শাহাদাত বিপ্লব : চাল উৎপাদনে পানির অপচয় সবচেয়ে বেশি হয় বাংলাদেশে। প্রতি কেজি চালের জন্য পানির ব্যবহার কখনো কখনো ১ হাজার ৩০০ লিটারেও পৌঁছায়। এতে পানি অপচয়ের পাশাপাশি কৃষকের জ্বালানি খরচও হয় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। দেশের কৃষিতে পানি ও জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে ইন্টিগ্রেটেড রাইস অ্যাডভাইজরি সিস্টেম (আইআরএএস) শীর্ষক একটি মডেল বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় তৈরি মডেলটি কাজে লাগিয়ে জমি ও ফসলে পানির চাহিদা এবং ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণ করতে পারবেন কৃষক। মডেলটি তৈরি হয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার স্যাটেলাইটে ধারণ করা সেচ মানচিত্র ব্যবহার করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশী কৃষকদের অংশীজন হয়ে উঠছে নাসা। জানুয়ারি থেকে জুন—ছয় মাস দেশের বেশির ভাগ কৃষিজমি খরাপ্রবণ হয়ে ওঠে। অথচ এ সময়েই আবাদ করা হয় বোরো ধান, যে মৌসুমে দেশে সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হয়। জমি শুষ্ক থাকায় কৃষকদের তখন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। যদিও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় বাড়তি সেচের মাধ্যমে তারা প্রয়োজনের চেয়েও বেশি পানি ব্যবহার করেন ধান চাষে। এতে একদিকে যেমন পানির স্তর নেমে যাচ্ছে অন্যদিকে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহারের কারণে কৃষককে গুনতে হচ্ছে বাড়তি খরচ।
গবেষকদের দাবি, নাসার সেচ মানচিত্র অনুসরণের মাধ্যমে কৃষকদের আগে থেকেই পূর্বাভাস দেয়া গেলে পানির অপচয় রোধ হবে অন্তত ৩০ শতাংশ। পাশাপাশি জ্বালানির ব্যবহার কমানো সম্ভব ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত। এতে সরকারের ভর্তুকি কমবে প্রায় সাড়ে ১১ কোটি ডলার। এছাড়া বছরে প্রায় তিন লাখ টন কার্বন নিঃসরণও কমানো সম্ভব হবে।
প্রকল্পটির সঙ্গে জড়িত গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেচ মডেলটিতে প্রথমে প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষের জমিতে কী পরিমাণ পানি রয়েছে তা নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি নির্দিষ্ট এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও পূর্বাভাসের সমন্বয়ে মডেলটি প্রস্তুত করা হয়।
নাসার স্যাটেলাইটভিত্তিক সেচ মডেলটি ব্যবহারের এ কর্মসূচিতে অর্থায়ন করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প। ২০১৭ সালে এটি যাত্রা করলেও মূলত ২০২০ সালে এ প্রযুক্তি নিয়ে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পটির পরিচালক ড. মো. শাহ কামাল খান বলেন, ‘আমাদের দেশে খরার সমস্যা রয়েছে। কৃষক ফসল উৎপাদনে মূলত ঢালাও সেচ দেন। সেচ পাম্প মালিকদের সঙ্গে কৃষক পুরো একটি মৌসুমের চুক্তি করেন। ফলে কৃষক সবসময় চান তার জমিতে যেন পানি ভরপুর থাকে। কিন্তু উৎপাদন ভালো হওয়ার জন্য সবসময় পানি থাকা অপরিহার্য নয়।’
সেচ মডেলটি মূলত এডব্লিউডি প্রযুক্তির আধুনিক ভার্সন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ মডেলের মাধ্যমে নাসার ম্যাপ ব্যবহার করে আমরা একটি মডেল তৈরি করতে পেরেছি। সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এ প্রযুক্তি থেকে পাওয়া তথ্য কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে পানি, জ্বালানি ও অর্থ সাশ্রয় সম্ভব হবে। আমরা ফিল্ড ট্রায়ালে এর কার্যকরিতা পেয়েছি। এ কর্মসূচির জন্য ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে। আমাদের দেশে এ ধরনের স্যাটেলাইট নেই। নাসা এগিয়ে এসেছে। নাসার এ স্যাটেলাইট খুব কাছের তথ্য দিতে পারে। প্রতি শতাংশ জমির আলাদাভাবে তথ্য দেয়া সম্ভব হবে। এ মডেলের মাধ্যমে আখ, গম ও ভুট্টার জমিতে সেচ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।’
দেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ৭৫ শতাংশেই ধান চাষ করা হয়। সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় পুরোপুরি সেচনির্ভর বোরো মৌসুমে, প্রায় ৬০ শতাংশ। সর্বশেষ প্রকাশিত কৃষিশুমারির হিসাবে, দেশের মোট আবাদি জমির ১ কোটি ২৫ লাখ একর সেচের আওতাধীন। এ সেচের প্রায় ৭৫ ভাগের উৎস ভূগর্ভস্থ পানি, যা সাধারণত পাম্প ব্যবহার করে ওঠানো হয়। ফলে বাড়তি সেচের কারণে ধান উৎপাদন করে খরচ ওঠাতে হিমশিম খেতে হয় কৃষকের। আবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বিদ্যুচ্চালিত সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এতে উৎপাদন নিয়েও শঙ্কায় থাকতে হয় কৃষককে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হিসাবে, দেশে ব্যবহৃত মোট জ্বালানির ৭০ শতাংশই ডিজেল। আর ডিজেলের প্রায় ২৩ শতাংশ ব্যবহার হয় কৃষিতে, যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নাসার এ প্রযুক্তির সঙ্গে কৃষকদের অভ্যস্ত করাতে পারলে সমৃদ্ধ হবে কৃষি খাত। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব। এজন্য দ্রুত প্রযুক্তি সম্প্রসারণের দাবি জানান তারা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরিগেশন অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘দেশের কৃষিতে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয় ধানকে। আর এ ফসল চাষে মূলত জমিতে প্লাবন সেচ পদ্ধতি ব্যবহার করার প্রবণতা বেশি। সাধারণত ধানগাছ লম্বা হলে ৯০-১২০ সেন্টিমিটার পানি কৃষক ব্যবহার করেন। এর ৫০-৭০ শতাংশ পানি আবার ভূগর্ভস্থে চলে যায়। আরো একটি অংশ নানাভাবে অপচয় হয়। অর্থাৎ আমাদের দেশে যেভাবে সেচ দেয়া হয় তাতে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পানি ব্যবহার হয়।’
প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পানির ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় আমরা দেখেছি নানাভাবে পানির ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব। অল্টারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রাইং মেথডসহ (এডব্লিউডি) নানা প্রযুক্তি রয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জটা হলো এর সম্প্রসারণ নিয়ে। কৃষকদের আসলে এর সঙ্গে কতটুকু পরিচয় করানো সম্ভব হবে তার ওপর এর সফলতা নির্ভর করবে।’
মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৭০৮ হেক্টর জমি খরায় আক্রান্ত। এর মধ্যে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭৩ হেক্টর ভূমি অতি গুরুতরভাবে খরায় আক্রান্ত। আর ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৪৮ হেক্টর ভূমি গুরুতর, ৬ লাখ ৪৪ হজিরি ৬৪৮ হেক্টর ভূমি মধ্যম এবং ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯ হেক্টর ভূমি স্বল্প পরিমাণে খরায় ভুগছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশের কৃষি নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেসব সংকট কাটিয়ে উঠতে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার করছি আমরা। কৃষক শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করে থাকেন। প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে পানির অপচয় কমিয়ে আনা যায় তা নিয়ে আমাদের কাজ চলছে। কৃষিতে সংকট থাকবে। আবার সংকট উত্তরণে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচিও নিচ্ছি। যার ফলে যত সংকটই থাকুক আমাদের উৎপাদন বাড়ছে।’ সূত্র : বণিক বার্তা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।