মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম : নবী-রাসূলদের কোনো না কোনো পেশা ছিল, তাঁরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতেন না। বরং স্বীয় হস্তে অর্জিত রিজিক ভক্ষণ করাকে পছন্দ করতেন। মহানবী সা:কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোন ধরনের উপার্জন উত্তম? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেছেন, ‘ব্যক্তির স্বহস্তে অর্জিত অর্থ এবং সৎ ব্যবসায়’। (সুয়ুতি আদ-দুররুল মানসুর খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২০)
রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন, ‘হালাল রুজি অর্জন করা ফরজের পর আরেকটি ফরজ’। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) হজরত ঈসা আ: এক ব্যক্তিকে অসময়ে ইবাদতখানায় দেখে প্রশ্ন করলেন, তুমি এখানে বসে ইবাদত করছ, তোমার রিজিকের ব্যবস্থা কে করে? লোকটি বলল, আমার ভাই আমার রিজিকের ব্যবস্থা করে। ঈসা আ: তাকে বললেন, সে তোমার চেয়ে অনেক উত্তম। (হেদায়াতুল মুরশিদিন) নবী-রাসূলগণ হলেন পৃথিবীর সেরা মানব, ফলে তাঁরা সেরা উপার্জন তথা স্বহস্তে অর্জিত সম্পদে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
হজরত আদম আ:- তিনি ছিলেন একজন কৃষক। চাষাবাদ করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর ছেলেদের পেশাও ছিল চাষাবাদ। তা ছাড়া তিনি তাঁতের কাজও করতেন। কারো কারো মতে, তার পুত্র হাবিল পশুপালন করতেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে কৃষিকাজের যন্ত্রপাতির নাম শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন- আল্লাহর বাণী- ‘আর আল্লাহ আদমকে সমস্ত নামের জ্ঞান দান করেছেন’। (সূরা বাকারা-৩১)
হজরত শীস আ:- তিনি পিতা হজরত আদম আ:-এর মতো কৃষক ছিলেন। তাঁর পৌত্র মাহলাইল সর্বপ্রথম গাছ কেটে জ্বালানি কাজে ব্যবহার করেন। তিনি শহর নগর ও বড় বড় কিল্লা তৈরি করেছেন। তিনি বাবেল শহর প্রতিষ্ঠা করেছেন। (ইবনে কাছির)
হজরত ইদরিস আ:- তাঁর পেশা ছিল কাপড় সেলাই করা। কাপড় সেলাই করে যে অর্থ উপার্জন করতেন তা দিয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
হজরত নূহ আ:- তিনি ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। আল্লাহ তায়ালা তাকে নৌকা তৈরির কলাকৌশল শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশে তিনি নৌকা তৈরি করেছিলেন। আল্লাহর বাণী- ‘আর তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার ওহি অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ করো’। (সূরা হুদ-৩৭) তিনি ৩০০ হাত দীর্ঘ, ৫০ হাত প্রস্থ, ৩০ হাত উচ্চতাসম্পন্ন একটি বিশাল নৌকা তৈরি করেন।
হজরত হুদ আ:- তাঁর পেশা ছিল ব্যবসায় ও পশুপালন। ব্যবসায় ও পশুপালন করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
হজরত সালেহ আ:- তাঁর পেশাও ছিল ব্যবসায় ও পশুপালন। তিনি পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
হজরত লুত আ:- তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা চাষাবাদের সাথে জড়িত ছিল। তিনিও জীবিকা নির্বাহ করতেন চাষাবাদের মাধ্যমে।
হজরত ইবরাহিম আ:- তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য কখনো ব্যবসায় আবার কখনো পশুপালন করতেন।
হজরত ইসমাইল আ:- তিনি পশু শিকার করতেন। পিতা-পুত্র উভয়ই ছিলেন রাজমিস্ত্রি। উভয়ে মিলে আল্লাহর ঘর তৈরি করেছিলেন।
হজরত ইয়াকুব আ:- তাঁর পেশা ছিল ব্যবসায়, কৃষিকাজ ও পশুপালন। হজরত ইউসুফ আ:- তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। সুতরাং বেতন হিসেবে বায়তুল মাল অর্থ গ্রহণ করতেন।
হজরত শোয়াইব আ:- তাঁর পেশা ছিল পশুপালন ও দুধ বিক্রি। পশুপালন ও দুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর কন্যাগণ চারণভূমিতে পশু চরাতেন।
হজরত দাউদ আ:- দাউদ আ: নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে লোহা দ্বারা বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করার কৌশল শিক্ষা দেন। শক্ত ও কঠিন লোহা স্পর্শ করলে তা নরম হয়ে যেতো। যুদ্ধাস্ত্র, লৌহ বর্ম ও দেহবস্ত্র প্রস্তুত করা ছিল তাঁর পেশা। এগুলো বিক্রি করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
হজরত সোলায়মান আ:- তিনি তাঁর পিতা থেকে অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। তিনি নিজেও অঢেল সম্পদের মালিক ছিলেন। ভিন্ন পেশার গ্রহণ করার চেয়ে নিজ সম্পদ রক্ষা ও তদারকি করাই ছিল তাঁর প্রদান দায়িত্ব।
হজরত মুসা আ:- তিনি ছিলেন একজন রাখাল। তিনি মাদায়েনে শ্বশুরের পশু চরাতেন। সিনাই পর্বতের পাদদেশে বিরাট চারণভূমি মাদায়েনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আট বছর তিনি স্বীয় শ্বশুর শোয়াইব আ:-এর পশু চরিয়েছেন।
হজরত হারুন আ:- তাঁর পেশাও ছিল পশুপালন। পশুপালন করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
হজরত ইলিয়াছ আ:- তাঁর পেশাও ছিল ব্যবসায় ও পশুপালন।
হজরত আইউব আ:- তাঁর পেশা ছিল গবাদিপশু পালন। তাঁর প্রথম পরীক্ষাটি ছিল গবাদিপশুর ওপর। ডাকাতেরা তাঁর পশুগুলো লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। (আনওয়ারে আম্বিয়া ই. ফা. বাংলাদেশ)
হজরত ইউনুস আ:- তাঁর গোত্রের লোকদের পেশা ছিল চাষাবাদ। তাঁর পেশাও ছিল চাষাবাদ।
হজরত জাকারিয়া আ:- ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত আছে, মহানবী সা: বলেছেন, জাকারিয়া আ: কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। তাই তাঁর শত্রুরা তাঁর করাত দিয়েই তাকে দ্বিখণ্ডিত করে। (কিতাবুল আম্বিয়া সহিহ বুখারি)
হজরত ইয়াহইয়া আ:- তিনি জীবনের একটি সময় জঙ্গলে ও জনহীন স্থানে কাটিয়েছিলেন। আহার হিসেবে তিনি বৃক্ষের লতা-পাতা ভক্ষণ করতেন। (আনওয়ারে আম্বিয়া)
হজরত জুলকিফল আ:- তাঁর পেশা ছিল পশুপালন।
হজরত ইয়াসা আ:- তাঁর পেশা ছিল ব্যবসায় ও পশুপালন।
হজরত ঈসা আ:- তাঁর আবাসস্থল প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমি তাঁদের উভয়কে (ঈসা ও মরিয়মকে) এক উচ্চভূমি প্রদান করেছিলাম যা সুজলা ও বাসযোগ্য ছিল।’ (সূরা আল মুমিনুন-৫০) এই উচ্চভূমি হলো ফিলিস্তিন। তিনি ফিলিস্তিনে উৎপন্ন ফল-মূল খেয়ে বড় হয়েছেন। তিনি ঘুরে ঘুরে অলিতে গলিতে দ্বীনের দাওয়াতি কাজ করতেন। যেখানে রাত হতো সেখানে খেয়ে না খেয়ে নিদ্্রা যেতেন। তাঁর নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না।
হজরত মুহাম্মদ সা:- তিনি ছিলেন একজন সফল ও সৎ ব্যবসায়ী। তিনি ইরশাদ করেছেন, সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীদের হাশর হবে নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথে। (আদদুরুরুল মানসুর ষষ্ঠ খণ্ড পৃষ্ঠা-২২০) তিনি গৃহের কাজ নিজ হাতে করতেন। বকরির দুধ দোহন করতেন। নিজের জোতা ও কাপড় সেলাই ও ধোলাই করতেন, গৃহে ঝাড়– দিতেন। মসজিদে নববী নির্মাণকালে শ্রমিকের মোত কাজ করেছেন। খন্দকের যুদ্ধে মাটি কেটেছেন। বাজার থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতেন। তিনি ইরশাদ করেন, বর্শার ছায়ার নিচে আমার রিজিক নির্ধারণ করা হয়েছে তথা গণিমতের মাল হলো আমার রিজিক। (কুরতুবি-১৩তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২) আর ইরশাদ করেন, জমিনের অভ্যন্তরে তথা চাষাবাদ, খনন ও রোপণের মাধ্যমে রিজিক অনুসন্ধান করো।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘এমন কোনো নবী নেই যিনি ছাগল চরাননি। জনৈক সাহাবি প্রশ্ন করেন, হে আল্লাহর রাসূল আপনিও কি ছাগল চরিয়েছেন? প্রত্যুত্তরে রাসূল সা: বলেন- হ্যাঁ, আমিও মক্কায় অর্থের বিনিময়ে ছাগল চরিয়েছি। বলাবাহুল্য, মহানবী সা:-এর সাহাবিগণ অনেকেই ব্যবসায় করতেন। বিশেষ করে মুহাজিরগণ ছিলেন ব্যবসায়ী আর আনসারগণ ছিলেন কৃষক।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামিয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।