জুমবাংলা ডেস্ক : ঢাকার ধামরাই উপজেলার জনবহুল গ্রাম বাড়িগাঁও। গোধূলি আলোতেও কৃষকরা কাজ করেন মাঠে। গ্রামীণ জনপদে দিনের ব্যস্ততা শেষে যখন সন্ধ্যের চাঞ্চল্য নামার পথে, তখন সেখানে ছমছমে পরিবেশ। এটি এ জনপদের নৈমিত্তিক চিত্র না হলেও, গত চার দিন ধরে অবস্থা এমনই।
শনিবার বিকেলে গ্রামে গিয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হয় লাঠি হাতে পাহারারত কয়েকজনের সঙ্গে। সতর্ক দুই ব্যক্তি হনহন করে হেঁটে এলেন। জানালেন, শেয়াল সদৃশ এক প্রাণীর আক্রমণে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন ছেলে-বুড়ো সবাই। গ্রামটি ধামরাই সদর থেকে ৭-৮ কিলোমিটার দূরে।
বুধবার (১১ মে) প্রথমে এক নারীর (৩৭) ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একটি শিয়াল সদৃশ প্রাণী। আক্রমণে তিনি যখন ক্ষত-বিক্ষত তখন প্রতিবেশীরা লাঠি নিয়ে এসে প্রাণীটিকে তাড়ায়। ঘণ্টাখানেক পর একইভাবে প্রাণীটি হামলে পড়ে আরেক নারীর (৫৫) ওপর। তাকেও জখম করার পর সেটি ফের পালিয়ে যায়। এরপর ওই গ্রামে ঘুরে ঘুরে গত চার দিনে আরো অন্তত ৯ জনের ওপর আক্রমণ করেছে ‘অচেনা’ প্রাণীটি। এরপর থেকেই কৃষকরা ক্ষেতে যেতে ভয় পাচ্ছেন। এমনকি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে শিক্ষার্থীরা।
প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উভয় ধরনের ভুক্তভোগীর ধারণা প্রাণীটি শিয়াল। এ ঘটনার পর স্থানীয়দের হাতে কয়েকটি শিয়াল মারাও পড়েছে গত কয়েক দিনে। তবে আক্রমণ থামেনি। শনিবার বিকেলেও এক দম্পতির ওপর আক্রমণের চেষ্টা করে প্রাণীটি, তবে ঘটনাস্থলে আরো কয়েকজন থাকায় সেটি পিছু হটতে বাধ্য হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, গত বুধবারের প্রথম আক্রমণের জায়গাটিতে এখনো রয়েছে রক্তের দাগ। কথা হয় প্রথম আক্রমণের শিকার নারী রংমালার (৩৯) মা আয়েশা বেগমের সাথে। গ্রামের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ছোট খালের ধারে তাদের বাড়িটি ঝোপঝাড়ে ঘেরা।
আয়েশা বলেন, দুপুরের দিকে বাড়ির পাশে দেখতে এগিয়ে যেতেই ওই প্রাণীটি প্রথম তার মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরে পায়ে কামড় দেয়। তখন তার ডাক-চিৎকারে লাঠি নিয়ে অন্যরা এগিয়ে আসে এবং প্রাণীটিকে মারতে থাকে। পরে সেটি পালিয়ে যায়। এতে তার মুখ, গাল, ঠোঁট ও পা থেকে মাংস উঠে গেছে। পরে তাকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে অবস্থা ভালো নয়। প্রাণীটি শেয়াল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শেয়াল যেমন একটু লালচে রঙের হয়। তেমন না। মুখটা একটু চ্যাপ্টা রকমের।
এদিকে, ওই নারীকে আক্রমণের পরপরই রূপজান (৫৭) নামে আরেক নারীর ওপরেও হামলা চালায় ওই প্রাণীটি। তিনি বলেন, এখন তো বাইরে যেতেই ভয় পাচ্ছি। পায়ে ১৬টি সেলাই লেগেছে। এখন লাঠি ছাড়া বের হচ্ছি না। বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কীভাবে যাবে, যদি পথে আক্রমণ করে বসে!
একইদিন রাতে ওই গ্রামের আরেক পাড়ায় আক্রমণ চালিয়ে পাঁচ জন ও পরেরদিন বৃহস্পতিবার (১২ মে) আরো দুই জনকে আহত করে প্রাণীটি। আহত সবাইকে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ঘটনার পর থেকে গ্রামটিতে ওই প্রাণীর হামলার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিকেলের দিকে গরুর জন্য ঘাস নিয়ে ফসলের ক্ষেত থেকে ফিরছিলেন আয়নাল হক (৫৫) ও তার স্ত্রী জয়নব বেগম (৪৮)। এক হাতে ঘাসের বোঝার সাথে সাথে তাদের আরেক হাতে ছিল কাঠের লাঠি। কথা হয় তাদের সাথে।
জয়নব বলেন, গত ৩-৪ দিন ধরেই এলাকায় ওই প্রাণীর আক্রমণ হচ্ছে। ভয়ে রাতে বের হই না। এখন চলতে তো হবে। তাই ভয়ে ভয়েই বের হয়েছি। এমনিতে আমি (জয়নব) একাই ঘাস কাটি। কিন্তু আজকে স্বামীকেও নিয়ে আসছি। সে লাঠি নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি ঘাস কাটলাম। আমরা খুব আতঙ্কে আছি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, গত ৩-৪ দিন ধরে এলাকায় লোকজন ভয়ে আছে। শিয়াল সদৃশ প্রাণীর ভয়ে এরমধ্যে ২-৩টি শিয়াল মেরে ফেলছে এলাকার লোকজন। পাড়ায় পাড়ায় পাহারা বসানো হয়েছে। কিন্তু আসল প্রাণীটিকে এখনো ধরা যায়নি। এখন এলাকায় একটা আতঙ্ক পরিবেশ চলছে। আহতরাও নিজের মতো করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সরকারি কোনো সহযোগিতা পাননি। তিনি অবিলম্বে প্রশাসনকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
কুল্লা ইউনিয়নের বাড়িগাঁও এলাকার ইউপি সদস্য মহর আলী বলেন, বুধবার দিন বিকেলের দিকে আমি ঘটনাটা জানতে পারি। তারপরের দিনেও ওইটা আক্রমণ চালিয়েছে। এতে বাড়িগাঁও এলাকার ৯ জন আহত হয়েছে। কিন্তু ওইটা আসলে শিয়াল নাকি অন্যকিছু সেটা কেউ নিশ্চিত না। এখন স্থানীয়ভাবে মানুষ সচেতন হয়ে চলাফেরা করছে। তবে কোনো সমাধান আসেনি। একটা ভয়ে আছে মানুষ।
ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নূর রিফফাত আরো বলেন, ঘটনার দিন রাতেই একজন রোগী এসেছিল। তারা জানিয়েছিল শিয়ালে কামড় দিয়েছে। পরে জখম গুরুতর হওয়ায় তাকে ঢাকার হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে ধামরাই উপজেলা বন কর্মকর্তা মোতালিব আল মোমিন বলেন, খবর পেয়ে আমরা ওই এলাকায় যাই। পরে বর্ণনা শুনে বুঝেছি, সেটি শিয়াল ছিল। এরপর শুনেছি, সেটা এলাকাবাসী মেরে ফেলেছে। এখন আর আশঙ্কা নেই।
শনিবারও আক্রমণ হয়েছে এমন তথ্য জানালে তিনি বলেন, আমি এটি জানি না। তবে আমরা ওই এলাকায় সবাইকে বলেছি। আমরা রেডি আছি। ফের আক্রমণ হলে আমরা যাবো সেখানে।
স্থানীয় কুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান বলেন, আমি পরে জানতে পেরেছি। পরে সাথে সাথে ফায়ার সার্ভিস ও ইউএনও’কে জানাই। শুনেছি, সেটি ‘পাগলা শিয়াল’ হতে পারে। তবে এখন মনে হয় আর ভয়ের কিছু নেই। এ বিষয়ে ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী বলেন, বিষয়টি শুনেছি। দায়িত্বপ্রাপ্তদের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।