জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাকসহ সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত। এতে ভারতে ঢুকতে না পেরে কিছু ট্রাক তৈরি পোশাকের চালান নিয়ে ফিরে আসতে শুরু করেছে। তবে ভারতের শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না।
সাধারণত প্রতিদিন প্রচুর ট্রাকের ভিড় থাকে সীমান্তে। এই সংখ্যা দৈনিক ২০০ ছাড়িয়ে যায় শীতকালে। নেপাল ও ভুটানে শীতের পোশাক বহনকারী ট্রাক এরই একটি বড় অংশ। তবে স্থলবন্দর দিয়ে পোশাক বাণিজ্য ভারত বন্ধ করলেও চালান পাঠানো যাবে নেপাল ও ভুটানে।
ভারতীয় সুতা বাংলাদেশ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধ করার পর ভারতও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। হিলি ও বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশে। দুই দেশের মধ্যে অসন্তোষের কারণ বাংলাদেশের উচ্চ ট্রানজিট চার্জ। ফলে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি এবং কাঁচামাল সংগ্রহে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো।
তবে সব মিলিয়ে এই বন্দর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব স্বল্পমেয়াদী হবে পোশাক খাতে। কারণ, এখনও শুল্কমুক্ত সুবিধায় ভারতে পোশাক রপ্তানি করতে পারে বাংলাদেশ। যেখানে প্রায় ২০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয় অন্যান্য দেশকে।
ভারতে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ওপর আমদানি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, তাদের ব্যবসা আগের ‘মতোই’ রয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় ফাস্ট মুভিং কনজ্যুমার গুডস বা এফএমসিজি (যা খুব দ্রুত ও কম দামে বিক্রি হয়) কোম্পানিগুলো। এমনকি, যাদের বিনিয়োগ আছে বাংলাদেশে, তাদের ক্ষেত্রেও।
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, এইচঅ্যান্ডএম, জারা, প্রাইমার্ক, ইউনিক্লো এবং ওয়ালমার্টের মতো শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে পোশাক সংগ্রহ করে, যার কিছু অংশ ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবেশ করে।
দীর্ঘদিন ধরে অসম প্রতিযোগিতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন ভারতীয় উৎপাদনকারীরা। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত কাপড়ের উপর ৫ শতাংশ জিএসটি (এক ধরনের শুল্ক) দেন তারা।
যেখানে বাংলাদেশি সংস্থাগুলো চীন থেকে শুল্কমুক্ত কাপড় আমদানি করে এবং ভারতে বিক্রির জন্য রপ্তানি প্রণোদনা পায়—এতে তারা আনুমানিক ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য কম ধরার সুবিধা পায়।
ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের মহাসচিব মিথিলেশ্বর ঠাকুর বলেন, তবে আসল সমস্যা হল বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলের (সাফটার) অধীনে ভারতে শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে কম মজুরি ও ভর্তুকি ব্যবস্থার কারণে কম উৎপাদন খরচের সুবিধা পাচ্ছে।
তবে বাংলাদেশের ওপর এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি উদ্যোগে আসলে লাভবান হতে পারে ভারতের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারকরা। ১৭ মে ভারত আরোপিত নিষেধাজ্ঞার আওতায় বাংলাদেশ মুম্বাইয়ের নক সেবা এবং কলকাতার (কিদারপুর ও হলদিয়া) বন্দর ছাড়া আর কোনো স্থল বা সমুদ্রবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পারবে না।
ফলে বাংলাদেশকে যদি পোশাক সমুদ্রপথে পাঠাতে হয় তাহলে পরিবহন খরচ বাড়বে। বাংলাদেশি পোশাকের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমতে পারে ভারতীয় বাজারে। পরিবহন স্থলপথের চেয়ে ধীরগতির হওয়ায় পণ্য পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে সমুদ্রপথে।
মিথিলেশ্বর ঠাকুর বলেন, লিড টাইম এর ফলে বাড়তে পারে। ভারতীয় খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তাদের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারে বাংলাদেশের সক্ষমতা।
ক্লথিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার সভাপতি সন্তোষ কাটারিয়া বলেন, পোশাক আমদানিতে বন্দর নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানাই আমরা। কারণ, এটি এখানে (ভারতে) কম দামি পোশাকের অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহ নিয়ে শিল্পের দীর্ঘদিনের উদ্বেগ দূর করবে। এই সিদ্ধান্তকে ‘সময়োপযোগী’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এটি ভারতের পোশাক উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াবে।
জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে কিছু নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে পোশাক আমদানি হয়ে থাকে। যেমন—পুরুষদের কটন ট্রাউজার এবং সিন্থেটিক ফাইবারের জ্যাকেট/ব্লেজার। এগুলো স্থানীয়ভাবে স্টাইল ইউনিয়ন এবং মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার ও জারার মতো অনেক খুচরা চেইন ও ব্র্যান্ডের জন্য আমদানি করা হয়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট পোশাক রপ্তানি ভারতে করেছে ৬৭৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৫৯৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের চেয়ে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
মিথিলেশ্বর ঠাকুর বলেন, এর মধ্যে আমদানির পরিমাণ শুধু পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ৫১৫ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার ছিল। যা বাংলাদেশ থেকে ভারতে মোট পোশাক আমদানির প্রায় ৭৬ শতাংশ।
ফলে স্থলবন্দরের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের পোশাকের প্রবেশাধিকার সীমিত হতে পারে ভারতীয় বাজারে। বিশেষ করে, এর কারণে বাংলাদেশের মাঝারি আকারের পোশাক কারখানাগুলো প্রভাবিত হতে পারে। এই কারখানাগুলো রপ্তানির জন্য স্থলপথের ওপর নির্ভরশীল। কারণ, এই পথ পরিবহনের জন্য সস্তা এবং কার্যকর, বিশেষ করে ছোট চালানের জন্য।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, যেহেতু কলকাতা এবং নব সেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে পোশাক আমদানি এখনও অনুমোদিত রয়েছে। তাই দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মূলত নির্ভর করবে স্থলবন্দর থেকে তৈরি পোশাক আমদানি কত দ্রুত এবং কী পরিমাণে সমুদ্রবন্দরে স্থানান্তরিত হয় তার ওপর। তবে আমদানি নিষেধাজ্ঞার তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব দেখছে না ভারতের এফএমসিজি কোম্পানিগুলো।
এফএমসিজি কোম্পানির এক ঊর্ধ্বতন নির্বাহী বলেছেন, দেশের (ভারতের) বেশিরভাগ এফএমসিজি কোম্পানি যারা বিনিয়োগ করেছে, স্থানীয় বাজারের জন্যই তারা উৎপাদন করে। তাই, তাদের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা কম আমদানি নিষেধাজ্ঞায়।
এদিকে, ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে নির্মাণ ও কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় বিলম্বের সম্মুখীন হতে পারে বাংলাদেশের প্রকল্প/সহযোগিতায় জড়িত ভারতীয় রেলওয়ে সংস্থাগুলো। রেলওয়ে প্রকল্পের জন্য পণ্য ও উপকরণ চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যা বাড়তে পারে, যা প্রকল্পের সময়সীমাকে প্রভাবিত করতে পারে।
২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভারতীয় রেলওয়ের রপ্তানি শাখা রাইটসের ক্রয়াদেশ ছিল ১ হাজার ৩৬০ কোটি রুপি। এর মধ্যে প্রধান আন্তর্জাতিক অর্ডারগুলো হলো—বাংলাদেশের জন্য ৯০০ কোটি রুপির ২০০টি যাত্রীবাহী কোচ, মোজাম্বিকের জন্য ৩০০ কোটি রুপির ১০টি লোকোমোটিভ এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তিনটি অর্ডার (প্রতিটি ৩টি লোকোমোটিভের জন্য) প্রায় ১৫০ কোটি রুপি।
অবগত এক ব্যক্তি বলেছেন, লোকোমোটিভ ও কোচ উভয় সরবরাহের প্রাথমিক কাজ এরই মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। উপরন্তু, আন্তঃদেশীয় প্রতিনিধি দলের সফর এবং চলমান দ্বিপাক্ষিক আলোচনা প্রকল্প সমন্বয় ও বাস্তবায়নকে আরও শক্তিশালী করছে।
২০২৫ অর্থবছরে, বাংলাদেশে ভারতীয় ইস্পাত রপ্তানি—মূলত অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য—৪২৫ কোটি টাকা বা ৫ লাখ ৬ হাজার টন ছিল। এর মধ্যে ৩ লাখ ৬৩ হাজার টন স্পঞ্জ আয়রন অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এক ব্যবসায়ী বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে সাধারণত স্পঞ্জ আয়রন বা বিলেটের নির্বাচিত সরবরাহ ব্যতীত খুব বেশি ফিনিশড স্টিলের অর্ডার আসে না। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে, এই রপ্তানিও প্রভাবিত হতে পারে বলে অনুমান করেন তিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।