিকে তাকান, এবং জিজ্ঞাসা চালিয়ে যান – কারণ প্রশ্ন করার এই সাহসই আমাদের মানুষ করে তোলে। এই মহাজাগতিক রহস্যের অনুসন্ধানে আপনার কৌতূহলকে সজীব রাখুন, বিজ্ঞানের অগ্রগতি অনুসরণ করুন, এবং পৃথিবীর এই অনন্য জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।