জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশের আকাশপথে একসময় যাত্রীদের আস্থার প্রতীক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল নভোএয়ার। স্থির, নির্ভরযোগ্য এবং সময়নিষ্ঠ সেবার কারণে এটি হয়ে উঠেছিল দেশের অন্যতম জনপ্রিয় বেসরকারি এয়ারলাইন্স। কিন্তু ২০২৫ সালের মে মাসে এসে সেই আস্থার ভিত্তি যেন নড়ে উঠেছে। নভোএয়ার হঠাৎ করেই তাদের ফ্লাইট চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে, যেটি শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের সংকটের নয়, বরং একটি সম্ভাবনার থেমে যাওয়ার উপাখ্যানও বটে।
Table of Contents
নভোএয়ার: এক সম্ভাবনার পতন
নভোএয়ার ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করেছিল অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই সময়নিষ্ঠ ফ্লাইট এবং উচ্চমানের গ্রাহকসেবার জন্য পরিচিত ছিল। ঢাকাকে কেন্দ্র করে তারা দেশের প্রধান প্রধান শহর যেমন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সৈয়দপুর, যশোর, সিলেট, রাজশাহীতে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করত।
তবে ২০২৫ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎ করে তাদের ফ্লাইট কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এক ঘোষণায় জানানো হয়, তারা আপাতত ফ্লাইট বন্ধ রাখছে এবং বহরে থাকা পাঁচটি এটিআর বিমান বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর ফলে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে—এই সাময়িক বন্ধ কি আসলে স্থায়ী বন্ধের ইঙ্গিত?
একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, গত ২০ এপ্রিল থেকে প্রতিষ্ঠানটি টিকিট বিক্রি বন্ধ করেছিল, পরে পুনরায় শুরু করে। কিন্তু ২ মে থেকে আবারো ফ্লাইট এবং টিকিট বিক্রি উভয়ই বন্ধ রয়েছে। এমনকি সংস্থার ওয়েবসাইটেও টিকিট কেনার অপশন নেই।
আর্থিক সংকটে নভোএয়ার
নভোএয়ারের এই হঠাৎ সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে চরম অর্থনৈতিক সংকট। কোম্পানিটি এর আগে আন্তর্জাতিক রুটে উড়োজাহাজ কিনে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও বিনিয়োগ সংকটে তাদের সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে বসেছে।
সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেছেন, বর্তমানে একটি নতুন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, যদি নতুন বিনিয়োগকারী নিশ্চিত করা যায়, তাহলে বিমান বিক্রি বন্ধ করে পুনরায় ফ্লাইট চালু করা সম্ভব হবে। অন্যথায় অন্তত তিন মাসের জন্য কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হতে পারে।
বিস্তারিত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছর বাদে নভোএয়ার প্রতিটি বছরেই লোকসান করেছে। মহামারী ও ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক কারণেও তাদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে বিমান লিজের বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, বিমান কেনার খরচ বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে যাত্রী চাহিদা হ্রাসসহ নানা কারণও যুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মঞ্জুর কবির ভূঁইয়া জানান, নভোএয়ারের ফ্লাইট আপাতত বন্ধ রয়েছে এবং তারা দুই সপ্তাহ পরে আবার চালু করতে চায়। তবে অর্থনৈতিক সমাধান না হলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।
বিমান বিক্রি এবং ভবিষ্যতের আশঙ্কা
বিমান বহর হ্রাস
নভোএয়ারের ৫টি এটিআর বিমানের বিক্রির সিদ্ধান্ত এটি একটি বড় সংকেত। একবার বিমান বিক্রি হয়ে গেলে নতুন বিমান না আসা পর্যন্ত ফ্লাইট পুনরায় চালুর কোনো সম্ভাবনা নেই। আর নতুন বিমান কেনা বা লিজে নেওয়ার জন্য এখন বাজারে চরম সংকট রয়েছে।
কর্মীদের অবস্থা
তবে একটি ইতিবাচক দিক হলো, কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই তিন মাসে সংস্থার কর্মী ও কর্মকর্তারা স্বাভাবিক বেতন পাবেন। এটি একটি মানবিক সিদ্ধান্ত হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নভোএয়ারের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছে নতুন বিনিয়োগকারীর আগমনের ওপর। প্রতিষ্ঠানটি যদি আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তাহলে হয়তো আবারও দেশের আকাশে উড়তে দেখা যাবে তাদের। তবে এই মুহূর্তে সেটা কেবলই এক অনিশ্চিত সম্ভাবনা।
অর্থনৈতিক সংকট এবং প্রতিযোগিতার চাপে বাংলাদেশের এভিয়েশন
নভোএয়ারের বর্তমান পরিস্থিতি বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতেও আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। বাংলাদেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনৈতিক টেকসইতা। একদিকে আন্তর্জাতিক লিজ মার্কেটের প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারের সংকুচিত চাহিদা তাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনাগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে অন্যান্য সংস্থার জন্যও শিক্ষণীয় দিক রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বিনিয়োগকারীর সঠিক নির্বাচন এবং বৈশ্বিক ট্রেন্ড অনুযায়ী নিজেকে রূপান্তর করাই হতে পারে এই খাতের ভবিষ্যৎ রক্ষার মূলমন্ত্র।
বিশ্বজুড়ে এভিয়েশন খাতের বর্তমান প্রেক্ষাপট
বিশ্বব্যাপী এভিয়েশন খাত এখনো মহামারী-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের পথে। ইউক্রেন যুদ্ধ, তেলের দাম বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক ভ্রমণ বিধিনিষেধসহ নানা কারণে এই খাত এখনও স্থিতিশীল হয়নি। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক এভিয়েশন পরিসংখ্যান অনুসারে, বহু ছোট-বড় সংস্থা একই রকম সংকটে পড়েছে।
তবে অনেক উন্নত দেশ তাদের নিজস্ব এয়ারলাইন্সগুলোকে সহায়তা দিয়ে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সরকারি ও বেসরকারি যৌথ প্রচেষ্টা এভিয়েশন খাতকে বাঁচাতে পারে।
নভোএয়ার–এর এই হঠাৎ পরিবর্তন কেবল একটি এয়ারলাইন্সের ইতিহাস নয়, বরং এটি বাংলাদেশের এভিয়েশন শিল্পের একটি শিক্ষা ও চ্যালেঞ্জের নিদর্শন।
যেসব পেজ/লেখা থেকে অভ্যন্তরীণ লিংক রাখা হয়েছে:
FAQs
- নভোএয়ারের ফ্লাইট কেন বন্ধ হয়েছে?
মূলত আর্থিক সংকট, বিমান বিক্রি এবং বিনিয়োগ সংকটের কারণে সাময়িকভাবে ফ্লাইট বন্ধ করা হয়েছে। - নভোএয়ার আবার চালু হবে কি?
নতুন বিনিয়োগকারী আসলে এবং বিমান না বিক্রি হলে ফ্লাইট পুনরায় চালুর সম্ভাবনা রয়েছে। - এই বন্ধ স্থায়ী হবে কি?
বর্তমানে এটি সাময়িক বলে জানানো হয়েছে, তবে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। - নভোএয়ারে কর্মরতদের কী অবস্থা?
তাদের স্বাভাবিক বেতন দেওয়া হচ্ছে, তবে দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। - এই সংকট অন্য এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য কী বার্তা দেয়?
দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক পরিকল্পনা এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রস্তুতি থাকা জরুরি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।