আকাশের দিকে তাকালে আমরা দেখি কোটি কোটি নক্ষত্রের মিটমিট আলো। কিন্তু এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তুটি দেখা যায় না। এটি আলো পর্যন্ত গিলে খায়। হ্যাঁ, বলছি ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের কথা। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং একে বলেছিলেন “প্রকৃতির ভয়ঙ্করতম মুখ“! ২০২৪ সালের মে মাসে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আমাদের জানাল, মহাবিশ্বের শৈশবকালে (মাত্র ৪০ কোটি বছর বয়সে) যে ব্ল্যাক হোল তৈরি হয়েছিল, তা আজকের চেয়ে ৫ গুণ বড়! এই তথ্যও আমাদের বিস্মিত করে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে: এই অতিপ্রাকৃত শক্তিধর বস্তু সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? আসুন, ডুব দেই সেই অতল গহ্বরে—যেখানে পদার্থবিদ্যার নিয়ম ভেঙে পড়ে, সময় থমকে যায়, আর প্রকৃতি তার সবচেয়ে অদ্ভুত খেলনা নিয়ে হাজির হয়।
ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে অজানা তথ্য: মহাবিশ্বের চিরন্তন গিলটি খাওয়ার যন্ত্র
কৃষ্ণগহ্বরের জন্মকথা: তারার মৃত্যুই যেখানে সূচনা
- মহাকাশীয় ফিনিক্স পাখির গল্প: সাধারণত একটি তারার জ্বালানি শেষ হলে বিশাল বিস্ফোরণ হয় (সুপারনোভা)। কিন্তু সূর্যের চেয়ে ২০-৩০ গুণ ভারী তারার মৃত্যুই জন্ম দেয় ব্ল্যাক হোলের! ২০২৩ সালে নাসার চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি পর্যবেক্ষণ করে, গ্যালাক্সি M101-এ একটি তারা সংকুচিত হয়ে সরাসরি ব্ল্যাক হোলে পরিণত হচ্ছে—বিস্ফোরণ ছাড়াই! (NASA.gov রিপোর্ট)। এই প্রক্রিয়ায় নক্ষত্রটি নিজের ভরের ওপরই ধসে পড়ে, তৈরি করে অসীম ঘনত্বের এক বিন্দু (সিঙ্গুলারিটি)।
- আদিম ব্ল্যাক হোলের রহস্য: বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিস্ফোরণের (বিগ ব্যাং) মাত্র সেকেন্ডের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল “আদিম ব্ল্যাক হোল” (Primordial Black Holes)। এগুলো একটি আপেলের সমান ভর থেকে শুরু করে পাহাড় পরিমাণ হতে পারে! ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির গাইয়া মিশন ডাটা বিশ্লেষণ করে ২০২৪ সালে ধারণা দিয়েছে, হয়তো আমাদের ছায়াপথের “ডার্ক ম্যাটার” বা অদৃশ্য ভরের ২০% আসলে এই ক্ষুদ্রাকার ব্ল্যাক হোল থেকেই! (Nature জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা)।
ব্ল্যাক হোলের প্রকারভেদ: আকারে ভিন্ন, রহস্যে এক
- স্টেলার ব্ল্যাক হোল: সূর্যের ভরের ৫ থেকে ১০০ গুণ। আমাদের ছায়াপথে এদের সংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি! নিকটতমটি আছে ১,৫০০ আলোকবর্ষ দূরে—”গাইয়া BH1″ নামে পরিচিত।
- সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল: সূর্যের ভরের লক্ষ-কোটি গুণ ভারী! প্রায় প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটির বসবাস। আমাদের মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে থাকা “স্যাজিটেরিয়াস A*” এর ভর সূর্যের চেয়ে ৪৩ লক্ষ গুণ বেশি। ২০২২ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ এটির প্রথম ছবি তুলে বিশ্বকে তাক লাগায়।
- মাঝারি ব্ল্যাক হোল (IMBHs): এরা দীর্ঘদিন ছিল “কিংবদন্তি”। কিন্তু ২০২৩ সালে হাবল টেলিস্কোপ ধারণা দিল, গ্যালাক্সি M4-এর কেন্দ্রে সূর্যের ভরের ৮০০ গুণের একটি IMBH থাকতে পারে! এরা সম্ভবত ছোট ব্ল্যাক হোলের একত্রীভবনে সৃষ্টি হয়।
ঘটনা দিগন্তের ওপারে: যেখানে পদার্থবিদ্যা হার মানে
- দিগন্ত পার হওয়ার শব্দ: ভাবুন, আপনি একটি ব্ল্যাক হোলের দিকে যাচ্ছেন। কিছুদূর গেলেই পৌঁছে যাবেন ঘটনা দিগন্তে (Event Horizon)। এই সীমানা পার হলে ফেরার পথ নেই—এমনকি আলোর জন্যও না! মজার ব্যাপার? আপনি নিজে টের পাবেন না কখন দিগন্ত পার হলেন! কিন্তু দূর থেকে দেখলে মনে হবে আপনি চিরকাল সীমানার কাছেই জমে আছেন (স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাখ্যা)।
- স্প্যাগেটিফিকেশন: মহাকাশীয় নুডলসে পরিণত হওয়া: ব্ল্যাক হোলের কাছে গেলে মাধ্যাকর্ষণ এত ভয়ঙ্কর যে আপনার পায়ের দিকে টান মাথার দিকের চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে! ফলে আপনি লম্বা চিকন স্প্যাগেটির মত হয়ে যাবেন। এই প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম “টাইডাল ডিসরাপশন”। ২০২১ সালে হাবল টেলিস্কোপ একটি তারাকে এভাবেই ছিঁড়ে ফেলতে দেখেছিল (HubbleSite.org রিপোর্ট)।
চিরন্তন ধাঁধা: তথ্য প্যারাডক্স ও হকিং বিকিরণ
- তথ্য হারিয়ে গেল কোথায়?: ব্ল্যাক হোল কোনো বস্তুকে গিলে ফেললে তার সমস্ত তথ্য (যেমন—পরমাণুর সজ্জা) হারিয়ে যায় বলে মনে হত। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে—তথ্য কখনো নষ্ট হয় না! এই দ্বন্দ্বই “তথ্য প্যারাডক্স” নামে বিখ্যাত। স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, হয়তো তথ্য দিগন্তের উপর জমা হয়, অথবা অন্য কোনো মহাবিশ্বে চলে যায়!
- হকিং বিকিরণ: ব্ল্যাক হোলের মৃত্যুর ফিসফিসানি: ১৯৭৪ সালে হকিং যুগান্তকারী তত্ত্ব দেন—ব্ল্যাক হোল চিরকাল থাকবে না, বাষ্পীভূত হবে! কীভাবে? শূন্য স্থান আসলে “শূন্য” নয়—এখানে অনবরত ভার্চুয়াল কণা (কণা-প্রতিকণা জোড়) তৈরি-বিনাশ হয়। দিগন্তের কাছে এদের একটিকে ব্ল্যাক হোল গিলে ফেললে, অন্যটি মহাবিশ্বে পালিয়ে যায়—এটাই “হকিং বিকিরণ”! ক্ষুদ্র ব্ল্যাক হোল দ্রুত বাষ্পীভূত হয়, কিন্তু বৃহদাকার একটির জন্য লাগবে ১০^১০০ বছরেরও বেশি—মহাবিশ্বের বয়সের চেয়ে কোটি কোটি গুণ!
ব্ল্যাক হোল নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা
- “ব্ল্যাক হোল শুধু গিলেই খায়!”: সত্য নয়! ব্ল্যাক হোলের চারপাশে ঘূর্ণায়মান গ্যাস-ধূলির চাকতি (অ্যাক্রিশন ডিস্ক) প্রচণ্ড ঘর্ষণে উত্তপ্ত হয়ে এক্স-রে বিকিরণ করে। কখনো কখনো তারা জেট স্ট্রিম নামে শক্তিশালী কণার ফোয়ারা ছুড়ে দেয়—যা আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত যায়! এগুলো নতুন নক্ষত্র তৈরিতে সাহায্য করে (Chandra X-ray Observatory)।
- “পৃথিবী কোনোদিন ব্ল্যাক হোলে গিলে খাবে!”: ভয়ের কিছু নেই! সবচেয়ে কাছের ব্ল্যাক হোলও হাজার আলোকবর্ষ দূরে। মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল ২৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরে—এতটাই দূরে যে এর মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীকে প্রভাবিতই করে না।
বাংলাদেশের গবেষণায় ব্ল্যাক হোল: জাহাঙ্গীরনগরে অধ্যাপক জাহিদ হাসানের চোখে
ঢাকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহিদ হাসান বলেন, “ব্ল্যাক হোলের রহস্য শুধু মহাকাশে নয়, কোয়ান্টাম জগতেও। আমরা ‘কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি’ তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছি—যা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে এক করতে পারে। এই তত্ত্ব বোঝা গেলেই হয়তো জানতে পারব, সিঙ্গুলারিটিতে আসলে কী ঘটে!” তিনি আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশি তরুণ গবেষকরা এখন LIGO (লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি) ডাটা বিশ্লেষণে যুক্ত হচ্ছেন, যা ব্ল্যাক হোল সংঘর্ষ শনাক্ত করে।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. ব্ল্যাক হোলের ভেতরে গেলে কী হবে?
ব্ল্যাক হোলের গভীরে “সিঙ্গুলারিটি” নামক এক বিন্দু আছে, যেখানে ঘনত্ব অসীম, পদার্থবিদ্যার সব সূত্র অচল। কেউ যদি ঘটনা দিগন্ত পার করেন (যা প্রায় অসম্ভব), তিনি স্প্যাগেটিফিকেশনের পর সিঙ্গুলারিটিতে পৌঁছে সম্পূর্ণ ধ্বংস হবেন। তবে কোনো তথ্যই ফিরে আসবে না বলে আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না।
২. পৃথিবীর কাছাকাছি কি কোনো ব্ল্যাক হোল আছে?
সবচেয়ে কাছের পরিচিত স্টেলার ব্ল্যাক হোল “Gaia BH1” ১,৫০০ আলোকবর্ষ দূরে—যা আমাদের সৌরজগতের জন্য নিরাপদ দূরত্ব। নাসার NEOWISE প্রজেক্ট নজরদারি চালিয়ে নিশ্চিত করেছে, পৃথিবীর ১০ আলোকবর্ষের মধ্যে কোনো ব্ল্যাক হোল নেই।
৩. ব্ল্যাক হোল কি সত্যিই কালো?
নিজে থেকে আলো বিকিরণ করে না বলে এরা “কালো”। তবে আশেপাশের অ্যাক্রিশন ডিস্কের তীব্র বিকিরণ এদের মহাবিশ্বের উজ্জ্বল বস্তুতে পরিণত করে। যেমন—কোয়াসার হলো সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল, যা ছায়াপথের চেয়েও উজ্জ্বল!
৪. হকিং বিকিরণ কি আজ পর্যন্ত দেখা গেছে?
না, কারণ এই বিকিরণ খুবই ক্ষীণ। একটি সূর্যের ভরের ব্ল্যাক হোলের তাপমাত্রা মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের (-২৭০°C) চেয়েও কম! বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে “শব্দের ব্ল্যাক হোল” (সোনিক ব্ল্যাক হোল) তৈরি করে এই বিকিরণের নীতিটি পরীক্ষা করেছেন।
৫. ব্ল্যাক হোল কি চিরকাল থাকে?
হকিং বিকিরণের কারণে ধীরে ধীরে ভর হারায়। তবে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল বাষ্পীভূত হতে সময় লাগবে মহাবিশ্বের বর্তমান বয়সের ১০ বিলিয়ন বিলিয়ন গুণ! অর্থাৎ, ব্ল্যাক হোলের আয়ু প্রায় “অনন্তকাল” বলাই যায়।
৬. কৃত্রিম ব্ল্যাক হোল কি সম্ভব?
বর্তমান প্রযুক্তিতে অসম্ভব। জেনেভার লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে (LHC) কিছু বিজ্ঞানী আশঙ্কা করেছিলেন, কিন্তু গাণিতিক বিশ্লেষণে প্রমাণিত—এখানে তৈরি শক্তি প্রকৃতির ব্ল্যাক হোল সৃষ্টির জন্য কোটি কোটি গুণ কম!
ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে অজানা তথ্য জানতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করি, এই মহাবিশ্ব কত অদ্ভুত আর অচেনা। প্রতিটি অজানা প্রশ্নের উত্তর যেন আরও গভীর প্রশ্নের জন্ম দেয়। কিন্তু এটাই তো বিজ্ঞানের সৌন্দর্য! আপনার দৈনন্দিন জীবনের চাপের মাঝে একটু সময় দিন—উপরে তাকান রাতের নিষ্পাপ আকাশের দিকে। ওই নক্ষত্রপুঞ্জের পেছনে লুকিয়ে আছে এমনই রহস্যময় গহ্বর, যারা আমাদের জানান দেয়: আমরা যতই জ্ঞানী হই না কেন, মহাবিশ্বের কাছে সবসময়েই শিখনার্থী। তাই আজই শুরু করুন আপনার মহাজাগতিক যাত্রা—একটি ডকুমেন্টারি দেখুন, নক্ষত্রমেলা দেখতে চলে যান, অথবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক লেকচারে যোগ দিন। কারণ, এই বিশ্বে বিস্ময়ের শেষ নেই!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।