পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ বান্দাকে তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা আদায়ের বিভিন্ন পদ্ধতি ও উপায়ও বলে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায়ের সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো তাঁর দরবারে সিজদায় অবনত হওয়া। এটা নবী-রাসুলদের সুন্নত ও প্রিয় আমল।
কৃতজ্ঞতার সিজদা কেন করতে হয়?
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, কৃতজ্ঞতার সিজদা সুন্নত, যখন বাহ্যিক নেয়ামত লাভ করে এবং বাহ্যিক বিপদ থেকে রক্ষা পায়। চাই সে নেয়ামত ও বিপদমুক্তি ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে বিশেষায়িত হোক বা সাধারণ মুসলমানের জন্য ব্যাপক হোক। (আল মাজমু : ৪/৭৭)
ইমাম শাওকানি (রহ.) বলেন, আল্লাহর নতুন লাভ করা নেয়ামত হলো যা পৌঁছানো ও না পৌঁছানো উভয় সম্ভাবনায় রয়েছে। এ জন্য নবীজি (সা.) সর্বদা আল্লাহর নেয়ামতের ধারা অব্যাহত থাকার পরও নতুন নেয়ামত লাভ করার পর (কৃতজ্ঞতার) সিজদা করেছেন।
আর প্রতি মুহূর্তেই আল্লাহর নতুন নেয়ামত বান্দা অর্জন করতে থাকে। (আস-সাইলুল জাররার, পৃষ্ঠা ২৮৬)
কৃতজ্ঞতার সিজদা কখন করতে হয়
শায়খ ইবনে উসাইমিন (রহ.) বলেন, এটা সবাই জানে, আল্লাহর নেয়ামতগুলো অগণিত। যেমনটি আল্লাহ বলেছেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করো তবে তা গণনা করে শেষ করতে পারবে না। (সুরা নাহল, আয়াত : ১৮)
মানুষকে যদি আল্লাহর প্রতিটি দয়া ও অনুগ্রহের বিপরীতে সিজদা করতে বলা হতো, তবে বান্দাকে যুগ যুগ ধরে সিজদায় পড়ে থাকতে হতো।
তবে এ ক্ষেত্রে সে এমন নেয়ামতের জন্য সিজদা করবে যা তার জন্য নতুন। যেমন মানুষ যখন সন্তান লাভ করে, তার বিয়ের ব্যবস্থা হয়, মুসলমানরা যখন আল্লাহর সাহায্য লাভ করে, নিরাশ হওয়ার পর যখন সে অদৃশ্যের সাহায্য লাভ করে অথবা সে কোনো সম্পদ লাভ করে ইত্যাদি। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতায় সিজদা দেওয়া মুস্তাহাব। (শরহু রিয়াজুস সালিহিন : ৫/১৭৮)
নবীজি (সা.)-এর জীবনে কৃতজ্ঞতার সিজদা
আল্লাহর কৃতজ্ঞতায় সিজদা করা ছিল মহানবী (সা.)-এর অন্যতম প্রিয় আমল। হাদিসের কিতাবে এসেছে, ‘যখন নবীজি (সা.) এমন জিনিস লাভ করতেন যা তাঁকে আনন্দিত করে, তিনি আল্লাহর কৃতজ্ঞতায় সিজদায় অবনত হতেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৭৭৬)
নিম্নে নবীজি (সা.)-এর জীবনে কৃতজ্ঞতার সিজদার কয়েকটি ঘটনা বর্ণনা করা হলো:
১. বারা ইবনে আজিব (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-কে ইয়েমেনে ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠান। বারা (রা.) বলেন, আমি খালিদ (রা.)-এর সঙ্গে বের হওয়া কাফেলায় ছিলাম। আমরা ছয় মাস সেখানে অবস্থান করে ইসলামের আহবান জানালাম। কিন্তু তারা সাড়া দিল না।
অতঃপর নবীজি (সা.) আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-কে পাঠালেন। তাঁকে নির্দেশ দিলেন খালিদ (রা.)-এর দলকে ফেরত পাঠাতে, তবে কেউ আলী (রা.)-এর সঙ্গে থাকতে চাইলে সে থাকতে পারবে। আমি আলী (রা.)-এর সঙ্গে থেকে গেলাম। আমি একটি গোত্রের কাছে গেলাম, তারা আমাদের দেখে বের হয়ে এলো।
আলী (রা.) আমাদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন। আমরা এক কাতারে নামাজ আদায় করলাম। তিনি আমাদের থেকে এগিয়ে গেলেন এবং গোত্রের লোকদের নবীজি (সা.)-এর চিঠি পাঠ করে শোনালেন। ফলে হামদান গোত্রের সবাই ইসলাম গ্রহণ করল।
আলী (রা.) নবীজি (সা.)-কে চিঠি লিখে তা জানালেন। যখন চিঠি পাঠ করে শোনাল হলো, তখন নবীজি (সা.) আল্লাহর কৃতজ্ঞতায় সিজদায় অবনত হলেন। অতঃপর সিজদা থেকে মাথা উঠিয়ে বললেন, হামদানের প্রতি সালাম, হামদানের প্রতি সালাম।
২. আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, আমি জিবরাইলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। সে আমাকে সুসংবাদ দিয়ে বলেছে, আপনার প্রতিপালক আপনাকে বলেছেন, যে ব্যক্তি আপনার প্রতি দরুদ পাঠ করে আমি তার প্রতি দরুদ পাঠ করি, যে আপনার প্রতি সালাম পাঠ করে আমি তার প্রতি সালাম পাঠ করি। ফলে আমি আল্লাহর কৃতজ্ঞতায় সিজদা করলাম। (আল মুস্তাদরাক, হাদিস : ২০৪৫)
৩. আমির ইবনু সাআদ (র.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি (সাআদ) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে মক্কা থেকে মদিনার দিকে রওনা হলাম। অতঃপর আমরা আজওয়ারা নামক স্থানের কাছে পৌঁছালে তিনি বাহন থেকে নেমে আল্লাহর কাছে হাত তুলে কিছুক্ষণ দোয়া করে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন।
তিনি অনেকক্ষণ সিজদায় থাকলেন। অতঃপর সিজদা থেকে উঠে পুনরায় মহান আল্লাহর কাছে হাত তুলে কিছুক্ষণ দোয়া করে আবার সিজদা করলেন এবং অনেকক্ষণ সিজদায় থাকলেন। আবার উঠে দুই হাত তুলে দোয়া করলেন এবং সিজদা করলেন।
বর্ণনাকারী বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরূপ তিনবার করলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি আমার রবের কাছে আবেদন করেছি এবং আমার উম্মতের জন্য সুপারিশ করেছি। আমাকে এক-তৃতীয়াংশ উম্মতের জন্য শাফাআতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আমি সিজদায় লুটিয়ে পড়েছি। আবার মাথা তুলে আমার রবের কাছে উম্মতের জন্য আবেদন করেছি। তিনি আমাকে আমার উম্মতের আরো এক-তৃতীয়াংশের জন্য শাফআত করার অনুমতি দিলেন।
আমি পুনরায় সিজদায় অবনত হয়ে প্রভুকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি পুনরায় মাথা তুলে আমার মহান রবের কাছে উম্মতের জন্য দোয়া করি। তিনি আমাকে আরো এক-তৃতীয়াংশ উম্মতের জন্য শাফাআত করার অনুমতি দেন। আমি আমার প্রভুকে সিজদা করে শুকরিয়া জানাই। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৭৭৫)
সাহাবিদের জীবনে কৃতজ্ঞতার সিজদা
মহানবী (সা.)-এর মতো সাহাবিরাও কোনো নেয়ামত লাভ করলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতায় সিজদা করতেন। যেমন তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার কারণে কাব বিন মালিক (রা.)-কে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়। এরপর যখন নবীজি (সা.) তাঁকে ক্ষমা লাভের সুসংবাদ দেন, তখন তিনি সিজদায় অবনত হন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭৬৯)
একইভাবে আবু বকর (রা.) মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন এবং ওমর (রা.) ইয়ামামার যুদ্ধের বিজয়ের সংবাদ পেয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। (তারিখুল ইসলাম)
আল্লাহ সবাইকে তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দা হিসেবে কবুল করেন। আমিন।
মো. আবদুল মজিদ মোল্লা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।