মরিয়ম চম্পা : মাদক এক অভিশাপ। আর এ অভিশাপের যন্ত্রণায় কাতর মাদকাসক্ত পরিবার। কি গ্রাম, কি শহর- সর্বত্র আজ মাদকের ছোবল। খাবলে খাচ্ছে একেকটি পরিবারকে। মাদকের থাবায় ধ্বংস হচ্ছে সমাজ। অতিষ্ঠ পিতা-মাতাদের অনেকেই সন্তানকে মাদকমুক্ত করতে ছুটে যান বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে। কেউ বা সন্তানকে তুলে দেন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। কিন্তু কোন পর্যায়ে গেলে নেয়া হয় সেখানে? কী লক্ষণ জানিয়ে দেয় তার সন্তান মাদকাসক্ত? আর কেনইবা মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার। তিনি বলেন, যুবকদের সাধারণত হতাশা থেকেই মাদকে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বেশি।
প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অনেকে মনের কষ্ট লাঘব হবে মনে করে মাদকাসক্ত হয়ে উঠে। কিন্তু একপর্যায়ে মাদকের প্রেমে পড়ে যায়। তখন দেখা যায় সে মাদক খাচ্ছে না মাদকই তাকে গিলে খাচ্ছে। তার মতে, সন্তানদের হঠাৎ আচরণগত সমস্যা দেখা দিলে পিতামাতা চিন্তিত হয়ে পড়েন। যেমন, অল্পতেই খুব রেগে যাওয়া। যখন তখন টাকা চাওয়া। অনেক সময় বাসা থেকে দামি জিনিসপত্র মিসিং হয়ে যাচ্ছে। বাসা থেকে টাকা-পয়সা হারিয়ে যাচ্ছে। বন্ধু-বান্ধব যাদের সঙ্গে মিশছে তারা একটু অন্যরকম। এমনটা দেখতে পেয়ে বাবা-মা সাধারণত সন্দেহ করে।
ডাক্তার মেখলা সরকার বলেন, কেউ মাদকাসক্ত হলে অনেকক্ষেত্রে মানসিক কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেমন- মাদকাসক্ত ব্যক্তি মনে করে গায়েবি ভাবে কেউ তার সঙ্গে কথা বলছেন। এ ছাড়া একা একা বিড়বিড় করে কথা বলেন। কেউ তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে বলে সন্দেহ করেন। অহেতুক রাগারাগি করেন। অথবা কর্মক্ষেত্রে কিংবা পড়ালেখার ক্ষেত্রে আগে যেভাবে নিয়মিত ছিল এখন আগের সেই আগ্রহ নেই। নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছে না। কিন্তু এটা হয়তো অনেক দিন পর বাবা-মা জানতে পারছে। এই ধরনের সমস্যা নিয়ে সন্তানদের আমাদের কাছে নিয়ে আসেন বাবা-মা।
এসব সন্তানরা প্রথমদিকে মাদক গ্রহণ করে এ ধরনের কোনো চক্রের সঙ্গে মিশে। এরপর ধীরে ধীরে সে নিজেও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। নারীদের ক্ষেত্রে সাধারণত ঘুমের ওষুধের আসক্তিটা বেশি দেখা যায়। আরেকটি হচ্ছে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা নতুন নতুন মাদকের স্বাদ নিতে চায়। তারা বন্ধু- বান্ধবদের সঙ্গে মাদক গ্রহণ করে। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা খুব কমনলি সিসা-গাঁজা, ইয়াবা নিয়ে থাকে। নারীদের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা এটা খুব বেশি ধরতে পারে না। মেয়েদের মধ্যে প্যাথেডিন ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। সাধারণত চিকিৎসক-নার্স এদের মধ্যে প্যাথেডিন ব্যবহারের বিষয়টি বেশি থাকে। যেহেতু এটা তাদের কাছে সহজলভ্য। এ ছাড়া তারা ঘুমের ওষুধ বেশি খায়। এ ধরনের নারীরা যদি সাংসারিক ও মানসিক কোনো চাপে থাকে তখন একটু ঘুমের ওষুধ খায়। এতে অনেক ফ্রেশ লাগে। তখন মনে করে ঘুমের ওষুধটিই তার ভালো থাকার একমাত্র উপায়। একটি-দুটি করে এভাবে ঘুমের ওষুধটা বাড়ে।
ডাক্তার মেঘলা সরকার বলেন, আমাদের কাছে এ ধরনের মাদকাসক্ত চিকিৎসক-শিক্ষক অনেক বেশি আসেন। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে তাদের ক্যারিয়ার লাইফটা অনেক স্ট্রেসফুল। অনেক পড়ালেখা করতে হয়। সহজে পাস করা যায় না। সবকিছু ছেড়ে পড়াশোনা করছে। তারপরও সে পরীক্ষায় বারবার খারাপ করছে। এই চাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে তারা মাদক ব্যবহার করে। চিকিৎসকদের কাছে এটা সহজলভ্য। খুব সহজেই পেতে পারেন। আরও কিছু ধরনের যেমন ব্যথার ওষুধ, প্যাথেডিন, ঘুমের ওষুধ যেগুলোর তারা অপব্যবহার করেন। অস্থায়ীভাবে এক ধরনের শান্তি অনুভব করেন। তখন একটির পর একটি ওষুধ এক পর্যায়ে পরীক্ষার আগে একসঙ্গে অনেকগুলো খেয়ে ফেলে। অনেকে পাঁচ বছর পড়াশোনা করে পাস করতে পারছে না। জুনিয়ররা পাস করে বেরিয়ে যাচ্ছে। তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের এ্যভয়েডিং বিহেইভিয়র থাকে। ঘুমের ওষুধ খেয়ে উদ্বিগ্নটা দূর করে। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের যে চাপ রয়েছে সেটা লাঘবে মাদক নিয়ে থাকে। যারা অপারেশন থিয়েটারে কাজ করে তাদের মধ্যে প্যাথেডিন সহজলভ্য। আবার দেখা যায় সংসার জীবনে বিভিন্ন ধরনের ক্রাইসিস থাকে। এ ক্রাইসিস থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে। তখনই দুশ্চিন্তা কমানোর মাধ্যম হিসেবে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। মাদকাসক্তের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সহজলভ্যতা।
বর্তমান সময়ে ছেলেমেয়েরা কী কী ধরনের সমস্যা নিয়ে আসেন জানতে চাইলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেখলা সরকার বলেন, বেশির ভাগই হতাশা এবং প্রেমঘটিত কারণ। পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া। ভুল বোঝাবুঝি। বাবা-মায়ের কাছে মোবাইল চেয়ে পায়নি। পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নিচ্ছে না। কোনো কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে না। বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকে। নিজের অজান্তেই দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকে। ক্লাসে মনোযোগী হতে পারছে না। পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করেছে। বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপ নিয়ে আমাদের কাছে আসে। আবার চাকরির জন্য যুদ্ধ করতে করতে হাঁফিয়ে ওঠা যুবক-যুবতীরা মাদককে সঙ্গী করে নেয়। এ ধরনের অনেক রোগী আসেন। তাদের ডিপ্রেশনের মাত্রাটা নির্ধারণের মাধ্যমে খুঁজে বের করা হয় তার সমস্যাটি কোথায়? সেটা খুঁজে বের করে আমরা চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে সাধারণত ওষুধ এবং কাউন্সেলিং দুটিই করানো হয়। যদি খুব উচ্চ মাত্রায় থাকে তাহলে তখন মেডিকেশন লাগে। অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এর সমাধান করা হয়। মানুষের জীবনে চাপ থাকবেই। বেকারত্ব থাকবে। নানান যুদ্ধ-বিগ্রহ, অপ্রাপ্তি থাকবে। এটাই আমাদের জীবন। কাজেই এটাকে ইতিবাচকভাবে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।