জুমবাংলা ডেস্ক : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র এলাকা সাপাহার ও পোরশা উপজেলায় পানির অভাবে ধান চাষ ব্যাহত হলে প্রায় এক দশক আগে জমির মালিকরা অপেক্ষাকৃত কম পানি ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতের আম উৎপাদন শুরু করে। ধান চাষের চেয়ে আম চাষ অধিক সাশ্রয়ী ও লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা ধানের পরিবর্তে আম চাষে ঝুঁকতে থাকেন।
জেলার সাপাহার, পোরশা ও পত্নীতলা উপজেলায় কৃষকের আম চাষের সাফল্য ছড়িয়ে পড়ে পুরো জেলায়। নওগাঁর উৎপাদিত সুস্বাদু ও উন্নত জাতের আমের কদর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় সারা দেশে বাড়তে থাকে নওগাঁর আমের চাহিদা।
আমের চাহিদা বেশি থাকায় বাজারে বাড়তে থাকে আমের দাম। ধান চাষের চেয়ে আম চাষে ঝুঁকি কম থাকায় নওগাঁর কৃষকরা ধানের জমিগুলোকে আম বাগানে পরিণত করতে শুরু করে। নওগাঁ জেলা আম উৎপাদনে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে।
নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার দিবর ইউপি চেয়ারম্যান রাহাত জামান, আগে আমাদের এলাকায় শুধু ধান, গম আর সরিষার খেত দেখা যেত। এক যুগ আগে থেকে এসব ফসলি জমিতে বাণিজ্যিকভাবে আমবাগান হতে শুরু করে। এখন চারিদিকে শুধু আমবাগান। আগে আমরা রাজশাহী কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম খুঁজতাম। এখন নওগাঁর আম কিনতে দেশের বহু এলাকা মানুষ আমাদের এলাকায় আসে।
দিন দিন আমবাগান বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে সাপাহার উপজেলা আমচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, আমকে ঘিরে আমাদের এলাকার অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠে। জেলার পত্নীতলা, সাপাহার ও পোরশা উপজেলায় অর্ধেকের বেশি জমিতে আমবাগান গড়ে উঠেছে। আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে নওগাঁ। বর্তমান বাজারে এক মণ ধানের দাম ১২০০-১৩০০ টাকা। সেখানে এক মণ আমের ধাম ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা। আবার বিঘাপ্রতি ধানের চেয়ে আমের ফলনও বেশি। এজন্য মানুষ আমচাষে ঝুঁকছে। বর্তমানে শুধু সাপাহার উপজেলাতেই দুই হাজারের বেশি আমাচাষি রয়েছে।
আম উৎপাদনে কোন জেলা সবার ওপরে, এ প্রশ্ন করা হলে সবার মাথায় প্রথমেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাম আসে। তবে সরকারি হিসাবমতে, উৎপাদনের দিক থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সেই একচ্ছত্র আধিপত্য আর নেই। ২০২০ সালে আম উৎপাদনে শীর্ষে ছিল নওগাঁ। এ বছর নওগাঁ জেলায় দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, এ বছর নওগাঁয় ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে আমচাষ হয়েছে। এর মধ্যে পোরশা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ১০ হাজার ৫১০ হেক্টর আমচাষ করেছেন চাষিরা। এরপর বেশি আমচাষ হয়েছে সাপাহারে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। এছাড়ার পত্নীতলা উপজেলায় ৪ হাজার ৮৬৫ হেক্টর, নিয়ামতপুরে ১ হাজার ১৩৫ হেক্টর, নওগাঁ সদরে ৪৪৫ হেক্টর, মান্দায় ৪০০ হেক্টর, বদলগাছীতে ৫২৫ হেক্টর, ধামইরহাটে ৬৭৫ হেক্টর, মহাদেবপুরে ৬৮০ হেক্টর, রাণীনগরে ১১০ হেক্টর ও আত্রাইয়ে ১২০ হেক্টর জমিতে আমচাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ দশমিক ৫ মেট্রিক টন। সে হিসেবে জেলায় এ বছর দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৭ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে; যার সম্ভাব্য মূল্য ধরা হয়েছে ২ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা।
নওগাঁয় আমবাগান বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক শামীম ইকবাল বলেন, নওগাঁর উৎপাদিত আম সুস্বাদু হওয়ায় এবং মাটি আম চাষের উপযোগী হওয়ায় আম চাষে কৃষকের লাভ বেশী হচ্ছে। এ কারণে আম চাষের জন্য দিন দিন কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে। প্রতি বছর নতুন নতুন বাগান গড়ে উঠছে। প্রতিবছর এই জেলায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে আমচাষের পরিধি বাড়ছে। জেলার সবজায়গাতেই আমচাষ বাড়ছে, যদিও পোরশা, সাপাহার ও পত্নীতলা উপজেলায় আম বাগান বেশি দেখা যাচ্ছে। এসব এলাকা উঁচু বরেন্দ্র এলাকা। এসব এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক গভীরে আবার পানির প্রাকৃতিক উৎস না থাকায় সেচ সুবিধাও তেমন নেই। এছাড়া মাটির বৈশিষ্ট্যের কারণে আমের প্রচুর ফলন হয়। এখানকার আমের স্বাদও খুবই ভালো। জেলায় এখন বছর জুড়েই আমের চারা বিক্রি হয়। প্রতিবছরই নতুন কৃষি উদ্যোক্তা এই পেশায় আসছেন। এদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমচাষে বেশি সফল হচ্ছেন।
তবে নওগাঁর আমবাগানগুলোতে আমের ফলন চাঁপাইয়ের চেয়ে বেশি হলেও আমচাষের জমির পরিমাণের দিক থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এগিয়ে বলে জানান তিনি।
এই কৃষি কর্মকর্তা জানান, নওগাঁয় এ বছর প্রায় সাড়ে ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমচাষ হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জে চাষ হয়েছে ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে। নওগাঁয় প্রতি হেক্টর জমিতে এ বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৫ মেট্রিক টন, সেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ মেট্রিক টন। সে হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন।
এদিকে সরব হতে শুরু করেছে নওগাঁর আমের বাজার। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার নওগাঁর সবচেয়ে বড় আমের বাজার সাপাহারে গিয়ে আমের জমজমাট বেচা-বিক্রি দেখা যায়। এ বছর এপ্রিল ও মে মাসে কয়েক দফায় হওয়া ঝড়-বৃষ্টিতে আমের উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হওয়ায় আমচাষিদের মধ্যে হতাশা গ্রাস করেছিল। তবে আমের ভালো দাম পেয়ে সেই হতাশা কাটিয়ে আমচাষিদের মুখে হাসি ফুটেছে।
বাজারে প্রতি মণ আম্রপালি ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। ল্যাংড়া আম ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা মণপ্রতি বিক্রি হয়েছে। প্রতি মণ হিমসাগর আম ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নাকফজলি আম প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়।
সাপাহারের আম আড়তদার ও বাজারে আম বিক্রি করতে আসা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হিমসাগর ও নাকফজলি আমের এখন শেষ সময় চলছে। এখন চলছে ল্যাংড়া আমের ভরা মৌসুম। আর নওগাঁর ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত আম্রপালি আম তিন-চার দিন ধরে বাজারে উঠতে শুরু করেছে। নওগাঁ জেলায় উৎপাদিত আমের প্রায় ৬৫ শতাংশই আম্রপালি। এছাড়াও বারি-৪, ল্যাংড়া, গৌড়মতি, আশ্বিনা, হিমসাগর, গোপালভোগ ও কাটিমন আমচাষ হয়ে থাকে। নওগাঁয় আম সংগ্রহ শুরু হয়েছে ৫ জুন থেকে।
সাপাহার আম বাজার আড়তদার সমিতির সভাপতি কার্তিক সাহা বলেন, সাপাহারে আড়াইশর অধিক আম আড়তদার রয়েছে। প্রতিদিন এই বাজার থেকে ৫০০ থেকে ৭০০ ট্রাক আম ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে যায়। আমের ভরা মৌসুমে বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ কোটি টাকার আম বেচাকেনা হয়ে থাকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।