শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনের ঘটনার পর বিশেষ পরিকল্পনা করছে সরকার। নতুন করে অত্যাধুনিক সুবিধাসহ একটি চারতলা কার্গো ভিলেজ নির্মাণের চিন্তা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ‘ফ্যাব্রিকেটেড স্ট্রাকচার’ তৈরি করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান প্রেজেন্টেশন দিয়েছে। সরকারের মূল লক্ষ্য হলো দ্রুত কার্গো ভিলেজ ঠিক করে তার কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা।

সম্প্রতি এ লক্ষ্যে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়েছে। সেখানে কার্গো ভিলেজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও দ্রুত কার্গো ভিলেজ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বিমানবন্দরে শুল্ক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য যে জায়গায় আমদানি ও রপ্তানির পণ্য রাখা হয়, তাকে কার্গো ভিলেজ বলা হয়। অনেক বিমানবন্দরে আমদানি ও রপ্তানির জন্য আলাদা আলাদা কার্গো কমপ্লেক্স থাকে। শুল্ক সম্পন্ন হওয়ার পর পণ্য চালান বুঝে নেন আমদানিকারক বা তাদের প্রতিনিধি। শুল্ক প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে পণ্য কতদিন কার্গো ভিলেজে থাকবে।
তবে কিছু ক্ষেত্রে পণ্য দ্রুত বিদেশে পাঠানোর প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ, তৈরি পোশাক মালিকেরা লিড টাইমের মধ্যে বিদেশি ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানোর জন্য বিমানযোগে পাঠান। তখন কখনও দুই তিন দিনের মধ্যে পণ্য কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে যায়। আবার কার্গো বিমানে জায়গা সংকটের কারণে রপ্তানিমুখী পণ্যকে কয়েক দিন কার্গো ভিলেজে রাখতে হয়। এজন্য রপ্তানিকারকরা কার্গো ভিলেজে জায়গার ভাড়া দিয়ে পণ্য কিছু দিন রাখেন। একইভাবে, আমদানিকারকরা শুল্ক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বা মালামাল খালাস করতে কয়েক দিন অপেক্ষা করতে পারেন, তখন তাদের পণ্য আমদানি কার্গো ভিলেজে থাকে।
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগুনে পুড়ে যাওয়া কার্গো ভিলেজের জায়গায় একটি আধুনিক ডিজাইনের চারতলা কার্গো ভিলেজ তৈরি করার প্রস্তাব এসেছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিষ্ঠান প্রেজেন্টেশন দিয়েছে, যেখানে নতুন ভবনের জন্য অনেক সুপারিশও এসেছে। সরকারের মূল লক্ষ্য হলো দ্রুত কার্গো ভিলেজ ঠিক করে কার্যক্রম শুরু করা এবং এর জন্য যা দরকার তাই করা হবে।
ফ্যাব্রিকেটেড স্ট্রাকচার তৈরি করা প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানান, আলোচনার দিন বিমানে একটি প্রেজেন্টেশন হয়েছে, কিন্তু এটিকে আনুষ্ঠানিক মিটিং বলা যাবে না। এই প্রেজেন্টেশনের মূল বিষয় ছিল কার্গো ভিলেজকে আধুনিক করা এবং পুনরুদ্ধারের কাজ। যেহেতু কার্গো ভিলেজে প্রচুর পরিমাণ পণ্য লেনদেন হতো, তাই এর কার্যক্রম দ্রুত আবার চালু করা জরুরি।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে দ্রুত কার্গো ভিলেজ চালু করাই সরকারের মূল লক্ষ্য। তবে আমরা সরাসরি প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত নই। আমরা অনানুষ্ঠানিকভাবে সেখানে গিয়েছিলাম। সরকারের পক্ষ থেকে শুধু জানতে চাওয়া হয়েছিল, কত দ্রুত কার্গো ভিলেজ পুনরায় চালু করা সম্ভব। সেই বিষয়ে তারা একটি ধারণা জানিয়েছে। প্রেজেন্টেশনে সরকারের জন্য কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। যেমন— দ্রুত দুটি কনসালটেন্সি নেওয়া, বর্তমান কাঠামোর অবস্থা মূল্যায়ন করা, একটি পরামর্শ কমিটি গঠন করে নতুন ডিজাইন তৈরি করা যাতে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করা যায় এবং একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজগুলো সম্পন্ন করা।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রকল্পের কাজ একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করবে। প্রথমে একটি তদন্ত হবে। বুয়েটে কাঠামোর অবস্থা পরীক্ষা করে একটি রিপোর্ট দেওয়া হবে, যার ভিত্তিতে বর্তমান অবস্থা (কারেন্ট কন্ডিশন) মূল্যায়ন করা হবে। এরপর কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে ভবিষ্যতে সেখানে কত কাজ হবে, কত জায়গা প্রয়োজন এবং সেই জায়গা কীভাবে ব্যবহার করা হবে। এরপর একটি টেকনিক্যাল কমিটি নতুন ডিজাইন তৈরি করবে। তারপর সরকারের নিয়ম অনুযায়ী ভেন্ডার নির্বাচন করে কাজ শুরু হবে। তবে সেদিনের আলোচনায় খরচের কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি, কারণ এখনও ঠিক হয়নি কী তৈরি করা হবে, তাই খরচ বলা সম্ভব নয়।
এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের কারণে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি)।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানিকারকরা কার্গো ভিলেজে নিরাপত্তাহীনতা, গুদাম ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থাপনা ও মালামাল চুরির অভিযোগ জানাচ্ছিলেন, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত। এ ঘটনায় ওষুধ, তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য, ফলমূল, হিমায়িত খাদ্যসহ অন্যান্য রপ্তানিকারক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা পেতে পারেন, যা ভবিষ্যতে রপ্তানি চুক্তি ও অর্ডারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগুনের ঘটনাটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত তদন্ত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা পুনরায় না ঘটে। এজন্য তারা কার্গো ভিলেজের আধুনিকায়ন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়ন, ওষুধ শিল্পের জন্য আলাদা শীতনিয়ন্ত্রিত গুদাম স্থাপন, নিরাপদ দূরত্বে রাসায়নিক গুদাম নির্মাণ এবং সম্পূর্ণ অটোমেটেড ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর গুদাম ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
তারা মনে করছেন, সরকার ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিশন গঠন করা খুবই জরুরি। এই কমিশন শুধু দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করবে না, বরং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর নীতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রণয়ন করবে। বিশেষভাবে ফায়ার সেফটি, আধুনিক গুদাম ব্যবস্থাপনা, সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ, জরুরি নির্গমন পথ এবং নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ড স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট কার্যকর নয় এবং এটি নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একইভাবে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নিরাপত্তা ঘাটতির কারণে শুধু ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে না, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের বিমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। যেসব পণ্য বিমা করা হয়নি, সেসবের জন্য সরকার একটি বিশেষ তহবিল গঠন করে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দিতে হবে। ভবিষ্যতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্গো ভিলেজ আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করতে হবে। এছাড়া ওষুধ শিল্পের জন্য আধুনিক শীতনিয়ন্ত্রিত আলাদা গুদাম তৈরি করা, নিরাপদ দূরত্বে রাসায়নিক গুদাম স্থাপন এবং কার্গো ভিলেজের গুদাম ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অটোমেটেড ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালনার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, এ অগ্নিকাণ্ডের দায় কেউ এড়াতে পারবে না। না বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি), না কাস্টম হাউস, না বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। কারণ সিএএবি কার্গো ভিলেজের মালিক, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমদানিকৃত পণ্যের তত্ত্বাবধায়ক, আর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস হলো হ্যান্ডলিং এজেন্ট।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার ঘটনায় ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। তার মতে, বাইরের বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট করার উদ্দেশ্য রয়েছে। পাশের কিছু দেশের স্বার্থ রয়েছে যাতে তাদের ব্যবসা ভালো হয় আর বাংলাদেশের ব্যবসা কমে যায়। এটি একটি ভূরাজনৈতিক ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, যার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাই কার্গো ভিলেজের গুদাম ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণ অটোমেটেড ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব মো. জাকির হোসেন বলেন, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ওষুধের কাঁচামাল পুড়ে গেছে। দেশে ৩০৭টি ওষুধ কোম্পানি আছে, যার মধ্যে ২৫০টি কোম্পানি সচল। একেকটি ওষুধ উৎপাদনে প্রায় ৫৩টি উপকরণ লাগে। ফলে ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল ক্ষতির কারণে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো— বিদেশি ক্রেতারা এই অগ্নিকাণ্ডের খবরে বাংলাদেশের পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়তে পারেন, যা রপ্তানি চুক্তি ও দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এই ঝুঁকি কাটাতে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের সন্ধান ও দায়মুক্তি বন্ধ করতে হবে। যাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল, তারা সাব্যস্ত হলে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এতে ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনা রোধে আরোপিত দায়বোধ কাজ করবে। একই সঙ্গে নিরাপত্তা ও গুদাম ব্যবস্থার ত্বরিত আধুনিকায়ন, বিমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে— এগুলো করলে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থাও ফিরবে এবং রপ্তানি ক্ষতির ঝুঁকি কমবে।
একই সঙ্গে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্গো ভিলেজ আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করতে হবে। ওষুধ শিল্পের জন্য আলাদা, আধুনিক শীতনিয়ন্ত্রিত গুদাম তৈরি করা, নিরাপদ দূরত্বে রাসায়নিক গুদাম স্থাপন এবং কার্গো ভিলেজের গুদাম ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অটোমেটেড ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালনা করা জরুরি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



