জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনায় তিস্তা প্রজেক্ট দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেটা বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক চাপিয়ে দেয়া বন্যাই প্রমাণ করে। আন্তর্জাতিক নদী আইনের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশের উজানে বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত নানা প্রকল্প চালু করেছে। এতে ভাটির দেশ বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হওয়া থেকে চাষযোগ্য জমিগুলো পরিণত হচ্ছে বিরান মরুভূমতে। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশীয় মাছ, উদ্ভিদ, নানা প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির পথে। পর্যাপ্ত পুষ্টি তথা প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটানো নদীগুলো আজ পানিশূন্য।
গত ২২ আগস্ট বিনা নোটিশে ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধ খুলে দেয়ায় সিলেট, ফেনী, নোয়াখালী, খাগড়াছড়িসহ গোটা পূর্বাঞ্চলের কোনো কোনো এলাকা প্রায় ২০ ফুট পানির নিচে ডুবে যায়। আচমকা পানির তোড়ে ভেসে গেছে মানুষ, ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, মাঠের ফসল সবকিছু। নিঃস্ব করে দিয়েছে ওই অঞ্চলের মানুষদের। ভারত বলছে যে তারা পানি ছাড়েনি, পানির চাপে গেট খুলে গেছে, ওভার ফ্লো হয়ে গেছে ইত্যাদি। দুর্বল অজুহাত। পানি যখন তীব্র বেগে বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছে, তখনো বাংলাদেশকে ভারত জানাতে পারতো। এতে অন্তত ধেয়ে আসা বানের পানি থেকে দূরে থাকা জনগোষ্ঠী নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছতে পারতো। কিন্তু তারা জানায়নি।
ভারতের আগ্রাসী চরিত্র গত পৌনে এক শতাব্দী ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো দেখেছে। হিন্দুত্ববাদের দেশ ভারতের হাত থেকে রক্ষা পায় নাই হিন্দু দেশ নেপালও। তাদের ওপরও দাদাগিরির ছড়ি ঘুরিয়েছে অর্ধ শতাব্দী ধরে। প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি ভারতের যে সম্পর্কের ইতিহাস তা কেবলই সন্ত্রাস, দখল আর প্রতারণার ইতিহাস। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া প্রিন্সলি স্টেটগুলোর বেশির ভাগ ভারত বন্দুকের নলের মুখে দখল করে নিয়েছে। হায়দারাবাদ, সিকিম, জম্মু-কাশ্মিরসহ বিভিন্ন অঞ্চল হয় গায়ের জোরে না হয় প্রতারণার জোরে দখল করে নিয়েছে।
তিস্তাকে এর আলোকে দেখতে হবে। প্রথম স্বাধীনতার পরে ১৯৮৩ সালে তিস্তা নিয়ে প্রথম একটি সমঝোতা হয় ভারতের সাথে৷ সমঝোতা অনুসারে তিস্তার ৩৯ শতাংশ ভারত ও ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ছিলো৷ বাকি ২৫ শতাংশ নদীর নাব্যতা ধরে রাখতে ও স্বাভাবিক প্রবাহের প্রয়োজন হবে। কিন্তু ভারত তা কখনোই মানে নাই৷
ভারতের প্রতিবেশীদের ভিতর একমাত্র জনবিচ্ছিন্ন, গনশত্রু স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সাথে তারা সম্পর্ক রেখেছিলো। গনঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পরে বাংলাদেশের বিপ্লবী জনতা প্রথমেই ভারতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হয়েছে। এতে এটা প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কোনো আধিপত্যের বিরুদ্ধে মাথা নোয়াবে না।
নয়া বাংলাদেশেকে নতুনভাবে নির্মাণ করতে প্রথমে আমাদের খাদ্য ও জীব বৈচিত্র্যের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। সেক্ষেত্রে দেশজুড়ে খাল খনন করে নদীর প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। সেই আশির দশকে স্বাধীনতার মহান ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম খাল খননের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে খাল খনন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো শুকিয়ে মরুভূমি হওয়ার পথে। তিস্তা নদীতে অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে। বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে।
‘তিস্তায় পানি নেই এটা একটা বাতুল প্রচারণা৷ স্যাটেলাইট ইমেজ বা গুগল ইমেজ থেকে তিস্তার পানি স্পষ্ট দেখা যায়৷ গজলডোবা থেকে তিস্তার পানি মহানন্দায় নেয়া হচ্ছে৷ মহানন্দাও একটা অভিন্ন নদী৷ সেখানেও ব্যারাজ আছে৷ সেখান থেকে পানি নেয়া হয় ডাহুক নদীতে৷ সেখানেও একটি ব্যারাজ রয়েছে৷ এই তিনটি নদীই বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদী৷ এই তিন নদীতে বাংলাদেশেরও অধিকার আছে৷ এই তিনটি নদীই ভারত বন্ধ করে পশ্চিমবঙ্গে সেচ এবং ডাহুকে বিদ্যুৎ প্রকল্প করেছে।’
ভারত থেকে বাংলাদেশে যে ৫৪টি নদী প্রবেশ করেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে তিস্তা। এটি ভারতের সোলামো লেক থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রংপুর জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে এটি চিলমারির কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে।
এহেন পরিস্থিতিতে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ ড্যাম তৈরি করে শুষ্ক মৌসুমে পানির চাহিদা মেটানো এবং বর্ষা মৌসুমে পানি দিয়ে ড্যাম পূর্ণ রেখে বন্যার ভয়াবহতা রক্ষার প্রচেষ্টা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, অভিজ্ঞতা, প্রয়োজনীয় বাজেট, ড্যামের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে চীন আমাদের সহযোগিতা করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আছে৷ বাংলাদেশের সাথে তিস্তা প্রজেক্ট চীনের আলোচনা হয়েছিলো। যদিও আওয়ামী লীগ চীনের সাথে ভারতের মতো প্রতারণা করেছে। চীনকে দিয়ে সমীক্ষা চালিয়ে, পরিকল্পনা করিয়ে যখন প্রজেক্ট আলোর মুখ দেখবে, তখনই ভারতের ইশারায় চীনের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে দ্রুততম সময়ের ভেতর এই প্রজেক্টটিকে চীনের কাছেঠ হস্তান্তর করা যায় কিনা তা বিবেচনা করা। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থেই এটা জরুরি ভিত্তিতে করা উচিত। উল্লেখ্য, চীন এই প্রজেক্টের নিজস্ব অর্থায়নে সমীক্ষা চালিয়েছে। সম্পূর্ন চীনা বাজেটে চীন এ প্রজেক্টটি করতে প্রস্তুত।
‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন’ নামে তিস্তা প্রকল্পের নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রাথমিক কাজ ইতিমধ্যেই শেষ করেছে চায়না পাওয়ার কোম্পানি। এছাড়া তিস্তা নদী পাড়ের জেলা যেমন- নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধায়ও তারা কাজ করেছে।
তাদের পরিকল্পনায় দেখা যায়, তিস্তার দুই পাড়ে গাইড বাঁধের উভয় পাশেই থাকবে সমুদ্র সৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ। যাতে পর্যটকরা লং ড্রাইভে যেতে পারেন। এছাড়া এই রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহণ করা যাবে। নদীপাড়ের দু’ধারে গড়ে তোলা হবে আন্তর্জাতিক মানের হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী।
তিস্তা প্রকল্পটিতে এখনো পর্যন্ত যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
এগুলো হচ্ছে- ১. নদীগর্ভে ড্রেজিং করা, ২. রিভেটমেন্ট বা পাড় সংস্কার ও বাধানো এবং ৩. ভূমি পুনরুদ্ধার।
এছাড়া বন্যা বাঁধ মেরামতও পরিকল্পনায় আছে।
তাদের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ‘তিস্তা নদীর বিস্তৃতি কোন এলাকায় হয়তো পাঁচ কিলোমিটার, কোথাও দেড় কিলোমিটার বা কোথাও তিন কিলোমিটার আছে। সেক্ষেত্রে এই বিস্তৃতি কমিয়ে দেড় বা দুই কিলোমিটার কিংবা প্রকল্পের নকশায় যা আছে সে অনুযায়ী করা হবে।’
এর ফলে তিস্তার পারে থাকা শত শত একর জমি বা ভূমি পুনরুদ্ধার হবে যা ভূমিহীন মানুষ কিংবা শিল্পায়নের কাজে লাগানো হবে। সেই সাথে ড্রেজিং করে নদীর গভীরতা বাড়ানো হবে।
গভীরতা বাড়িয়ে এবং বিস্তৃতি কমিয়ে যদি একই পরিমাণ পানির প্রবাহ ঠিক রাখা যায় তাহলে নদীর পাড়ের জমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
পানির গুরুত্ব এতই বেশি যে ভবিষ্যতে পানি নিয়ে যুদ্ধও হতে পারে। স্কাই নিউজ ফাইট ফর ওয়াটার নামে ২০২২ সালে নিউজ করেছিলো। অতএব এই বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনোই সুযোগ নেই।
লেখক : ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।