স্পোর্টস ডেস্ক : প্রথম বলটির টাইমিং ঠিকঠাক হলো না। পরের ডেলিভারি অফ স্টাম্পের বাইরে লেংথ বল, দাপুটে পুল শটে চোখের পলকে তা উড়ে গেল ছক্কায়। অভিষেকের স্নায়ুর চাপ, রান তাড়ায় মাত্রই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানকে হারানো কিংবা প্রতিপক্ষের মাঠে গ্যালারি ভরা দর্শকের সামনে খেলা, কোনো চাপই পাত্তা পেল না। জেইক ফ্রেজার-ম্যাকগার্ক যেন ‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।’ আইপিএল অভিষেকে আগ্রাসী ফিফটি করে অস্ট্রেলিয়ার তরুণ এই ব্যাটিং প্রতিভা বললেন, এই টুর্নামেন্টের অভিজ্ঞতা উপভোগ করছেন তিনি দারুণভাবে।
আগ্রাসী মানসিকতা ও ঝড়ো ব্যাটিং দিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে বেশ আগেই ‘নতুন ম্যাক্সওয়ে’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন ফ্রেজার-ম্যাকগার্ক। এবারের আইপিএলে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এখনও পুরোপুরি নিষ্প্রভ রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে। কিন্তু দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে ‘নতুন ম্যাক্সওয়েল’ জ্বলে উঠলেন প্রথম সুযোগেই।
লাক্ষ্নৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে শুক্রবার ১৬৮ রান তাড়ায় ৫ ছক্কায় ৩৫ বলে ৫৫ রানের ইনিংস উপহার দেন ফ্রেজার-ম্যাকগার্ক। ৬ উইকেটের জয়ে তলানি থেকে এক ধাপ ওপরে উঠে আসে দিল্লি ক্যাপিটালস।
এ দিন তিনি উইকেটে যান ডেভিড ওয়ার্নার আউট হওয়ার পর। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট রাঙানোর পাশাপাশি আইপিএলেও যিনি সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যানদের একজন। এখন তার ক্যারিয়ারে চলছে গোধূলি বেলা। এই সময়েই শুরু হলো ফ্রেজার-ম্যাকগার্কের। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের দুই প্রজন্মের মেলবন্ধনও যেন হয়ে গেল আইপিএলে।
গত ডিসেম্বরে আইপিএলের নিলামে দল পাননি ফ্রেজার-ম্যাকগার্ক। পরে চোট পাওয়া লুঙ্গি এনগিডির বদলি হিসেবে তাকে দলে নেয় দিল্লি, যে দলের কোচ অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি রিকি পন্টিং। পেসারের বদলে একজন ব্যাটসম্যানকে যখন দলে নেওয়া হয়, তার প্রতিভার প্রতি দলের ভরসাই ফুটে ওঠে তাতে। ২২তম জন্মদিনের পরদিন আইপিএলে প্রথমবার খেলার সুযোগ পেয়ে সেই ভরসার প্রতিদান দিলেন ফ্রেজার-ম্যাকগার্ক।
ম্যাচের পর তরুণ এই ব্যাটিং সেনসেশন বললেন, মাঠে নামার অপেক্ষায় তর সইছিল না তার।
“গত পাঁচ-ছয় ম্যাচ বাইরে বসেই কাটাতে হয়েছে। খেলা দেখছিলাম আর মাঠে নামতে উসখুস করছিলাম। অবশেষে মাঠে নামতে পেরে এবং প্রথম ম্যাচেই জিততে পেরে আমি রোমাঞ্চিত।”
এই দলে কোচ হিসেবে তিনি যেমন পেয়েছেন পূর্বসূরী রিকি পন্টিংকে, তেমনি ‘মেন্টর’ হিসেবে পেয়েছেন ভারতীয় গ্রেট সৌরভ গাঙ্গুলিকে। তাদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করছেন তিনি। ম্যাচের পর জানালেন, প্রথম ম্যাচে নিজের সীমার ভেতর থাকার চেষ্টাই করেছেন তিনি।
“খুব বেশি কিছু করার চেষ্টা না করা, ভারসাম্য না হারানো… ব্যাটের মাঝখানে লাগানোর চেষ্টা করা। বল দেখে সেভাবেই সাড়া দেওয়া…। গত ১২ মাসে এভাবেই চেষ্টা করে গেছি। সেটি বদলাচ্ছি না।”
এই ১২ মাসে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে মূলত গত ৭-৮ মাসেই বদলে গেছে ফ্রেজার-ম্যাকগার্কের জগৎ। এই সময়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত নাম তিনি। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই অবশ্য তিনি নজর কেড়েছেন। স্রেফ ১৭ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে অভিষেক তার ভিক্টোরিয়ার হয়ে। দুটিতেই করেছেন ফিফটি। আগ্রাসী ব্যাটিং দিয়ে আলাদা করে নিজেকে চিনিয়েছেন তখন থেকেই। পরে খেলেছেন ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে।
এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে অসাধারণ ফিল্ডিং দিয়ে নজর কাড়লেও ব্যাট হাতে ধারাবাহিক হতে পারছিলেন না একদমই। ভিক্টোরিয়া থেকে এই মৌসুমে সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমানোর পর নিজেকে নতুনভাবে মেলে ধরেন তিনি। গত অক্টোবরে ক্রিকেট বিশ্বে সাড়া ফেলে দেন মার্শ কাপে ২৯ বলে সেঞ্চুরি করে। এবি ডি ভিলিয়ার্সের ৩১ বলের রেকর্ড পেছনে ফেলে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের ইতিহাসের দ্রুততম সেঞ্চুরি সেটি। ১০ চার ও ১৩ ছক্কায় সেদিন তিনি করেন ৩৮ বলে ১২৫।
কদিন পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরির স্বাদও পেয়ে যান বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান করে। এরপর বিগ ব্যাশেও তার ব্যাট ছিল উত্তাল। সেখানে ২৫৭ রান করেন তিনি ১৫৮.৬৪ স্ট্রাইক রেটে।
এরপর দেশের বাইরের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে অভিষেক হয়ে যায় তার সংযুক্ত আরব আমিরাতে আইএল টি-টোয়েন্টিতে। সেখানে অভিষেকে ২৩ বলে ৫৫ রানের ইনিংস খেলেন ৭ ছক্কায়।
‘নতুন ম্যাক্সওয়েল’ তকমা ততদিনে আরও জোরাল হয়ে গেছে তার সঙ্গে। কাকতালীয়ভাবে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে বিশ্রাম দেওয়াতেই জানুয়ারির শেষ দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের অস্ট্রেলিয়া দলে সুযোগ পেয়ে যান তিনি। সেই সিরিজে দুটি ওয়ানডে খেলে রান করেন ৫১। বড় রান না পেলেও বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের ঝলক দেখান সেখানেও। রান করেন তিনি ২২১.৭৩ স্ট্রাইক রেটে।
এগিয়ে চলার সেই পথ ধরেই এবার আইপিএল অভিষেকে আলোড়ন তুললেন।
তার প্রতিভার আলো ছড়িয়ে পড়লেও ব্যাটিংয়ের ঘাটতির জায়গাও বেশি কিছু ফুটে উঠেছে এর মধ্যে। আইপিএল অভিষেকে যেমন দেখা গেছে, পাওয়ার প্লের পর স্পিন বোলিংয়ের সামনে একটু আটকে গিয়েছিলেন। নিজের সেই ঘাটতিগুলোর কথা জানেন তিনি। মাত্রই ক্যারিয়ারের শুরু তার। প্রত্যয়ী কণ্ঠে বললেন শোনালেন উন্নতির তাগিদ।
“পাওয়ার প্লের পরের ব্যাটিংটা এখনও শেখার চেষ্টা করছি। স্ট্রাইক রেট ও প্রান্ত বদলানো নিয়ে কাজ করছি। অভিজ্ঞতার সঙ্গে এসব হয়তো আরও শিখব। বেশি বেশি ম্যাচ খেললে এসব কাজে লাগবে… প্রতিটি বলেই ছক্কা মারার চেষ্টা না করা…।”
আপাতত আইপিএলের অভিজ্ঞতা তিনি উপভোগ করছেন সবটুকু। কণ্ঠে রোমাঞ্চ আর মুখে হাসি নিয়ে বললেন, এমন কিছুর স্বাদ আগে কখনও পাননি।
“এখানে থাকতে পেরে আমি এত বেশি খুশি… ক্রিকেটের দিক থেকে এটা যেন পুরো ভিন্ন এক দুনিয়া। এরকম কিছু জীবনে কখনও দেখিনি আগে। শুনেছি অনেক, কিন্তু নিজে কখনও অভিজ্ঞতাটা পাইনি।”
“নিজে এই স্বাদটা পেয়েছি এবং আট সপ্তাহ বা আরও বেশি সময় এখানে থাকতে পারছি, এটা বলতে পারাটাও দারুণ… ভারতে এই সময়টা কাটাতে পারা এবং এই স্পেশাল লিগে খেলা…. অসাধারণ ব্যাপার।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।