মসজিদ হলো মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু

মসজিদ

ধর্ম ডেস্ক : আদর্শ সমাজ হলো পারস্পরিক সুসম্পর্ক, ভালোবাসা, হৃদ্যতা, ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন সুষ্ঠু, সুন্দর ও শান্তিময় সমাজব্যবস্থা। যেখানে থাকবে না অন্যায়, অবিচার, মিথ্যাচার, প্রতারণা, পরনিন্দা, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি, জুয়া, লটারি, মাদকাসক্তি, ধূমপান, অধিকারহরণ, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, ছিনতাই, সন্ত্রাস, মারামারি, হানাহানি, হত্যা, আত্মহত্যা, যৌতুক, নারী নির্যাতনসহ নৈতিকতাবিরোধী সামাজিক অপরাধ। অন্যদিকে মসজিদ হলো মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু এবং ইসলামের নিদর্শনাবলির অন্যতম স্থান। মহান আল্লাহর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় স্থান মসজিদ

mosque

মসজিদে মুসলমানরা দ্বিনের মূলভিত্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে থাকে। ইসলামের মূল ভিত্তি আদায়ের স্থান হিসেবে দ্বিনের অন্য কার্যাবলি সম্পাদনেও মসজিদের ভূমিকা প্রাসঙ্গিক ও অনস্বীকার্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ড মসজিদ থেকে পরিচালনা করেছেন। কালের পরিক্রমায়, বিশেষত বাংলাদেশে মসজিদ কেবল নামাজের স্থান হিসেবে বিবেচিত।

মুসলমানদের চরিত্র গঠন, দ্বিনি শিক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানবিক কর্মসূচিতে মসজিদের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। মসজিদ তার অতীত গৌরবে ফিরে এলে মসজিদই হতে পারে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের পরীক্ষিত উপাদান।
মসজিদের সঙ্গে মুমিনের সম্পর্ক : মসজিদের সঙ্গে আছে ঈমানের সম্পর্ক। ঈমানদারই মসজিদের আবাদ করে।

সে যেখানেই থাকুক—তার অন্তর থাকে মসজিদের সঙ্গে আবদ্ধ। মসজিদের সঙ্গে অন্তর সম্পৃক্ত থাকার অর্থ, সে নামাজের সময়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকে। সময়মতো মসজিদে গমন করে। নামাজের পর যখন মসজিদ থেকে বের হয় পরবর্তী নামাজের প্রতীক্ষায় থাকে। ফলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই সে স্বচ্ছন্দে মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে আদায় করতে সক্ষম হয়।

মসজিদের সঙ্গে এ রকম আত্মার সম্পর্ক যাদের, হাশরের ময়দানে তাদের ঠিকানা হবে আল্লাহর আরশের সুশীতল ছায়াতলে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যেদিন আল্লাহর (আরশের) ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ তাআলা সাত প্রকার মানুষকে সে ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। যাদের মধ্যে এক শ্রেণি হলো—যার অন্তরের সম্পর্ক সর্বদা মসজিদের সঙ্গে থাকে।
(বুখারি, হাদিস : ৬২৯)

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন তোমরা কাউকে অধিক পরিমাণে মসজিদে আসতে অভ্যস্ত দেখ তাহলে তার ঈমানদার হওয়ার সাক্ষি দাও। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারাই তো আল্লাহর মসজিদের আবাদ করে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও আখিরাতে।’ [সুরা : তাওবা, আয়াত : ১৮] (তিরমিজি, হাদিস : ৩০৯৩)

মসজিদ মুসল্লিদের কল্যাণকামী বানায় : মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা মুসলমানদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও সুসম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে মুসল্লিদের কল্যাণকামী করে তোলে। প্রতিদিনই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করতে মসজিদে যেতে হয়। নামাজের কাতারে ধনী-গরিব, আমির-ফকির, মালিক-শ্রমিকের কোনো ভেদাভেদ থাকে না। ভেদাভেদ থাকে না পেশা, বংশ বা অর্থনৈতিক তারতম্যের। সবাই এক কাতারে অভিন্ন মর্যাদার মানুষে পরিণত হয়। মহান রবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি মুসল্লিরা পারস্পরিক কুশলবিনিময় ও খোঁজখবর নেওয়ায় মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ফলে একে অন্যের কল্যাণকামী, সহযোগী ও নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে। এভাবে পারস্পরিক সুসম্পর্ক, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ অটুট হওয়ার মাধ্যমে মুসলমানরা প্রকৃত মুসলমানে পরিণত হয়। প্রকৃত মুসলমান হলো—যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলমানরা নিরাপদ থাকে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, প্রকৃত মুসলমান সে, যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। (বুখারি, অধ্যায় : ঈমান, অনুচ্ছেদ : প্রকৃত মুসলমান সে, যার হাত এবং মুখের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ, হাদিস : ১০)

মসজিদভিত্তিক সমাজ অপরাধ কমিয়ে দেয় : মসজিদ ইসলাম চর্চার মূল কেন্দ্র। রাসুল (সা.)-এর যুগে মসজিদে নববী ছিল দ্বিন শিক্ষার পাঠকক্ষ। একদল দরিদ্র সাহাবি, ইলমচর্চার জন্য মসজিদে নববীতে পড়ে থাকতেন। তাঁদের আসহাবে সুফফা বলা হয়। তাঁরা রাসুল (সা.)-এর মুখনিঃসৃত হাদিস সংরক্ষণ ও প্রচার করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) সুযোগ পেলেই মসজিদে এসে সাহাবিদের দ্বিন শেখাতেন। মসজিদভিত্তিক দ্বিনি জ্ঞানচর্চার ধারা অব্যাহত থাকলে মানুষ খুব সহজেই ইসলামের মৌলিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারে। আর কোনো সমাজে যত বেশি ইসলামী জ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পাবে, সেই সমাজ তত বেশি অপরাধ কমে যাবে। এ ছাড়া মসজিদভিত্তিক পাঠাগারের সংস্কৃতি চালু থাকলে মুসল্লিরা নামাজের পাশাপাশি কোরআন-হাদিসসহ ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধ হতে পারে। যে সমাজে মসজিদভিত্তিক জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি যত জোরালো হবে, সেই সমাজ তত বেশি আদর্শ সমাজে রূপান্তরিত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নানাভাবে মসজিদভিত্তিক ইলমচর্চার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.) থেকে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আমার এই মসজিদে একমাত্র দ্বিনের শিক্ষাগ্রহণ অথবা শিক্ষাদানের জন্য আসবে, তার মর্যাদা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে অংশগ্রহণকারীর মতো হবে।’

(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৭)

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর কোনো এক ঘর থেকে বের হয়ে এসে মসজিদে প্রবেশ করেন। তখন সেখানে দুটি সমাবেশ চলছিল। একটি সমাবেশে লোকজন কোরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর জিকিরে মশগুল ছিল এবং অন্য সমাবেশে লোকজন শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদানে রত ছিল। নবী (সা.) বলেন, ‘সবাই কল্যাণকর তৎপরতায় রত আছে। এই সমাবেশের লোকজন কোরআন তিলাওয়াত করছে এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করছে। তিনি চাইলে তাদের দান করতেও পারেন আবার চাইলে না-ও দিতে পারেন। অন্যদিকে এই সমাবেশের লোকেরা শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদানে রত আছে। আর আমি শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছি। অতঃপর তিনি তাদের সমাবেশে বসলেন।’

(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৯)

আমিরুল মুমিনিন ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মসজিদভিত্তিক দ্বিনি শিক্ষা কার্যক্রমকে মুসলিম জাতির জন্য কল্যাণকর হিসেবে উল্লেখ করে গুরুত্ব দিয়েছেন। (হায়াতুস সাহাবা : ৪/১৭০)

মসজিদভিত্তিক কর্মসূচি : আদর্শ সমাজ গঠনে মসজিদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ হওয়ার বিষয়টি মসজিদে নববী তথা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মসজিদ থেকে পাওয়া যায়। সেখানে সব ধরনের ধর্মীয়, মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। মসজিদভিত্তিক সমাজব্যস্থার মাধ্যমে নবী (সা.) একটি জাতিকে সোনার মানুষে পরিণত করেছেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে নামাজ-বন্দেগির পাশাপাশি (১) মসজিদভিত্তিক দ্বিনি শিক্ষা, (২) উচ্চতর ইসলামী গবেষণা, (৩) চিকিৎসাসেবা, (৪) সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি, (৫) ইসলামী লাইব্রেরি, (৬) শিশু-কিশোরদের জন্য ইসলামী সংস্কৃতি ও (৭) নানা ধরনের মানবিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মসজিদের শিষ্টাচার রক্ষা করতে হবে এবং ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালার আলোকে মসজিদ পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে।

বরগুনায় চাঁদাবাজদের সতর্ক করতে বিএনপির মাইকিং

পরিশেষে বলা যায়, একদিকে ঈমানের দাবিতে সবাইকে মসজিদমুখী হতে হবে। অন্যদিকে মসজিদের শিষ্টাচার অক্ষুণ্ন রেখে মসজিদকে ইবাদত, দ্বিনি শিক্ষা এবং মানবিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র হিসেবে আমানতদারীর সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। তাহলেই আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ সহজ ও ত্বরান্বিত হবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক : ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা