অর্ণব সান্যাল : অন্ধকার জঙ্গলে শোনা যাচ্ছে নানা আওয়াজ। বন্য প্রাণির সাথে সাথে এমন শব্দও আছে, যেগুলো ঠিক প্রাণিজাত নয়। এর মধ্যেই চলছে ভয় তাড়ানোর আদি অকৃত্রিম অস্ত্র, আগুন জ্বালানোর কাজ। একজন জ্বালানোর চেষ্টা করছে। আর আরেকজন দিয়ে যাচ্ছে তাড়া। কারণ আগুন জ্বালাতে বেশি দেরি হলেই যে অন্ধকারে চাপা পড়ার ভয়!
এভাবেই শুরু হয় ‘ব্রামায়ুগম’। ভারতের মালায়লাম ভাষায় তৈরি এই সিনেমা গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় দেশটির সিনেমা হলগুলোতে। স্থানীয় দর্শকদের মধ্যে দারুণ আগ্রহ সৃষ্টি করে ছবিটি। ব্যবসাও করে চুটিয়ে। ১৩৯ মিনিটের ‘ব্রামায়ুগম’ তৈরিতে খরচ হয়েছে ২৭ কোটি রুপির কিছু বেশি। আর এক মাসের মাথায় শুধু সিনেমা হলগুলো থেকেই এর আয় প্রায় ৮৫ কোটি রুপি! চলতি মাসের ১৫ তারিখে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সনিলিভে মুক্তি পেয়েছে ‘ব্রামায়ুগম’।
সিনেমাটির গল্প গড়িয়েছে সতেরো শতকের ঔপনিবেশিক উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে। গায়ক হিসেবে জীবন পার করা তথাকথিত নিচু জাতের মানুষ থিবান। শুরুর দৃশ্যে তাকেই পাওয়া যায় আগুন জ্বালানোর প্রবল চেষ্টারত অবস্থায়। তবে আগুন জ্বালিয়েও নিজের সঙ্গীকে অশরীরীর হাত থেকে বাঁচাতে পারে না সে। থমকে যায় খরস্রোতা নদী পেরিয়ে ওপারে যাওয়ার চেষ্টাও। অভুক্ত থিবানের তখন জীবন বাঁচানোই দায়। এমন সময় তার চোখে পড়ে একটি প্রায় পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা বাড়ি। কেউ নেই ভেবে যখনই থিবান খাবার কুড়িয়ে খেতে যায়, তখনই দৃশ্যমান হয় দুজন ব্যক্তি। বোঝা যায়, ওই ভাঙা বাড়িতেও মালিক আছে। সেই মালিকের নাম কোডুমন পোট্টি। তার কথায় আশ্রিত হয় থিভান, মাথার ওপরে ছাদের পাশাপাশি খাবারও পায়। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই থিবান বুঝতে পারে, এক ভয়ংকর ফাঁদে আটকে গেছে সে। এ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে খুঁজতেই সে ধন্ধে পড়ে যায় যে, কে মানুষ আর কে–ই বা পিশাচ!
বর্তমানের রঙিন দুনিয়ায় ‘ব্রামায়ুগম’ নির্মিত হয়েছে সাদা–কালোতে। নানা রঙের এই পৃথিবীতেও শুধু সাদা ও কালো দিয়েও যে ভয়, আতঙ্ক ও রহস্যের যুগপৎ মিশ্রণ উৎপাদন করা যায় এবং তাতে দর্শকদের পুরো ১৩৯ মিনিটই বুঁদ করে রাখা যায়, সেটি এই সিনেমায় প্রমাণ হয়ে গেছে। ছবিটির পরিচালক রাহুল সদাশিবান। এর গল্পকারদের মধ্যেও তিনি অন্যতম। বলতেই হয় যে, ‘ব্রামায়ুগম’ সিনেমার গল্পে এক অদ্ভুত রহস্যময় জগত রাহুল সৃষ্টি করতে পেরেছেন। যদিও নিজের প্রতিভা এর আগে ‘ভূতাকালাম’ সিনেমাতেও দেখিয়েছিলেন রাহুল। এবার হয়তো সেটিরই চূড়ান্ত পর্যায় দেখা গেল।
‘ব্রামায়ুগম’ সিনেমার মূল প্রাণ কেবল তিনটি চরিত্র। থিবান ও কোডুমন পোট্টির কথা তো জেনেইছেন। এর বাইরে আছে কোডুমনের রাঁধুনির চরিত্র। এই তিন চরিত্রই পুরো গল্প দখল করে রেখেছে। দুই ঘণ্টারও বেশি সময়ের একটি সিনেমাকে মাত্র তিনটি চরিত্র দিয়ে টানটান করে রাখাও যে সে কম্ম নয়। আর এই অসাধারণ কাজটিই সম্ভব হয়েছে দুর্দান্ত স্টোরিলাইনের কারণে। এই সিনেমার আরেকটি দারুণ দিক হলো সিনেম্যাটোগ্রাফি ও সাউন্ড ডিজাইন। এ দুই ক্ষেত্রে এতই নিপুণ কাজ হয়েছে যে, নির্ভেজাল প্রশংসা করা ছাড়া কোনো যদি, কিন্তুর অবকাশ নেই।
এবার আসা যাক অভিনয় প্রসঙ্গে। এ জায়গায় একাধিপত্য অবশ্যই কোডুমন পোট্টিরূপী মামুটি’র। পুরো ছবিকে একাই টেনে নিয়ে গেছেন মালায়লাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এই কিংবদন্তি অভিনেতা। এই সিনেমায় তাঁর অভিনয় নিয়ে যে বিশেষণই ব্যবহার করা হোক না কেন, কম বলা হবে। বরং বিশেষণ দেওয়ার চেয়ে সিনেমাটি উপভোগে পুরো মনযোগ দিলে ভালো হবে। এমন দুরন্ত পারফরম্যান্স দেখতে পাওয়া যে বিরল ঘটনা! অবশ্য পুরো ছবিতে তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন অর্জুন অশোকান ও সিদ্ধার্থ ভারাথান। মামুটি’র সঙ্গে তাল মেলানোও তো আর সহজ কাজ নয়।
সবশেষে বলতেই হয় যে, ‘ব্রামায়ুগম’ দেখে শরীরে কাঁটা না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। শিহরিত আপনি হবেনই। সবচেয়ে বড় কথা, এই সিনেমা কিছুটা দেখে ভিডিও প্লেয়ারের পজ বাটনে চাপ দেওয়ার উপায় নেই। আসলেই যদি আপনি ভালো সিনেমা দেখতে চান, রহস্যের জালে হারাতে চান এবং রোমাঞ্চে শিউরে উঠতে চান ক্ষণে ক্ষণে, তবে দেখতেই হবে ‘ব্রামায়ুগম’। এই সিনেমা শেষ করতে করতে নতুন কিছু প্রশ্ন আপনার মনে জেগে উঠতেই পারে। সেটি হলো—পিশাচই কি কেবল অশুভ? নাকি তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সকল অশুভর নিয়ন্তা হতে চায় আসলে মানুষই? ক্ষমতা, তা ভালো হোক বা কালো, কে চায় না?
তাহলে আর দেরি কেন। দেখে ফেলুন ‘ব্রামায়ুগম’। দেখা শেষের পর কিছুটা সময় মোহগ্রস্ত হয়ে থাকার অগ্রিম নিশ্চয়তা রইল!
রেটিং: ৪.৫/৫
পরিচালক: রাহুল সদাশিবান
গল্প: রাহুল সদাশিবান
চিত্রনাট্য: টি ডি রামকৃষ্ণান ও রাহুল সদাশিবান
অভিনয়শিল্পী: মামুটি, সিদ্ধার্থ ভারাথান, অর্জুন অশোকান প্রমুখ
ভাষা: মালয়ালম
ধরন: হরর, থ্রিলার
মুক্তি: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ৎ
লেখক: সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।