গণতন্ত্রের বিশৃঙ্খলার মাঝে পুরোনো এক যুগের প্রতিধ্বনি আবারও ভেসে উঠল রাজধানীর আকাশে, যেখানে হাজারো মানুষ সাবেক নেপাল রাজ্যের পতাকার নিচে সমবেত হয়েছেন। বাকস্বাধীনতার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা থেকে উদ্ভূত অধিক গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবির এই আন্দোলনে রাজতন্ত্রের পক্ষে স্লোগান কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক মনে হলেও, এটি আসলে ব্যর্থ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাহীনতা, থমকে যাওয়া অর্থনীতি এবং নির্বাচিত সরকারগুলোর পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে না পারার প্রতি হতাশার বহিঃপ্রকাশ।
হিমালয়ের হিন্দু রাজ্য
টানা দুই বছরের আন্দোলনের পর ২০০৮ সালে নেপালের ২৪০ বছরের পুরোনো শাহ রাজ বংশের শাসনের অবসান ঘটে। তবে নেপালের রাজতন্ত্রের কাহিনী শুরু হয়েছিল তার করুণ পতনের অনেক আগেই। শাহ রাজবংশের সূচনা ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন দ্রব্য শাহ নামের এক রাজপুত-বংশোদ্ভূত ব্যক্তি ১৫৫৯ সালে গোরখার ছোট্ট রাজ্যের সিংহাসন দখল করেন। পাহাড়ি দুর্গে ছোট এই রাজ্য থেকেই শাহ বংশ পরবর্তীতে পুরো নেপালের পরিচয় হয়ে ওঠে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কয়েক ডজন ক্ষুদ্র, যুদ্ধরত পাহাড়ি রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত নেপাল। ১৭৪৩ সালে রাজ্যাভিষেক হওয়া পৃথী নারায়ণ শাহ বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলেন। সিংহাসনে বসে তরবারি ও কৌশলের জোরে তিনি জয়লাভ করেন। সব ভগ্ন অঞ্চলকে এক রাজ্যে রূপান্তরিত করে আধুনিক নেপাল রাজ্যের সূচনা ঘোষণা করেন পৃথী নারায়ণ শাহ।
শাহ রাজারা বহু যুদ্ধ, চুক্তি, এবং পরিবর্তনশীল সময়ের মধ্য দিয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধারী রাজা হিসেবে রাজ্য শাসন করেন। উনিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চাপ, অ্যাংলো-নেপাল যুদ্ধ এবং শতাব্দীব্যাপী রাজপ্রাসাদের ষড়যন্ত্র ও সামন্ত প্রথার মধ্য দিয়েও টিকে ছিলেন তারা। তবে তাদের ক্ষমতা সবসময়ই চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল।
১৮৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত রানা প্রধানমন্ত্রীদের ছায়া শাসনে শাহ রাজারা কেবল প্রতীকী অবস্থানে নেমে আসেন। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন রাজা ত্রিভুবন। আর রাজা মহেন্দ্র ক্ষমতা সুসংহত করেন। এর মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র নতুনভাবে পুনরুজ্জীবিত এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থেকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে রূপান্তরের চেষ্টা শুরু হয়।
শেষের শুরু
২০০১ সালের সেই ভয়াবহ জুন থেকেই রাজতন্ত্রের পতনের শুরু। নারায়ণহিতি প্রাসাদে সংঘটিত রাজপরিবার হত্যাকাণ্ডে বিশ্ব হতবাক হয়। রহস্যজনক এক পরিস্থিতিতে রাজা বীরেন্দ্র, রানি ঐশ্বর্য এবং রাজপরিবারের অধিকাংশ সদস্য নির্মমভাবে নিহত হন।
সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ দীপেন্দ্র কোমায় থাকাকালীন তাকে রাজা ঘোষণা করা হয়। রাজা ঘোষণার মাত্র তিন দিন পর মারা যান তিনি। শোক ও সন্দেহের আবহে সিংহাসনে বসেন তার চাচা জ্ঞানেন্দ্র। তবে তার ক্ষমতা শুরু থেকেই বিতর্কিত ছিল।
বছর গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নেপাল এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে। মাওবাদী বিদ্রোহ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে রাজতন্ত্রের বৈধতা ও অস্তিত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে।
২০০৫ সালে মাওবাদীদের দমন ও শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি তুলে রাজা জ্ঞানেন্দ্র সংসদ ভেঙে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে রাজকীয় অভ্যুত্থান ঘটান। কিন্তু তার কড়া শাসন পরিস্থিতিকে আরও অগ্নিগর্ভ করে তোলে।
২০০৬ সালে দেশটিতে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়। মাওবাদী ও গণতন্ত্রপন্থীরা ঐক্যবদ্ধভাবে রাজতন্ত্র-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। প্রবল চাপের মুখে রাজা জ্ঞানেন্দ্র তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ত্যাগ এবং ভেঙে দেওয়া সংসদ পুনর্বহালে বাধ্য হন।
২০০৮ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নেপাল পরিস্থিতি বড় ধরনের মোড় নেয়। ওই বছরের ২৮ মে নেপালকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ২৩৯ বছরের শাহ রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে। এর মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের মুকুটের পতন ঘটে, আর নেপাল প্রবেশ করে নতুন এক যুগে।
রাজা কি ফিরবেন?
২০২৫ সালের মার্চে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ রাজতন্ত্রের দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভকারীরা সরকারি বিভিন্ন ভবনে অগ্নিসংযোগ করলেও রাজতন্ত্রের প্রতীকগুলো অক্ষত থাকে।
১৭ বছরে ১৪টি সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নেপালের প্রজাতন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। দুর্নীতি, অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সংকট পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। তবে রাজতন্ত্রের ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা বেঁচে ছিল।
সমর্থকদের চোখে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি কেবল রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, বরং এটি এক আধ্যাত্মিক জাগরণ—পবিত্র ব্যবস্থা। যা প্রজাতন্ত্রের বিশৃঙ্খলার বিপরীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম। শাহ রাজবংশের তত্ত্বাবধানে স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি, হিন্দু গৌরব ও জাতীয় ঐক্যের প্রতিশ্রুতিও দেখেন সমর্থকরা।
তবে রাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি জটিলতায় ভরা। সমালোচকরা মনে করেন, ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিসরে রাজতন্ত্র কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। রাজতন্ত্রপন্থী নেতারা বলছেন, তারা কেবল প্রতীকী রাজা চান, পরম ক্ষমতাধারী নন। কিন্তু সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন, যদি একই রাজনৈতিক দল ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ব্যবস্থা থেকে যায়, তাহলে প্রতীকী রাজা আসলে কী পরিবর্তন আনতে পারবেন?
বিভিন্ন জরিপ ও নির্বাচনী ফলে দেখা যায়, রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়লেও তা এখনও সীমিত। এটি মূলত বর্তমান নেতাদের প্রতি ক্ষোভ থেকে উদ্ভূত; প্রকৃতপক্ষে রাজতন্ত্রের প্রতি অনুরাগ থেকে নয়।
বাংলাদেশি শর্টফিল্ম ‘লোক’ যাচ্ছে আমেরিকার ফ্যান্টাস্টিক ফেস্টে
জেন-জি আন্দোলনের নেতাদের মূল উদ্বেগ ছিল দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাওয়া বেকারত্ব, দুর্নীতি ও বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। তাদের কাছে রাজতন্ত্রে ফিরে যাওয়া হবে এক পশ্চাৎপদ পদক্ষেপ। কারণ তাদের এই আন্দোলন আসলে নেপালের ভবিষ্যতের জন্যই।
সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।