ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ : ঢাকা শহরকে যানজট ও জলাবদ্ধতা নিরসন করে একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার জন্য গত ৬৫ বছরে একাধিক মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়। তৈরি করা হয় বিভিন্ন মাস্টারপ্ল্যান। কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই কার্যকর করা যায়নি রাজধানী এই ঢাকায়। সর্বশেষ ঢাকাকে কার্যকরী ও বাসযোগ্য মহানগরী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রণয়ন করা হয়েছে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা। ২০২২ সাল থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা হয়েছে।
এই মহাপরিকল্পনাটি কার্যকরের জন্য ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর সরকারিভাবে প্রথম গেজেট প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন মহলের চাপে ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত গেজেট প্রকাশ করা হয়। এই সংশোধিত ড্যাপ গেজেটভুক্ত হওয়ায় ২০১০ সালের ২২ জুন জারি করা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মাস্টারপ্ল্যানের প্রজ্ঞাপন রহিত করা হয়েছে। তবে ওই মাস্টারপ্ল্যানের অধীনে বাস্তবায়িত কাজ বা গৃহীত সিদ্ধান্ত বৈধ বলে বিবেচিত হয়। রাজউকের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত ওই মাস্টারপ্ল্যানের এখতিয়ারাধীন এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার।
কিন্তু এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতপার্থক্য নিরসন হয়নি এখনো। সম্প্রতি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব)সহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ড্যাপ (২০২২-৩৫) বাতিল ও স্থগিতের দাবি জানানো হয়। অপরদিকে স্বার্থান্বেষী মহলের কথায় ড্যাপ বাতিল বা স্থগিত করা হলে তা এই শহরের জন্য আত্মঘাতী হবে বলে জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাই পরিকল্পিত ও টেকসই ঢাকা গড়ার জন্য ড্যাপ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সসহ (বিআইপি) বিভিন্ন সংগঠনের।
তবে যেকোনো মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ৩ বছর পর পর তা রিভিউ বা সংশোধন করার নিয়ম রয়েছে। এক্ষেত্রে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান-(২০২২-৩৫) সংশোধনের জন্য টেকনিক্যাল কমিটি কাজ করছে বলে রাজউকের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এ বিষয়ে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক ও রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকাকে কার্যকরী ও বাসযোগ্য মহানগরী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রণয়ন করা হয়েছে ড্যাপ বা ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা। ড্যাপে ব্লকভিত্তিক আবাসন পদ্ধতিকে বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। এই মহাপরিকল্পনায় কিছু জায়গা উন্মুক্ত স্থান রাখার শর্তে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে বেশি উচ্চতার ইমারত নির্মাণ করার সুযোগ রয়েছে। ভবনের এই উচ্চতা নিয়ে বিভিন্ন মহল ড্যাপের রিরোধিতা করছে। তবে ড্যাপের সংশোধনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রাজউকের উচ্চপর্যায়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটি কাজ করছে। এই কমিটির আহ্বায়ক হলেন রাজউক চেয়ারম্যান। এ ছাড়া একটি মহাপরিকল্পনা নেওয়ার তিন বছরের পর তা রিভিউ করার সুযোগ থাকে। সেক্ষেত্রে সবার মতামত নিয়ে ড্যাপের রিভিউ হতে পারে।’ তাই বলে ড্যাপ বাতিল ও স্থগিত করা ঠিক হবে না বলে জানান তিনি।
ঢাকার ৬৫ বছরের মহাপরিকল্পনা : ঢাকা শহরকে একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার জন্য গত ৬৫ বছরে একাধিক মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তৈরি করা হয় বিভিন্ন মাস্টারপ্ল্যান। কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই কার্যকর করা যায়নি রাজধানী এই ঢাকায়। সমন্বয়হীনতা ও গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না এসব মহাপরিকল্পনা। প্ল্যান নেওয়ার পর আবার সংশোধন হয়। যেকোনো পরিকল্পিত নগরায়নে দু’টি বিষয় মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। একটি হলো ভূমি ব্যবহার ও অপরটি হলো পরিবহন ব্যবস্থা। কিন্তু আমাদের দেশে ভূমি ও পরিবহন ব্যবস্থা সবচেয়ে বিশৃঙ্খল। তাই কোনো মহাপরিকল্পনা কার্যকর হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
ব্রিটিশ আমলে ঢাকা নিয়ে ১৯১৭ সালে নগর-পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটা বিশদ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সেটা ছিল বিখ্যাত ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতাকে ধরেই এই নগরের বিশদ পরিকল্পনাগুলো হয়। ঢাকার আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এর চারপাশে চারটি নদী ঘিরে আছে। এ ছাড়া ঢাকায় প্রায় ৫০টির মতো প্রাকৃতিক খাল ছিল। এই খালগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত এবং পানি জমা হতো না। শহর বড় হওয়া শুরু করলে ব্রিটিশরা ১৯১৭ সালে নগর-পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটা বিশদ পরিকল্পনা করায়। সেটা ছিল বিখ্যাত ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’ পরিচিত।
পরে ১৯৫৯ সালে ‘ঢাকা মাস্টার প্ল্যান’ নামের আরেকটি পরিকল্পনা করা হয়। কমনওয়েলথের কলম্বো প্ল্যানের অধীনে ১৯৫৮ সালে ব্রিটিশ সংস্থা মিনোপ্রিও, স্পেন্সলি এবং ম্যাকফারলেন এই পরিকল্পনা তৈরি করে। স্বাধীনতার পর ১৯৮১ সালে প্ল্যানিং কমিশন প্রথম ঢাকা মেট্রোপলিটন ইনটিগ্রেটেড প্ল্যান (ডিএমএআইইউডিপি) তৈরি করে।
পরবর্তীতে তা বাস্তবায়ন করা হয় না। এরপর ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (ডিএমডিপি) স্ট্রাকচার প্ল্যান ১৯৯৫-২০১৫ এবং ডিএমডিপি আরবান এরিয়া প্ল্যান ১৯৯৫-২০০৫ তৈরি করা হয়। ১৯৯৭ সালে এটা পাস করা। পরিবর্তীতে তা আর কার্যকর করা হয়নি। ২০১০ সালে তৈরি করা হয় ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) ২০১০-২০১৫ সাল। পরিবর্তীতে আবার ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (২০১৬-২০৩৫) তৈরি করা হয়। কিন্তু তাও কার্যকর করা হয়নি। সর্বশেষ ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-২০৩৫) তৈরি করা হয়। সরকারিভাবে এই মহাপরিকল্পনা গেজেট আকারে প্রকাশ করতে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে ৭ বছর। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ এর কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের মার্চে এবং সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল মাত্র ২ বছরের।
এ ছাড়া ঢাকার শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে রিভাইস স্ট্র্যাটেজি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি) নামে একটি মহাপরিকল্পনা রয়েছে। দেশী-বিদেশী পরামর্শকদের সমন্বয়ে এটি তৈরি হয় ২০১৬ সালে। রাজধানীর যানজট ও ঢাকার আশপাশ জেলার পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নে ২০০৪ সালে প্রণয়ন করা এই পরিকল্পনা। ২০২৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয় অভাব ও অপরিকল্পিত ভাবে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের কারণে বাস্তবায়ন করা যায়নি এসটিপি। তাই ২০১৬ সালে নতুন করে প্রণয়ন করা হয়েছে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি)। চারধাপে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। এতে রাজধানী যানজট নিরসন ও ঢাকার আশপাশ জেলার পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নে ৫টি ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) বা মেট্রোরেল ও দুইটি বাস র্যাপিট ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু তাও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানায়।
এ বিষয়ে পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানান, ঢাকা নিয়ে ১৯১৭ সালে নগর-পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটা বিশদ পরিকল্পনা করে ব্রিটিশরা। ওই পরিকল্পনায় গেডিস সাহেব বৃষ্টির পানি যেন প্রবাহিত হয়ে চলে যেতে পারে, সে জন্য নদী, খাল ও জলাধারগুলোকে সংস্কার ও সংরক্ষণ করার কথা বলেছিলেন। ওটা ঠিক এক থেকে দেড়শ’ বছর আগের কথা। কিন্তু এখনো আমাদের এসব নিয়েই কথা বলতে হচ্ছে। পরবর্তীতে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) করা হয়েছিল। কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি।
মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দরকার নগর সরকার : ঢাকার কালুনগর খাল, মান্ডা খাল দখল করে আবাসন ভবন গড়ে উঠেছে, গত ৫৩ বছরে জলাধারগুলো রক্ষা করা হয়নি। ড্যাপে ৮ তলার বেশি ভবন করা যাবে না, এটিকে ভুল মন্তব্য বলে আখ্যা দেন। এ ছাড়াও স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও নগর উন্নয়ন আইন নেই, যা খুবই প্রয়োজন। নগর সরকার ও প্রধান সমন্বয় কর্তৃপক্ষ না থাকার কারণে এক একটি সংস্থা নিজেদের মনমতো পরিকল্পনা তৈরি করছে আর পরিকল্পনা কমিশন কোনো যাচাই না করে তা পাস করছে। ফলে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিআইপির সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ বলেন, ‘ড্যাপকে স্বার্থান্বেষী মহলের রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর পরিকল্পনা পূর্বেও ছিল এখনো আছে। বসবাস উপযোগিতার বিবেচনায় ঢাকার অবস্থান তলানিতে। এ অবস্থায় স্বার্থান্বেষী মহলের কথায় ড্যাপ বাতিল বা স্থগিত করা হলে তা এই শহরের জন্য আত্মঘাতী হবে। ড্যাপের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো পরিমার্জন করা যেতে পারে। এ ছাড়া যেকোনো পরিকল্পিত নগরে ভূমি ব্যবহার ও সড়ক অবকাঠামো যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় করতে হয়।
উন্নত বিশ্বে এই দু’টি বিষয় সামনে রেখে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। এ ছাড়া নগরের একটি মাদার কর্তৃপক্ষ বা প্রধান সমন্বয় কর্তৃপক্ষ থাকতে হয়। যাদের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে রাজউকের মহাপরিকল্পনা অন্যরা মানছে না। রাজউকের পরিকল্পনা বাইরে গিয়ে ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প যখন অনুমোদন করা হয় তখন পরিকল্পনা কমিশন কোনো যাচাই না করে পাস করে দিচ্ছে। এতে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা তৈরি হয়। বিভিন্ন সংস্থা নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করছে নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য। কিন্তু বাধাগ্রস্ত করছে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে। তাই মাস্টারপ্লান বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষে কঠোর মনিটরিংয়ের পরামর্শ দেন তিনি। সূত্র : জনকণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।