জুমবাংলা ডেস্ক : ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা’, ‘বিনা ভোট’ ও ‘ডামি ভোটে’ কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে টানা চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আফজাল হোসেন। ক্ষমতার পরশ পাথর হাতে পেয়ে শুরু করেন সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট। অবৈধ সম্পদ অর্জনে তিনি বেছে নেন হুন্ডির কারবারসহ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঘুষ, অবৈধভাবে নদীর বালু উত্তোলন, জমি দখল ইত্যাদি। দেশের বাইরে বিদেশেও বিপুল অর্থপাচার করেছেন তিনি।
জাতীয় দৈনিক কালের কন্ঠের আজকের সংখ্যায় প্রকাশিত মো. জাহিদুল ইসলামের করা বিশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় আছে ফ্ল্যাট, বাড়ি ও গাড়ি। আফজালের সম্পদের পাহাড়ে চাপা পড়েছে দেশের খেটে খাওয়া কোটি মানুষের ঘাম।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একের পর এক রাঘববোয়াল ধরা পড়লেও এখনো অধরা আফজাল। এবার তাঁকে নিয়ে একযোগে অনুসন্ধানে নামছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যাঁরা সুবিধাভোগী ও দুর্নীতিবাজ ছিলেন, তাঁদের অনেকে এখনো আড়ালে। সেই তালিকাও বেশ দীর্ঘ। তবে ধীরে ধীরে তাঁদের সবার বিরুদ্ধে করা হবে অনুসন্ধান।
আফজালের নামে-বেনামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ফ্ল্যাট, শেয়ার, একাধিক গাড়ি ও ব্যাংক আমানতের তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে বাস্তবতা এবং অনিয়ম পাওয়া গেলে ধরন অনুযায়ী এখতিয়ারভুক্ত সংস্থা পদক্ষেপ নেবে।
বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলাপকালে আফজালের বিষয়ে অনুসন্ধানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের আয়কর অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাবেক এই সংসদ সদস্যের প্রকৃত আয় ও সম্পদের সঙ্গে তাঁর কর নথিতে উল্লেখ করা আয় ও সম্পদের বিস্তর ফারাক রয়েছে। তিনি বিপুল সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।
হুন্ডিতে টাকা পাচার করে বিদেশে সম্পদ
দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশে তিনি গড়ে তোলেন হুন্ডির রমরমা ব্যবসা। জানা গেছে, প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে দেশে নিজের এজেন্টের মাধ্যমে প্রবাসীদের পরিবারের কাছে খুব সহজে টাকা পাঠিয়ে দিত আফজালের হুন্ডি সিন্ডিকেট। এতে বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার। অন্যদিকে বিদেশি মুদ্রা দিয়ে নিজের আখের গুছিয়েছেন আফজাল। তিনি কত টাকা এভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, আফজাল ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে আফজালের নামে সিঙ্গাপুরের অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি-গাড়ি ও মালয়েশিয়ায় একাধিক বাড়ি-গাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে আরো তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন গোয়েন্দারা।
ফুটপাতে ফেরি করা জুতা এখন অনেক দামি
আশির দশকে আফজালের পিতা আবু বক্কর সিদ্দিক গুলিস্তানের ফুটপাতে ঝাঁকায় করে জুতা বিক্রি করতেন। তখন তাঁর সঙ্গে ফুটপাতে জুতা বিক্রিতে সহায়তা করতেন আফজাল। তবে কালের বিবর্তনে মানুষ ঠকিয়ে এখন ‘আফজাল সুজ’-এর মালিক তিনি। গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে এখন ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের জুতার দোকানের মালিক। এ ছাড়া দেশের অন্তত ৩০টি স্থানে রয়েছে তাঁর জুতার শো-রুম। সাভারের আশুলিয়ায় তাঁর আছে শতকোটি টাকার জুতার কারখানা। এ ছাড়া রাজধানীর বঙ্গবাজার ও বঙ্গবাজারের এনেক্স ভবন মার্কেট, গুলিস্তানের ঢাকা ট্রেড সেন্টার ও জাকের মার্কেটে আড়াই শতাধিক দোকানের মালিক তিনি।
দখলের রাজত্ব
নিজের নির্বাচনী এলাকায় মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের বদলে মানুষের ওপর অন্যায়-অনাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে তিনি করেছেন দখলের রাজস্ব। তার দৃষ্টিসীমার বাইরে ছিল না সরকারি খাসজমিও। বাজিতপুর উপজেলায় সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জমি আত্মসাৎ করে ওই জমি দখলে নিয়ে মার্কেট নির্মাণ, বেঙ্গলা নদী দখল, নির্বাচনী এলাকার অনেক বাজারে নামকাওয়াস্তে ইজারা নির্ধারণ করে দখল, আত্মীয়-স্বজনদের ঠিকাদারির দায়িত্ব দিয়ে মানহীন কাজ, বিল-হাওর নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার, বেঙ্গলা চরবাদা, কইয়া খায়রা, মাইজচর, বাহেরবালী, হুমাইপুর, ঘোড়াউত্রা নদী জলমহাল থেকে অর্থ লুট, বাজিতপুরের নোয়াপাড়া গ্রামে ৭০ শতাংশ দখল করা জমিতে বাড়ি নির্মাণ, বসন্তপুর মৌজায় সিনামহলের সামনে সরকারি জমিতে পাঁচটি দোকান, দড়িঘাগটিয়া মৌজায় সিনামহলের প্রায় ১৫ শতাংশ জমি, বাজিতপুর বাজারে নাপিত মহলের পুকুর, বাজিতপুর পৌরসভার দড়িঘাগটিয়া মৌজায় প্রায় দুই একর জমি দখল এবং বসন্তপুর মৌজায় প্রায় ২৫ শতাংশ জমিতে তিনতলা মার্কেট, পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের দক্ষিণ পাশে প্রায় দুই একর জমি, নান্দিনা আলিয়াবাদ মৌজায় ব্যাপারীপাড়ার প্রায় ২০ শতাংশ জমি, তাতলচর মৌজায় বাজিতপুর দিলালপুর রাস্তার পশ্চিম পাশে প্রায় ৬০ শতাংশ জমি, গাজীরচর মৌজায় প্রায় আট একর জমি, শশেরদীঘি মৌজায় প্রায় ১০ একর ধানি জমি, বাজিতপুর মৌজায় মতুরাপুর গ্রামের পূব পাশে ২০ শতাংশ জমি, দীঘিরপাড় মৌজায় মসজিদের ফেরিঘাটের পাটুলীর উত্তর পাশে ২০ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়ে দোকান নির্মাণ করেছেন তিনি।
দোকান বরাদ্দে নয়ছয়, চাঁদাবাজি
এমপি থাকা অবস্থায় আফজাল সিন্ডিকেট করে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে দোকান বরাদ্দের নামে গত ১৫ বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত কয়েক শ কোটি টাকা। তাঁর এই কাজে যোগসাজশ ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদেরও। অবৈধ দোকান মালিকদের বৈধতার নামে মেরে দিয়েছেন টাকা। পরে তা আর কখনোই বৈধতা পায়নি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে চালাতেন প্রকাশ্য চাঁদাবাজি। অনুমোদিত দোকানের সংখ্যা বাড়িয়ে নিজেদের লোকজনকে দোকান মালিক বানিয়েছেন। সেই ৫৯১ জন দোকান মালিক সিটি করপোরেশনে এক লাখ টাকা দিয়ে দোকান মালিকের স্বীকৃতি পেলেও পরে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকায় তা বিক্রি করা হয়।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ ট্রেড সেন্টারে বৈধ দোকানের সংখ্যা ছিল এক হাজার ২৪৫টি। এর বাইরে আন্ডারগ্রাউন্ড, লিফটসহ মার্কেটের বিভিন্ন স্থানে নকশাবহির্ভূত ৭০০ দোকান বানায় আফজাল সিন্ডিকেট। তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনকে হাত করে দোকানপ্রতি ৭ থেকে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এখানে কোটি টাকার বাণিজ্য করা হয়েছে। তবে দোকানের মালিকরা টাকা দিলেও মালিকানার কোনো বৈধ কাগজপত্র পাননি।
বন্ড লাইসেন্স পেতে ঘুষ
গুলিস্তান হকার্স মার্কেটের আওয়ামী লীগ সভাপতি নাজমুল হোসেনের সঙ্গে যৌথভাবে ‘ফেমাস সুজ লিমিটেড’ নামে আশুলিয়ার দোসাইদে জুতা উৎপাদন কারখানা রয়েছে আফজালের। যেখান থেকে ঢাকার গুলিস্তানসহ সারা দেশে জুতা সরবরাহ করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতে বন্ড সুবিধায় জুতা তৈরির কাঁচামাল আমদানি নিয়ে ভাবেননি তিনি। তখন দখল-চাঁদাবাজি করে তাঁর প্রচুর আয় হতো। কিন্তু এখন সেই আয়ে ধস নামায় বন্ড সুবিধা পেতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। বন্ড লাইসেন্স পেলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অসম বাণিজ্যিক ব্যবধান তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ আছে, কাস্টমস কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করে ফেমাস সুজের নামে বন্ড লাইসেন্স নিতে চান আফজাল। তবে বন্ড লাইসেন্স পাওয়ায় প্রধান শর্ত শতভাগ রপ্তানি। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি দেশে জুতা সরবরাহ করে।
নির্বাচনী হলফনামায়ও কারিশমা
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, ২০১৮ সালের বিনা ভোটের নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনেও জয়ী হন তিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের হলফনামায় তিনি নগদ টাকার পরিমাণ উল্লেখ করেছিলেন ৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনী হলফনামায় তাঁর নগদ টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছিল চার কোটি ৬৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। নির্বাচনী হলফনামায় একাধিক ফৌজদারি মামলার তথ্যও গোপন করেছিলেন তিনি।
নামে-বেনামে যত সম্পদ
৬/৪, সেগুনবাগিচায় হাসিনুর গ্রিন হাউসে দুটি ফ্ল্যাট, ৯৫, আগামসিহ লেনে পাঁচতলা ভবন, লালমাটিয়ায় ফায়ার ব্রিগেডের পেছনে স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট ও বংশালে সাততলাবিশিষ্ট দুটি বাড়ি। দক্ষিণ বনশ্রীতে সাততলা বাড়ি, উত্তরায় সাত কাঠার প্লট, কেরানীগঞ্জ ব্রিজের ঢালে ছয় কাঠা জমির ওপর তৈরি বাড়ি, আফতাবনগরের সি-ব্লকে, রাজউক ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের ১৩/এ রোডে, পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার একটি করে প্লট, সিদ্দিকবাজারে ছয়তলার বাড়ি, দক্ষিণ বনশ্রীতে ছেলে সাঈদ হোসেনের নামে পাঁচতলা বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি।
সম্পদের নেশায় নির্বাচনী এলাকায়ও গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর পৌরসভা এলাকায় ২০ শতাংশ জমি দখল করে সাততলা মার্কেট, বাজিতপুরে নিজের গ্রাম দিলালপুরে তিনতলার সুরম্য অট্টালিকা, বাজিতপুর পৌরসভা ডাকবাংলোর সামনে দুই মৌজায় ২৭৫ শতাংশ জমি, এলাকায় শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য দুই তলা পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি।
সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে এমপি আফজাল হোসেনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই তিনি গাঢাকা দিয়েছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।