বিনোদন ডেস্ক : প্রত্যেকটা মানুষের সহ্যের একটা সীমা থাকে। সেই সীমা পর্যন্ত একটা মানুষ মুখ বুজে অনেক কিছুই সহ্য করতে থাকে। চরম অপমানও তখন সে সয়ে যায়। কিন্তু সীমা অতিক্রম করলেই আপাত নিরীহ ব্যক্তিটিও হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর।
ঠিক এই বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়েই শুরু হয় ‘মোবারকনামা’। প্রথমেই আমরা প্রধান চরিত্রের নরম থেকে কঠিন হয়ে ওঠার রূপান্তর প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করি। প্রক্রিয়াটি এতই নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত ও অভিনীত যে, তারপর পুরো পর্ব শেষ না করে পারা যায় না। অন্তত প্রধান চরিত্র মোবারকের বিষয়ে জানার আগ্রহ বারবার খোঁচা দেয় দর্শকের মনে।
শুরুতেই তাই দর্শকদের টেনে গল্পের ভেতরে নেওয়ার ক্ষেত্রে শতভাগ সফল ‘মোবারকনামা’। সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই সিরিজটির প্রথম সিজন মুক্তি দিয়েছে। এর গল্প সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘একসময়ের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী মোবারক অপরাধবোধের তাড়নায় অবসর নিয়ে আজ এক মুদি দোকানের কর্মচারী। হঠাৎ একটি চাঞ্চল্যকর মামলা তার দরজায় এসে কড়া নাড়লে মোবারক তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। কিন্তু পরাজয় নিশ্চিত জেনেও সে শেষমেশ এই মামলা লড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ এই মামলাই হতে পারে তার প্রায়শ্চিত্তের শেষ সুযোগ!’
এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে মোবারকের চরিত্রটিতে মানসিক টানাপোড়েনের আলামত স্পষ্ট। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই যেমন আছে, তেমনি আছে বাইরের দুনিয়ার কাছে ফের নিজেকে প্রমাণের সংগ্রাম। এই দুই কাজের জন্য তাই খুবই শক্তিশালী একজন অভিনয়শিল্পীর প্রয়োজন ছিল। সেই ক্ষেত্রে মোশাররফ করিম সবচেয়ে উপযুক্ত নাম। এই অভিনেতা যেভাবে মোবারককে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন, তাতে কখনোই মনে হয়নি যে আমরা অভিনেতা মোশাররফকে দেখছি। বরং ভেঙে গিয়েও না মচকানো মোবারকের চরিত্রটিই মানসপটে থেকে গেছে, যেমনটা হয়েছিল ‘মহানগর’ সিরিজের ওসি হারুন চরিত্রটির ক্ষেত্রে।
বন্দরের খালাসি থেকে রাজত্ব কায়েম, নতুন সিরিজে মোশাররফ করিমবন্দরের খালাসি থেকে রাজত্ব কায়েম, নতুন সিরিজে মোশাররফ করিম
মোবারকরূপী মোশাররফ রগচটা, খ্যাপাটে, বেপরোয়া এবং একইসাথে চূড়ান্ত মাত্রায় সংবেদনশীল। মোবারক চড় খেয়ে দমে যায় না। বরং কেসে হারলে আরও ৪৯টি থাপ্পর মারার আগাম অনুমতি দিয়ে দেয়। সমাজের চোখ রাঙানি তাকে ভীত করে না, ভীত করে নির্দোষকে দণ্ডিত করায় সহায়তা করার পাপবোধ। তাই মোবারক অনুশোচনা থেকে মুক্তি পেতে আগুনে ঝাঁপ দিতেও দ্বিধা করে না।
এমন একটি চরিত্রে মোশাররফ করিম তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টাটিই করেছেন। শরীরী ভাষা থেকে শুরু করে চোখ—সব কিছুতেই মোশাররফ ছিলেন অনবদ্য। আইনজীবী হিসেবে বাহাসে অংশ নিলেও তা আরোপিত মনে হয়নি একেবারেই। বরং সেটিকে আরও জীবন্ত করে তুলেছেন মোশাররফ।
এই সিরিজের গল্পটি খুবই সাধারণ। এমন কাহিনী আমরা প্রতিনিয়তই শুনি। তবে মুন্সিয়ানা হচ্ছে পরিচিত গল্পকেই দর্শকের সামনে নতুন করে উপস্থাপন করা, সেটি দেখতেও দর্শকদের আগ্রহী রাখা। এক্ষেত্রে পরিচালক গোলাম সোহরাব দোদুল লেটার মার্ক পাবেন। কারণ প্রথমত চেনা গল্পে তাঁকে সাজাতে হয়েছে কোর্টরুম ড্রামা। এই ঘরানাটি বেশ পরিচিত। অন্তত ওটিটির দর্শকদের জন্য তো বটেই। পাশের দেশেই এই থিমে অনেক সিনেমা-সিরিজ তৈরি হয়েছে, সেগুলো জনপ্রিয়ও হয়েছে। তাই দর্শকদের নতুন মোড়ক উপহার দিতেই হতো। সেই সঙ্গে মৌলিক কিছু পার্থক্য তৈরি করারও প্রয়োজন ছিল। এই দুটি কাজই ভালোভাবে করেছেন গল্পের লেখক ও পরিচালক গোলাম সোহরাব দোদুল। সেই সঙ্গে আমাদের বর্তমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্ষতকে এতটা নিপুণভাবে শুধু সংলাপের মাধ্যমে তুলে ধরা এবং যুক্তি-তর্ক খণ্ডনের মধ্য দিয়ে সত্যের প্রকৃত রূপ উন্মোচন করার বিষয়টি সত্যিই প্রশংসাযোগ্য।
‘মোবারকনামা’য় আরও অভিনয় করেছেন নওরিন হাসান খান জেনি, শাহনাজ সুমি, সামিয়া অথৈ, সৈয়দ জামান শাওন প্রমুখ। কারও অভিনয়ের মূল্যায়নেই ‘বাড়াবাড়ি’ শব্দটি প্রযোজ্য নয়। বরং সবাই ছিলেন কম-বেশি নিখুঁত। ফলে পুরো সিরিজটিতে তাল কাটেনি খুব একটা। মোশাররফ করিম বাদে যদি আরেকজন অভিনয়শিল্পীর নাম উল্লেখ করতে হয়, তবে সেটি হবে শিল্পী সরকার অপু। সুরাইয়ার মায়ের চরিত্রে অল্প পরিসরে তিনি যে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, তা অসাধারণ।
সিরিজটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, গল্পকার ও পরিচালক একে টেনে লম্বা করেননি। বরং পাঁচ পর্বের মধ্যেই টান টান রেখেছেন। ফলে ‘মোবারকনামা’ দেখতে বসলে কখনোই মনে হয় না যে, কেন দেখছি! বরং মনে হবে, আরেক পর্ব বাড়লে ক্ষতি খুব একটা ছিল না।
অবশ্য সিরিজের শেষে নতুন সিজন আনার পরোক্ষ ঘোষণা এসে গেছে। মোবারক এবার ‘ডরাইসে’! অতিথি চরিত্রে হাজির হয়ে যিনি এই ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে দেখলে আপনারাও বুঝবেন—সামনের সিজন জমজমাটই হবে।
মোদ্দা কথা, চলতি বছরের শেষে এসে মোবারকরূপী মোশাররফ করিম মাতিয়ে দিয়েছেন। ‘ওসি হারুন’ এখন ‘মোবারক’। শুধু ওটিটির দুনিয়ায় সফল হওয়ার ফর্মুলা নয়, বরং সব অভিনয়শিল্পীর ক্ষেত্রেই তৃপ্তিদায়ক হলো, সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যে বেঁচে থাকা। আর এই জায়গায় ‘ওসি হারুন’ ও ‘মোবারক’—দুই-ই সফল। বেশ বড় বিরতির পর এ দেশের ওটিটি দুনিয়ায় নতুন চরিত্রের আবির্ভাব হলো টিকে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। ‘মোবারকনামা’ তাই অভিবাদন পাওয়ারই যোগ্য।
রেটিং: ৪/৫
পরিচালক: গোলাম সোহরাব দোদুল
চিত্রনাট্য: আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির
অভিনয়শিল্পী: মোশাররফ করিম, শিল্পী সরকার অপু, শবনম ফারিয়া, শাহনাজ সুমি, নওরিন হাসান খান জেনি, সামিয়া অথৈ, সৈয়দ জামান শাওন
ভাষা: বাংলা
ধরন: কোর্টরুম ড্রামা
মুক্তি: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩/হইচই
লেখক: সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।