আরএম সেলিম শাহী: ‘জীবনে এমন ঢল দেখি নাই। আমরা নদীর পাড়ের বাসিন্দা, নদীর পাড়েই থাকি। প্রতিবছর বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামে, আর এই ঢলের পানিতে ভাটিতে বন্যা হয়। কিন্তু এইবার যে বন্যা হয়েছে তা জীবনেও দেখি নাই, মুরব্বীদের কাছেও শুনি নাই। এইবার যা হয়েছে তা ঢল বা বন্যা নয়, এ যেন এক জলোচ্ছাস। হঠাৎ করেই বিরাট বড় এক ঢেউ এসে নদীর পার উপচে বাড়ি ঘরে পানি উঠে যায়। মুহুর্তেই সব কিছু ডুবে যেতে থাকে। কোনমতে জীবনটা নিয়ে ঘর থেকে বের হই। ঘরের মধ্যে যা ছিল সবর ভেসে গেছে। পড়নের কাপড় ছাড়া কিছুই নিতে পারি নাই। ঘরটাও শেষ রক্ষা হয়নি। উঠানের মাটি খুঁড়ে বড় বড় গর্ত হয়ে সেখানেই দুমড়ে-মুচড়ে গেছে।’
এভাবেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের চেল্লাখালী নদী তীরবর্তী বাতকুচি গ্রামের বাসিন্দা সাজেদুল ইসলাম।
পাহাড়ি এ নদীর দুই তীর এলাকা শনিবার (১২ অক্টোবর) সরেজমিনে পরিদর্শনে গেলে দেখা যায় স্মরণকালের এক ভয়ঙ্কর চিত্র। দেখে বুঝার উপায় নেই, এখানে সুন্দর একটি বসতি ছিল। মানুষের জীবন ছিল স্বাভাবিক। নদীর দুই পাড়ে থাকা বাতকুচি গ্রামের বর্তমান অবস্থা দেখলে মনে হবে, পাহাড়ি ঢল নয়; উপকূলীয় এলাকার মতো সুনামী বয়ে গেছে নদীর তীরবর্তী এ গ্রামটিতে। শুধুমাত্র এ গ্রামের দুই তীরে থাকা প্রায় ২ শতাধিক বাড়িঘর এখন যেন ধ্বংসস্তুপ। নদী পাড়ের গাছগাছালি দেখলে মনে হয়, এসবের উপর দিয়ে ভয়াবহ টর্নেডো বয়ে গেছে। এক বিধ্বস্ত পল্লীর নাম এখন বাতকুচি।
নালিতাবাড়ী উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ভয়াবহ এ বন্যায় শুধুমাত্র নালিতাবাড়ীতে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ১৮৭টি বাড়ি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ হাজার ৬৮০টি বাড়ি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে ও পানির তোড়ের ধ্বসে পড়া ঘরের মাটির দেয়াল চাপায় মিলে মোট মারা গেছেন নারী ও শিশুসহ ৭ জন। এ উপজেলা ১২টি ইউনিয়নের সবক’টিই বন্যা কবলিত হয়। বন্যার কবল থেকে রেহাই পায়নি পৌরসভাও। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রূপনারায়নকুড়া, যোগানিয়া, মরিচপুরান ও কলসপাড় ইউনিয়ন। এসব ইউনিয়নের একটি আমন ধানক্ষেত এ একটি পুকুরও রক্ষা পায়নি। জেলার সবচেয়ে ভয়াবহ তান্ডব চলেছে এ উপজেলায়। ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঝিনাইগাতি উপজেলা। এ উপজেলায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাড়ির সংখ্যা ৫শ। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক হাজারের বেশি। বন্যার পানিতে ভেসে এসেছে অজ্ঞাত এক নারীর মরদেহ। এছাড়াও নকলা উপজেলায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ১১০টি বাড়ি। আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ২শ টি। এ উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে ৩ জন। জেলায় এবারের বন্যায় পানিতে ডুবে মারা গেছেন মোট ১২ জন। আমন ও সবজির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫শ কোটি টাকার। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে প্রায় ৭০ কোটি টাকার। সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাস্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শত কোটি টাকার। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) রাস্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১১৩ কোটি টাকার। সবমিলিয়ে এক ধ্বংসযজ্ঞ চলে শেরপুরে।
এমতাবস্থায় চিড়া-মুড়ির বেঁচে থাকার শুধুমাত্র সামান্য খাদ্য সহায়তা নয়, বসতবাড়িসহ পুনর্বাসন চান ক্ষতিগ্রস্থরা। তারা চান এখানে একটি স্থায়ী বেরিবাঁধ নির্মাণ করা হোক।
বাতকুচি গ্রামের গৃহবধূ মাহমুদা খাতুন জানান, ঘরবাড়ি সব ভেসে গেছে। বের হওয়ার রাস্তা পর্যন্ত ভেসে গেছে। এখন আমাদের চিড়া-মুড়ির দরকার নেই। দরকার ঘরবাড়ি। দরকার পুনর্বাসন। আরেক গৃহবধূ সালশা খাতুন জানান, আমরা ত্রাণ চাই না। পুনর্বাসন চাই। ঘরবাড়ি ফেরত চাই।
একই গ্রামের জামাল উদ্দিন জানান, ঘরবাড়ি সব বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এখন আমরা অন্যের বাড়ি থাকি। কেউ ছায়লা (চালা) বেঁধে থাকছে। কেউ অন্যের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে। বাড়িঘরের যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনদিন পুষিয়ে উঠতে পারব না। ঘরেওে টিনগুলো দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেছে। আর কোন কিছুই কাজে আসবে না।
অপর বাসিন্দা কামাল উদ্দিন জানান, গত শুক্রবার (৪ অক্টোবর) সকালে হঠাৎ করেই ঢলের পানি বাড়িঘর উপচে যেতে থাকে। এলাকাবাসী নিয়ে রাঁধের ইুপর আরও দুই ফুট মাটি দিয়ে বাঁধ দিয়েও ফেরাতে পারিনি। মুহূর্তেই সব ভেঙেচুড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পওে কোনমতে জীবন নিয়ে বেড়িয়ে গেছি। পাহাড়ি ঢলে ঘর তো নিয়েই গেছে। ঘরের আসবাবপত্রও নিয়ে গেছে। কিছুই রেখে যায়নি।
এ ব্যাপারে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা বলেন, হঠাৎ পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের পুণর্বাসনের জন্য উপজেলা প্রশাসন হতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে বরাদ্দ চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া বন্যার্তদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরনসহ ইতোমধ্যে বিভিন্ন ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।