জুমবাংলা ডেস্ক : শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দেওয়া স্বর্ণপদক প্রত্যাখ্যান করেছেন সাবেক ছাত্র মো. নুরুল হুদা। আজ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন থেকে তিনি এ ঘোষণা দেন।
নূরুল হুদার বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারি থানায়। তার বাবার নাম অহর উদ্দীন এবং মার নাম রহিমা বেওয়া। এলএলবি (সম্মান) পরীক্ষার ফলাফলে আইন অনুষদে প্রথম স্থান অর্জন করায় ২০১৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক এবং ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক অর্জন করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে নুরুল হুদা বলেন, রাবির ২০১৮ সালের ০৭/২০১৮ নম্বর শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে আইন বিভাগে আবেদন করার পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়মের শিকার হন তিনি। ওই নিয়োগে তার চাকরি হয়নি। ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড সম্পন্ন হয় এবং ওই নিয়োগ ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ৪৮৫তম সিন্ডিকেটে পাস হয়। ৮ নভেম্বর নুরুলের স্ত্রীকে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাব দেন নিয়োগ বোর্ডের অন্যতম সদস্য ও রাবির তৎকালীন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া। কিন্তু ওই প্রস্তাবে নুরুল রাজি হননি।
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক জাকারিয়ার ভাগ্নে ও ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক গাজী তৌহিদুর রহমান কৌশলে নুরুলের কাছ থেকে জিনিসপত্র মেরামত ও পোশাক নেওয়াসহ বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা নেন। নিয়োগ বোর্ডের আরেক সদস্য ও আইন বিভাগের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল হান্নান ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর নুরুলের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা ধার নেন বলেও সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত নুরুল হুদা জানান, অবৈধ আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাবের বিষয়ে নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও রাবির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবাহানকে জানানো হয়। কিন্তু উপাচার্য কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে অধ্যাপক আবদুল হান্নান ও উপ-উপাচার্য জাকারিয়াকে নিয়েই ১৩ নভেম্বর আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড সম্পন্ন করেন। তখন সুবিধাভোগী সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে আইন বিভাগের বনশ্রী রানী, সালাউদ্দিন সাইমুম ও নুর নুসরাত সুলতানাকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ এলএলবি (সম্মান) পরীক্ষার ফলাফলে নিয়োগপ্রাপ্ত সকলের থেকে নুরুল হুদা এগিয়ে ছিলেন। নিয়োগের পর সালাউদ্দিন সাইমুমের সঙ্গে উপ-উপাচার্য জাকারিয়ার মেয়ের বিয়ে হয় এবং নূর নুসরাত সুলতানার সঙ্গে আইন বিভাগের শিক্ষক শিবলী ইসলামের বিয়ে হয়। পরে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আইন বিভাগের ওই শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডটি অবৈধ বলে গণ্য করে।
উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিলেন দাবি করে নুরুল জানান, ওই নিয়োগে চাকরি না হওয়ার প্রায় ১০ মাস পর ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর নুরুলের অজ্ঞাতসারে তার স্ত্রীর কাছে উপ-উপাচার্য জাকারিয়ার অবৈধ আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাবের অডিও রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। তখন উপ-উপাচার্য নুরুলের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করেন। এরপর উপ-উপাচার্য জাকারিয়া ও উপাচার্য আবদুস সোবাহান চাকরি ও ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব দিয়ে বিষয়টি নিয়ে চুপ থাকতে বলেন। কিন্তু নুরুল তাদের অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি হননি। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত ইউজিসির তদন্ত কমিটির কাছে ২০২০ সালের ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর উপস্থিত হয়ে নুরুল ও তার স্ত্রী রাবির আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য এবং বিভিন্ন অনিয়মের যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেন।
ইউজিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ১ ও ২ নম্বর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, রাবির আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও উপাচার্য আবদুস সোবাহান, নিয়োগ বোর্ডের অন্যতম সদস্য ও উপ-উপাচার্য জাকারিয়া, উপ-উপাচার্য জাকারিয়ার ভাগ্নে গাজী তৌহিদুর রহমান এবং আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের আরেক সদস্য ও আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল হান্নানের বিরুদ্ধে আনা অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এরপর নিয়োগ বোর্ডটিকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণার পাশাপাশি উপাচার্য আবদুস সোবাহানের মেয়ে ও জামাতাসহ মোট ৩৪ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করে। এর পাশাপাশি উপাচার্য আবদুস সোবাহান, উপ-উপাচার্য জাকারিয়াসহ প্রায় হাফ ডজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে।
ইউজিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রাবি প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উপাচার্য আবদুস সোবাহান ২০২১ সালের ৬ মে তার শেষ কর্মদিবসে একইসঙ্গে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে ১৩৮ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার নজির সৃষ্টি করেন। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবারও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ওই নিয়োগের ঘটনায় প্রধান দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় উপাচার্য আবদুস সোবাহানকে এবং প্রধান সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তার জামাতা প্রভাষক এ টি এম শাহেদ পারভেজকে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে নিয়োগ কার্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। পরবর্তীকালে ২০২৩ সালের ২৫ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রাবির সব ধরনের নিয়োগের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাবি প্রশাসন আবারও নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করে এবং ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট আইন বিভাগে আবারও ৩টি পদে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে আক্ষেপ করে নুরুল হুদা বলেন, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য ও বিভিন্ন অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের প্রায় ৩ বছর পার হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া দুর্নীতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আইন বিভাগসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া স্বর্ণপদক প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলন শেষে পদক প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও ইউজিসির চেয়ারম্যান বরাবর দুটি পৃথক স্মারকলিপি দেন নুরুল হুদা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।