ধর্ম ডেস্ক : ওমরাহ পালনের সময় কিছু বিশেষ পরিভাষা বা শর্তাবলি রয়েছে, যা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর মাধ্যমে ওমরাহ করার পদ্ধতি সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য হবে।
নিচে সংক্ষেপে এর আলোচনা করা হলো—
ইহরাম
ইহরাম হলো হজ বা ওমরাহর নিয়তে তালবিয়া পাঠ করা। এ জন্য নির্ধারিত বিশেষ নিয়ম ও পোশাক ধারণ করা এবং নির্দিষ্ট কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা।
ইহরামের মধ্য দিয়ে হজ ও ওমরাহর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ইহরাম শব্দের আভিধানিক অর্থ নিষিদ্ধ করা। হজ ও ওমরাহ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি যখন হজ বা ওমরাহ কিংবা উভয়টি পালনের উদ্দেশ্যে নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করে, তখন তার ওপর কতিপয় হালাল ও জায়েজ বস্তুও হারাম হয়ে যায়। এ কারণেই এ প্রক্রিয়াটিকে ইহরাম বলা হয়।
তালবিয়া
তালবিয়া হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া, যা হাজিরা হজ বা ওমরাহর সময় ইহরাম বাঁধার পর থেকে মক্কায় প্রবেশের আগ পর্যন্ত বারবার পাঠ করেন। এটি হজ ও ওমরাহর অন্যতম শিআর (বিশেষ নিদর্শন) এবং ইবাদতের অংশ।
দোয়াটি হচ্ছে, ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক, লা শারিকা লাক।’
বাংলা অর্থ : আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির। আমি হাজির, আপনার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা, অনুগ্রহ ও রাজত্ব একমাত্র আপনারই। আপনার কোনো শরিক নেই।
মিকাত
মিকাত হলো কাবাঘরের চারদিকে নির্দিষ্ট স্থান বা সীমানা, যা হজ ও ওমরাহ পালনের জন্য পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করার পূর্বে ইহরাম বাঁধার স্থান হিসেবে নির্ধারিত।
এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান, যা প্রত্যেক হাজি বা ওমরাহ পালনকারীকে মেনে চলতে হয়। ইহরাম ছাড়া এই স্থান অতিক্রম করা জায়েজ নেই।
মিকাতের নাম ও অবস্থান
জুল-হুলাইফা : মদিনা থেকে মক্কার পথে প্রায় ৯ কিমি দূরে অবস্থিত। মক্কা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪৫০ কিমি। এটি মদিনা থেকে আগতদের জন্য নির্ধারিত মিকাত। বর্তমানে এটি ‘আবিয়ার আলী’ নামে পরিচিত।
জুহফা : মক্কার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত, যা মক্কা থেকে প্রায় ১৮৭ কিমি দূরে। (সিরিয়া, লেবানন, জর্দান) এবং মিসর থেকে আগতদের জন্য এটি মিকাত।
কারনুল মানাজিল : এটি তায়েফের নিকটবর্তী, মক্কা থেকে প্রায় ৭৫ কিমি দূরে। নাজদ ও পূর্বাঞ্চল থেকে আগতদের জন্য এটি মিকাত।
যাতু ইরক : মক্কার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত, যা মক্কা থেকে প্রায় ৯৪ কিমি দূরে। ইরাক এবং তার আশপাশ থেকে আগতদের জন্য এটি নির্ধারিত মিকাত।
ইয়ালামলাম : মক্কার দক্ষিণে অবস্থিত, যা মক্কা থেকে প্রায় ৯২ কিমি দূরে। ইয়েমেন ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে আগতদের জন্য এটি মিকাত।
মসজিদে হারাম
মসজিদে হারাম বাইতুল্লাহ শরিফের চারদিক থেকে যে বিশাল মসজিদ আছে তাই মসজিদে হারাম। ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান, যা সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে অবস্থিত। এটি পৃথিবীর প্রথম কিবলা এবং ইসলামের তিনটি পবিত্র মসজিদের মধ্যে অন্যতম। এখানে কাবা শরিফ অবস্থিত, যা মুসলমানদের ইবাদতের কেন্দ্রে রয়েছে।
হিল
হিল—যা মক্কা নগরীর আশপাশের সীমানা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি এমন একটি স্থান বা এলাকা, যা হারাম এলাকার বাইরে এবং মিকাতের ভেতরে সাধারণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত।
মাতাফ
মাতাফ শব্দের অর্থ হলো ‘তাওয়াফ করার স্থান’। এটি কাবা শরিফের চারপাশে অবস্থিত সেই বিশেষ এলাকা, যেখানে হাজি ও ওমরাহ পালনকারীরা কাবার চারপাশে ঘুরে তাওয়াফ করেন। খলিফা উমর (রা.) ও উসমান (রা.)-এর সময়ে মাতাফের জায়গা বড় করা হয়। বর্তমান সৌদি সরকার আধুনিক সময়ে মসজিদে হারামের সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে মাতাফকে বহুস্তরে রূপান্তর করেছে। এতে প্রতিদিন লাখো হাজি তাওয়াফ করতে পারেন।
তাওয়াফ
তাওয়াফ শব্দের অর্থ হলো ‘ঘুরে আসা’ বা ‘বৃত্তাকারভাবে প্রদক্ষিণ করা’। ইসলামে তাওয়াফ বলতে কাবা শরিফকে কেন্দ্র করে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে বোঝানো হয়। এটি হজ ও ওমরাহর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুকন। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তাওয়াফ করে, তার প্রতিটি পদক্ষেপে একটি গুনাহ মাফ হয় এবং একটি সওয়াব লেখা হয়।’ (তিরমিজি, হা : ৯৫৯)
হাজরে আসওয়াদ শব্দের অর্থ ‘কালো পাথর’। এটি একটি পবিত্র পাথর, যা কাবা শরিফের পূর্ব কোণে স্থাপন করা আছে। মুসলিমদের জন্য এটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ এবং ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। হাজরে আসওয়াদ তাওয়াফের শুরু এবং শেষের নির্দিষ্ট স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে এই হাজরে আসওয়াদ বরাবর মসজিদে হারামের দেয়ালে সবুজ বাতি লাগানো আছে, যা দেখে সহজেই হাজরে আসওয়াদের জায়গাটি নির্ণয় করা যায়।
রুকনে ইয়ামানি
রুকনে ইয়ামানি হলো কাবা শরিফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটি পবিত্র স্থান। এটি কাবার চার কোণের একটি, যা ইয়েমেনের দিকে মুখ করে আছে বলে এর নাম রাখা হয়েছে রুকনে ইয়ামানি। এই কোণটি তাওয়াফ করার সময় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানি ছাড়া আর কিছু স্পর্শ করতেন না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২৬৭)
রুকনে ইয়ামানি কাবা শরিফের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, যা তাওয়াফের সময় স্পর্শ করা সুন্নত।
হাতিম
হাতিম হলো কাবা শরিফের উত্তর-পশ্চিম দিকে একটি অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালযুক্ত স্থান, যা প্রায় দেড় মিটার উঁচু, যা কাবার অংশ হিসেবে গণ্য হয়। এটি কাবার ভেতরের একটি অংশ হলেও বর্তমান কাঠামোর বাইরে অবস্থিত। নবী করিম (সা.) বলেছেন, হাতিম কাবার অংশ।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫৮৪)
ইজতেবা
ইজতেবা আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো ‘কাঁধ খোলা রাখা’। ইসলামের হজ ও ওমরাহর সময় তাওয়াফে এটি একটি বিশেষ সুন্নত আমল। ইজতেবা পালনের মাধ্যমে পুরুষরা ইহরামের চাদর এমনভাবে পরিধান করেন, যাতে ডান কাঁধ প্রকাশিত থাকে এবং বাঁ কাঁধ ঢেকে রাখা হয়। এটি মূলত তাওয়াফের সময় পালন করা হয় এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি সুন্নত।
ইসতিলাম
ইসতিলাম হজ ও ওমরাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আমল, যা তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা, চুমু খাওয়া, বা দূর থেকে ইঙ্গিত করার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। আবার রুকনে ইয়ামানিকে হাত দ্বারা স্পর্শ করাকেও ইসতিলাম বলে।
রমল
রমল হলো তাওয়াফের সময় একটি বিশেষ ভঙ্গিতে প্রথম তিন চক্কর কাঁধ হেলিয়ে দ্রুতগতিতে হাঁটা। এটি পুরুষদের জন্য নির্ধারিত। রমলের মাধ্যমে দৃঢ়তা ও শক্তি প্রদর্শন করা হয়। এটি সাধারণ হাঁটার চেয়ে একটু দ্রুত, তবে দৌড়ানোর মতো নয়।
মুলতাজাম
মুলতাজাম অর্থ আলিঙ্গন বা জড়িয়ে ধরা। মুলতাজাম হলো, কাবা শরিফের সেই বিশেষ স্থান, যেখানে হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) এবং কাবা প্রাচীরের মধ্যে একটি স্থান। এই স্থান অত্যন্ত পবিত্র এবং এখানে দোয়া করা খুবই বরকতময়।
মিজাব
মিজাব অর্থ নালা। কাবা শরিফের ওপর একটি বিশেষ মিজাব আছে, যা কাবার ছাদ থেকে পানি প্রবাহিত করতে ব্যবহৃত হয়। এটি ‘মিজাব-ই-রাহমাত’ নামে পরিচিত।
মাকামে ইবরাহিম
মাকামে ইবরাহিম হলো কাবা শরিফের পূর্ব দিকে তথা হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানির মাঝ বরাবর একটি পবিত্র স্থান, যেখানে নবী ইবরাহিম (আ.)-এর পায়ের ছাপ (একটি পাথর) সংরক্ষিত আছে। এটি মক্কা শহরের মসজিদুল হারামে অবস্থিত। এই স্থান ইসলামী ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মুসলমানদের জন্য একটি পবিত্র স্থান। মাকামে ইবরাহিমের সামনে দুই রাকাত নামাজ পড়া সুন্নত।
সাফা-মারওয়া
সাফা ও মারওয়া হলো দুটি পাহাড়, যা মসজিদুল হারামসংলগ্ন অবস্থিত। এ দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে হজ ও ওমরাহ পালনের সময় সাঈ করা হয়। সাফা ও মারওয়া মধ্যে সাতবার সাঈ (দৌড়ানো) ওয়াজিব। বর্তমানে এ দুটি পাহাড় কাচ দিয়ে ঘেরা আছে।
দম
ওমরাহর দম হলো, হজ ও ওমরাহর আমলে নির্দিষ্ট কোনো ভুল হলে বা ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ করে ফেললে হারাম শরিফের সীমানায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দম দিতে হয়। আর তা একটি ছাগল, দুম্বা বা উট-গরুর সাত ভাগের একভাগ জাবাই করার মাধ্যমে দিয়ে থাকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।