হামলার শিকার আহত নুরুল হক নুর একটি ভবনের সিঁড়িতে পা সামনে মেলে অসহায় বসে আছেন। তাকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে লাল শার্ট পরা এক যুবক। পাশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কেউ কেউ নির্বিকার তাকিয়ে দেখছেন। অন্যরা ব্যস্ত হাঙ্গামা সামলাতে। এর মধ্যে এক নারীকে নুরের দিকে এগিয়ে যেতে বাধা দিচ্ছেন একজন পুলিশের সদস্য।
এমনই ভিডিও ও ছবি ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আবার কিছু সূত্র ও মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে নুরের মতো দেখতে ওই ব্যক্তি নুর নন।
তবে প্রশ্ন উঠছে- এমন যুযুধান পরিবেশে পুলিশ-সেনার উপস্থিতিতে কে এই যুবক নুরকে পেটানোর সাহস পেল? নাগরিক অধিকারের নেতাকর্মী ও নেটিজেনরা বলছেন- এই যুবক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য না হয়ে পারে না। অনেকে বলছেন লোকটি জাতীয় পার্টি কিংবা আওয়ামী লীগের ক্যাডার। কেননা সেখানে অন্য কারও সংঘর্ষে জড়ানোর কোনো কারণ নেই।
তবে পুলিশ বলছে, এই লোকটিকে আগে একবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এখন তাকে খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু তার পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার (২৯ আগস্ট) রাতে রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নাগরিক অধিকার পরিষদের আওয়ামী লীগবিরোধী মিছিল চলাকালে তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় মারধরে মারাত্মকভাবে আহত হন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।
রক্তাক্ত নুর, তার ওপর হামলা ও পেটানোর ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই।
এর আগে সেখানে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে নাগরিক অধিকারের মিছিল যাওয়ার সময় জাতীয় পার্টির লোকজনের সঙ্গে এক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করে দুই দল। এ ঘটনার পর সেখানে পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
জাতীয় পার্টির হামলার প্রতিবাদে রাত নয়টার দিকে মশাল মিছিল বের করে নুরের দল। এরপরই ঘটে মিছিলে হামলা। এর শিকার হন নুরুল হক নুর।
এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রতি তীব্র সমালোচনা দেখা যায় নানা মাধ্যমে।
গণঅধিকার পরিষদের নেতারা অভিযোগ করেন, তাদের পূর্বনির্ধারিত মিছিলে জাতীয় পার্টির হামলার প্রতিবাদে রাতে কাকরাইলে মশাল মিছিল বের করেন তারা। দুই পক্ষের উত্তেজনার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের লাঠিপেটা করে।
নুরের ওপর হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘প্রথমে পুলিশ ও সেনা সদস্যরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। নুর মাটিতে পড়ার পর লাল টি-শার্ট পরা ওই যুবক বেধড়ক মারধর করে। যারা হামলা করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মীর আসাদুজ্জামান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ভিডিওতে দেখা ওই ব্যক্তি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে একসময় আটক হয়েছিল। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমরা তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি।’
এদিকে ফেসবুকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেরিফায়েড পেজে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উভয় পক্ষকে শান্ত থাকতে এবং শান্তিপূর্ণভাবে স্থান ত্যাগ করার জন্য বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কিছু নেতাকর্মী তা উপেক্ষা করে মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শান্তিপূর্ণ সমাধানের সব চেষ্টা তারা অগ্রাহ্য করে। ফলে জননিরাপত্তা রক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগে বাধ্য হয়। এই ঘটনায় সেনাবাহিনীর ৫ জন সদস্য আহত হন বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
সরকার সব ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারের এই সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করছে এবং সব ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে প্রস্তুত।
অন্যদিকে গুঞ্জন ছিল ওই যুবক ডিবিতে কর্মরত ছিলেন। তবে ডিবির প্রধান শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ওই যুবক ডিবির কেউ না। তাকে শনাক্তে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কাজ করছে।
নাগরিক অধিকারের মিছিলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনাকে পরিকল্পিত বলছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেস সচিব ও সিনিয়র সাংবাদিক মারুফ কামাল খান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পোস্টে তিনি গাঢ় লাল রঙের শার্ট পরা যুবকের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে লেখেন, তাকে ধরতে পারলে অনেক কিছুই জানা যাবে। জানা যাবে কারা পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি অশান্ত ও নিয়ন্ত্রণহীন করতে চাইছে। তাদের উদ্দেশ্যই বা কী!
এদিকে নাগরিক অধিকার পরিষদসহ রাজনৈতিক মহল থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, জাতীয় পার্টির লোকজনের সঙ্গে হামলায় অংশ নেয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
নুরের ওপর সংঘটিত ঘটনার আইনি তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। তিনি এই সহিংস ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সবাইকে সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সম্মিলিতভাবে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, এই ঘটনার মতো অস্থিতিশীল ঘটনাগুলো যেন আর না ঘটে এবং গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন নুরের জ্ঞান ফিরেছে। সিটি স্ক্যান পরীক্ষায় তার মাথায় আঘাত পাওয়া গেছে। নাকের হাড় ও ডান চোয়ালের হাড় ভেঙে গেছে। মাথার ভেতর রক্তক্ষরণ হলেও তা সামান্য। নুরের চিকিৎসায় একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।