জুমবাংলা ডেস্ক : ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের নামে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা নিয়ে বন্ধ হয়েছে এমটিএফই নামক একটি প্রতিষ্ঠান। উল্টো গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টে ব্যালেন্স দেখাচ্ছে ঋণাত্মক। দুবাইভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পঞ্জি মডেলে ব্যবসা করতো। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিনিয়োগকারী ছিল। তবে এই ১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থই বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের বলে অভিমত সাইবার বিশ্লেষকদের। মূলত ‘এমটিএফই’ অ্যাপটি বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রাম সবখানেই ছড়িয়ে পড়েছিল।
ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে অনলাইনে বিনিয়োগ করে কম সময়ে অধিক মুনাফার মাধ্যমে লাভবান হওয়ার অন্যতম প্লাটফর্মের মধ্যে রিপটন কয়েন, সিজি ট্রেড ও এমটিএফই অন্যতম অ্যাপ। বাংলাদেশে এগুলোর কোনটিরই বৈধ কোন নিজস্ব অফিস নেই। আছে শুধু এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি। এসব প্রতিনিধি কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া বড় একটি নির্দিষ্ট মুনাফার নিয়ে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের কম সময়ে অধিক মুনাফার আকর্ষণীয় লোভ দেখায়। এরপর কোম্পানিতে নিজস্ব অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে অর্থ বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে আসছে।
তারই ধারাবাহিকতায় অনলাইনভিত্তিক ‘এমটিএফই’ নামে একটি অ্যাপের মাধ্যমে হাজার থেকে লাখ টাকা বিনিয়োগ করে দ্রুত অধিক মুনাফার আয় করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। শহর কিংবা গ্রাম- যেখানে প্রতিদিন সাধারণ মানুষ টাকা বিনিয়োগ করে দ্রুত অধিক মুনাফার আয় করার স্বপ্ন দেখছিলেন।
সম্প্রতি এই অভিনব পদ্ধতির ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ হারানোর বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। নিঃস্ব হওয়ার পর কে কত অর্থ কীভাবে বিনিয়োগ করেছিলেন তার সবকিছুই বেরিয়ে আসছে। বিনিয়োগের উপযুক্ত কোন কাগজপত্র না থাকায় বর্তমানে অ্যাপে বিনিয়োগকারী সবারই মাথায় হাত। হঠাৎ করে এমটিএফই অ্যাপ থেকে বিনিয়োগকারীর নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে ডলারে পরিণত করা টাকাও উধাও হয়ে গেছে।
বর্তমানে বিনিয়োগকারী প্রতিটি অ্যাকাউন্ট থেকে ওই অ্যাপটি আরও অর্থ পাবে বলে উল্টো ঋণের বোঝা ধরিয়ে দিয়েছে। অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন পরিমাণ অর্থ উল্লেখ করে তার আগে বিয়োগ (মাইনাস) চিহ্ন দিয়ে রেখেছে। এতে করে যারা দ্রুত আয় করার স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা এখন সর্বশান্ত হয়ে চোখে সরিষার ফুল দেখছেন।
তবে বিনিয়োগকারীরা পথে বসলেও কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন এলাকাভিত্তিক ওই কোম্পানির সিইও নামক কতিপয় ব্যক্তি, যাদের দেখানো প্রলোভনে পড়ে সকল শ্রেণির মানুষ অধিক লাভের স্বপ্ন বুনে এই অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছিলেন।
জানা গেছে, বিদেশি অ্যাপ মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ (এমটিএফই) একটি অনলাইন ট্রেডিংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। অ্যাপটি চালু থাকা অবস্থায় অ্যাকাউন্ট চালু করার জন্য সর্বনিম্ন ২৬ ডলারের সমপরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে হতো। সেই টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন পাওয়া যাবে শতকরা হিসেবে নির্দিষ্ট মুনাফা। যার অ্যাকাউন্ট যত বেশি অর্থ থাকবে, সে তত বেশি মুনাফা পাবেন। এমন সব লোভনীয় সময়পযোগী প্রলোভন দেখিয়ে প্রচারণা করছিল কিছু যুবক। আর এতেই হুমড়ি খেয়ে অ্যাপটিতে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
কোন কাজ ছাড়াই মুনাফা পাওয়ার আশায় কেউ জমি বন্ধক রেখে, কেউবা জমানো টাকা, কেউবা বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ ও ধারদেনা করে লাখ লাখ টাকা এমটিএফই অ্যাপের কয়েজন সিইও নামক ব্যক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছিলেন। নিযুক্ত সিইওরা কাউকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিলে কোম্পানি থেকে তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন দেওয়া হতো। পাশাপাশি তার মাধ্যমে যতগুলো ব্যক্তি বিনিয়োগ করবেন তাদের সবার কাছ থেকে ওই সিইও একটি নির্দিষ্ট হারে মুনাফা পেতেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, এই অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খোলার পর বিনোযোগ করা টাকার ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা হতো। হঠাৎ করেই অ্যাকাউন্ট থেকে তারা টাকা উঠাতে গিয়ে দেখেন অ্যাকাউন্টে কোন ডলার নেই। উল্টো তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে কোম্পানি আরও অর্থ পাবে বলে মাইনাস চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। প্রতারণা করে তাদের টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে এমটিএফই। লাভের আশায় এসে উল্টো ঋণের বোঝাও ধরিয়ে দিয়েছে তারা।
এতে করে যারা দ্রুত আয় করার স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা এখন সর্বশান্ত হয়ে পথে বসেছে। তবে প্রথম দিকে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন এবং যারা চতুর- তাদের অনেকেই মুনাফা তুলে নিয়েছেন। আর যারা বেশি মুনাফার আশায় ছিলেন বা প্রাপ্ত মুনাফার অর্থ তুলে নিতে পারেননি, তারা সর্বশান্ত হয়েছেন।
রাণীনগর উপজেলার বাজার এলাকার নিশাদ ইসলাম আকাশ জানান, তিনি মূলত অনলাইনে কাজ করেন। এই বিষয়টি জানার পর সম্প্রতি ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন এমটিএফইতে। তার দেখাদেখি তার আরও চারজন সহকর্মী একই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেন। অন্য সবার মতো তাদের অর্থও হাতিয়ে নিয়েছে ওই কোম্পানি।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে নওগাঁ শহরের এক ভুক্তভোগী বলেন, একটু লাভের আশায় ধার করে ১ লাখ টাকা ইনভেস্ট করেছিলাম। কিছুদিন তারা ওই টাকার উপর লাভও দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কিছুদিন আগে অ্যাপটি থেকে টাকা উঠানো বন্ধ করে দেয়। এখন শুনছি তারা টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। এখন ধারের টাকা পরিশোধ করবো কীভাবে সেই চিন্তায় আছি।
তিনি আরও বলেন, লাভের আশায় এসে উল্টো ঋণের বোঝা ধরিয়ে দিয়েছে এমটিএফই। সব ডলার কেটে নিয়ে উল্টো একাউন্টে বিশাল অংকের মাইনাস ডলার ধরিয়ে দিয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা পরিশোধ করতে বলেছে। ২৪ ঘণ্টা পর আজকে আবার তাদের অ্যাপে নোটিশ দিচ্ছে যে, ‘২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে আপনি ঋণ পরিশোধ করেননি। আপনাকে আরও ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়া হলো। এর মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করলে আপনাকে আইনি নোটিশ পাঠানো হবে। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের ভুক্তভোগী আলামিন বলেন, একজন এসে বললো এমটিএফই টাকা ইনভেস্ট করলে নাকি দিগুণ আয় করা যাবে। পরে একটি এনজিও থেকে ৬০ হাজার টাকা তুলে সেখানে বিনিয়োগ করি। এখন ওই অ্যাপে আর প্রবেশ করা যাচ্ছে না। টাকাগুলো না পেলে এনজিওর টাকা পরিশোধ করবো কীভাবে- কোন কিছু বুঝতে পারছি না।
রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আরেক ভুক্তভোগী নাঈম বলেন, আমি অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাই। একজনের পাল্লায় পড়ে লাভের আশায় কিছুদিন আগেই এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ২৫ হাজার টাকা ইনভেস্ট করেছিলাম। কিন্তু তারা টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল। এখন কীভাবে কী করবো কোন কিছুই বুঝতে পারছি না।
মহাদেবপুর উপজেলাতে লতিফুল লিটন নামে এমটিএফই অ্যাপের সিইও হিসেবে পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তির খবর পাওয়া গেলে তার সঙ্গে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি জানান, এমটিএফই অ্যাপের কোন সিইও তিনি ছিলেন না। তিনি তার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে নিজের মতো করে এমটিএফই অ্যাপে কাজ করতেন বলে জানান।
এমটিএফই অ্যাপসের সিইও হিসেবে পরিচয় দেওয়া রাণীনগর উপজেলার উত্তর রাজাপুর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে রাব্বী জানান, প্রথমে মহাদেবপুর উপজেলার লতিফুল নামে একজন তাকে লিংক দিয়ে সেখানে কাজ করার জন্য বলেন। পরে তিনি সেখানে বিনোয়োগ করেন এবং বেশ কয়েকজনকে উদ্বুদ্ধ করেন। তবে কাউকে কোন প্রলোভন দেখানো হয়নি বলে দাবি তার।
রাণীনগর উপজেলার আরেক অ্যাপভিত্তিক অনলাইন ব্যবসার ডিলার রানা ট্রের্ডাসের মালিক রানা জানান, তিনি এমটিএফই নয়, অন্য অনলাইন অ্যাপভিত্তিক কিছু আর্ন্তজাতিক মানের কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত আছেন। তিনি উপযুক্ত কাগজপত্রের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অর্থ বিনিয়োগ করাচ্ছেন। যদি ভবিষ্যতে তার কোম্পানিগুলো উধাও হয়ে যায় তাহলে তিনি বিনিয়োগকারীদের অর্থ নিজেই ফেরত দেবেন বলে জানান।
রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হুসেইন বলেন, ভুক্তভোগীরা লিখিতভাবে বিষয়টি জানালে তদন্ত সাপেক্ষে এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গাজিউর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে এখনও কেউ কোন অভিযাগ করেনি। কোন ভুক্তভোগী অভিয়োগ করলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।