লাইফস্টাইল ডেস্ক : একটি বছরের আগমনে আরেকটি বছরের সমাপ্তি ঘটে। এই সমাপ্ত বছর আমাদের অনেক বার্তা দিয়ে যায়। অনেক কিছু ভাবতে শেখায়। তিক্ত অভিজ্ঞতা, সুখময় সব স্মৃতি, দুঃখ-বেদনার ঘটনাগুলো আমাদের উপহার দিয়ে সে বিদায় নেয়।
সব মানুষকে নিজের জীবনের হিসাব-নিকাশ করার সময় এসেছে, এই বার্তা দিয়ে সে আল-বিদা জানায়। বছরের পরিসমাপ্তি মানে ক্ষণস্থায়ী জীবনের একটি বসন্ত শেষ হওয়া আর মানুষও তার আসল গন্তব্যে ক্রমশই এগিয়ে চলে। কবি বলেন, দ্যাখো হে গাফেল! সময় বয়ে যায়,
কেমনে, কিভাবে তোমার জীবন গড়ায়।
শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘কিমাতুয যামান ইনদাল উলামা’-তে লিখেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমি কোনো জিনিসের প্রতি এতটা লজ্জিত ও অনুতপ্ত হই না, যতটা দিনের যবনিকাপাতে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হই।
কারণ একটি দিনের পরিসমাপ্তি মানে আমার এক দিন কমে যাওয়া এবং সেদিনে আমার আমল বৃদ্ধি না পাওয়া।’ (পৃষ্ঠা ২৭)
হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘হে আদম সন্তান, তোমরা তো হলে সময়ের সমষ্টি। যখন এক দিন অতিবাহিত হয়ে যায় তখন মনে করো যে তোমাদের একটি অংশও চলে গেছে।’ (প্রাগুক্ত)
যে সময় আল্লাহ তাআলা আমাদের দান করেছেন তা কেবল আখিরাতের প্রস্তুতির জন্যই দান করা হয়েছে। যাতে আমরা আখিরাতের প্রস্তুতি নিতে পারি এবং নিজেদের আমলকে পরিশুদ্ধ করে পারি।
আলী (রা.) বলেন, সময় হলো তোমাদের জীবনের পাণ্ডুলিপি। তোমরা এই পাণ্ডুলিপি নিজেদের ভালো কর্মের মাধ্যমে পূরণ করো। (আনমুল হিরে, পৃ. ১৬; মাতায়ে ওয়াক্ত আওর কারওয়ানে ইলম, পৃ. ৫৫)
মহানবী (সা.) বলেন, ‘মানুষের ইসলামের সৌন্দর্য (অর্থাৎ তার উত্তম মুসলিম হওয়ার একটি চিহ্ন) হলো অনর্থক (কথা ও কাজ) বর্জন করা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৭)
নববর্ষে আমাদের করণীয়
হাদিসের কিতাবে নতুন মাস ও নতুন বছরের প্রথম মাসসংক্রান্ত কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়।
যেমন নবী (সা.)-এর সাহাবিরা নতুন মাস বা নতুন বছরের প্রথম মাস এলে তাঁরা এই দোয়া পড়তেন।
‘আল্লাহুম্মা উদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি ওয়াল ঈমান ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম ওয়া রিদওয়ানিম মিনার রহমানি ওয়া জিওয়াযিম মিনাশ শায়তানি।’
অনুবাদ : হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মাঝে এ মাস বা বছরের আগমন ঘটান শান্তি ও নিরাপত্তা এবং ঈমান ও ইসলামের (ওপর অবিচলতার) সাথে; শয়তান থেকে সুরক্ষা ও দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে।
(মুজামুস সাহাবাহ খ. ৩, পৃ. ৫৪৩, বর্ণনা ১৫৩৯, মাকতাবা দারুল বায়ান কুয়েত; আলইসাবাহ ফী তাময়ীযিস সাহাবাহ, ইবনে হাজার আসকালানী, খ. ৪, পৃ. ২৫৬, দারুল জীল, বৈরুত, প্রথম সংস্করণ ১৪১২ হি.)
তাই আমাদেরও এই দোয়া পড়া উচিত। সেই সঙ্গে আরো দুটি কাজ বিশেষভাবে করা উচিত। যদি অন্য আঙ্গিকে বলি তাহলে বলতে হয় যে নতুন বছর আমাদের বিশেষভাবে দুটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। এক. অতীতের হিসাব-নিকাশ, দুই. পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি।
অতীতের হিসাব-নিকাশ
নতুন বছর আমাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানের হিসাব-নিকাশের প্রতি ইঙ্গিত দেয়। আমাদের জীবন থেকে যে একটি বছর চলে গেল, অতীত হয়ে যাওয়া বছরে আমরা কী অর্জন করেছি আর কী হারিয়েছি? পরকালীন জীবনের কী প্রস্তুতি নিয়েছি? কারণ নতুন বছরের আগমন মানে তো পরকালের যাত্রা আরেকটু ঘনিয়ে এসেছে।
আমাদের সবার উচিত হলো, নিজের জীবনের হিসাব কষা। ইবাদত-বন্দেগি, আচার-ব্যবহার, লেনদেন, আমল-আখলাক, হালাল-হারাম, আল্লাহ তাআলার হক ও বান্দার হক প্রভৃতি ব্যাপারে নিজেদের ভুলত্রুটি চিহ্নিত করা। আমরা তো অন্যদের দৃষ্টি হতে নিজেদের ভুলত্রুটি গোপন করতে পারব, কিন্তু নিজের দৃষ্টি হতে কখনো নিজেকে গোপন করতে পারব না। তাই মৃত্যু আসার আগেই আমাদের নিজেদের হিসেব-নিকেশ ক্লিয়ার করা চাই। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি তোমরা তা হতে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগে। অন্যথায় মৃত্যু আসলে সে বলবে, ‘হে আমার রব! আমাকে আরো কিছু কালের জন্য অবকাশ দিলে আমি সদকা দিতাম এবং সত্কর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম!’(সুরা : মুনাফিকুন, আয়াত : ১০)
পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি
নিজেদের হিসাব-নিকাশ করার পর ফলাফল অনুযায়ী ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করা এবং সেগুলো কিভাবে দূরীভূত ও সংশোধন করা যায় তার একটি খসড়া তৈরি করা। আর আসন্ন জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণে নিজেকে সদা তৎপর রাখা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘এবং মানুষ তাই পায়, যা সে করে।’ (সুরা : নাজম, আয়াত : ৩৯)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘পাঁচটি বস্তুকে পাঁচটির আগে গনিমত জেনে মূল্যায়ন করো; বার্ধক্যের আগে তোমার যৌবনকে, অসুস্থতার আগে তোমার সুস্থতাকে, দারিদ্র্যের আগে তোমার ধনবত্তাকে, ব্যস্ততার আগে তোমার অবসরকে এবং মরণের পূর্বে তোমার জীবনকে।’ (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান, হাদিস : ১০২৪৮)
মোটকথা, নতুন বছর একজন প্রকৃত মানুষকে আনন্দ-উল্লাসের পরিবর্তে চিন্তা-ভাবনার ডালি সাজিয়ে হাতে তুলে দেয়। তাকে ভাবতে শেখায় যে আমার জীবন ও বয়সের সীমারেখা ক্রমাগত ফুরিয়ে আসছে। গলিত বরফের মতো নিঃশেষের সীমা অতিক্রম করছে। জীবনে কিসের এত আয়োজন ও উৎসব? বরং তার আগেই যদি জীবনের সূর্যটি চিরতরের জন্য অস্তমিত হয়ে যায়! এমনি ভাবনার সাগরে নিমজ্জিত করে নতুন বছর। আর প্রকৃত মানুষেরা এই ভাবনাতেই অস্থির ও ব্যাকুল হয়ে পড়ে। মূলত এটিই নতুন বছরের পয়গাম, যা আমাদের সমীপে পেশ করে। যা সম্পর্কে আমরা উদাসীন।
আসআদ শাহীন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।