জুমবাংলা ডেস্ক : হাঁসের মাংসের স্বাদ বদলে দিয়েছে জায়গার নাম। রাণীর ঘাটের মোড় বদলে হয়ে গেছে ভাবির মোড়। স্বামীর সঙ্গে চা, বুট বিক্রি শুরু করেছিলেন তসলিমা বেগম। প্রথমে ভাত-তরকারির পাশাপাশি চালু করেন হাঁসের মাংস বিক্রি। সেই হাঁসের মাংসের স্বাদের সুনাম এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে তসলিমার মতো আরো ছয় জন নারী সেখানে শুরু করেন হাঁসের মাংস বিক্রি। ঐ স্থানের নামই হয়ে যায় ভাবির মোড়। শুধু এটুকু বললে কম বলা হয়।
যেখানে বিশ্ব জুড়ে বলা হচ্ছে নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলার কথা, সেখানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল দিনাজপুরের বোচাগঞ্জের এই ভাবির মোড়ের হোটেলগুলোর মালিক থেকে সব কর্মচারীই নারী। দেশে নারীর কর্মসংস্থানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই সাত নারী উদ্যোক্তা।
হোটেলে নেই কোনো পুরুষ কর্মচারী, খাবার পরিবেশন করা, ক্যাশে টাকা নেওয়াসহ সব কাজ করেন নারী শ্রমিকরা। হোটেল ব্যবসা করে ‘ভাবিরা’ হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী। রানীরঘাট তথা ভাবির মোড়ে প্রথম দিকে দুই থেকে তিনটি হোটেল থাকলেও বর্তমানে এখানে সাত জন ভাবি সাতটি হোটেল করেন। তাসলিমা বেগম শুরু করেছিলেন। এরপর একে একে মাসতারা বেগম, মেরিনা পারভীন, রাজিয়া বেগম, বেলি আক্তার, লিপি বেগম ও কুলসুম নামে সাত জন নারী হোটেল দিয়েছেন। এই নারীরা যেমন পালটে দিয়েছেন জায়গার নাম, তেমনি পরিবর্তন করেছেন নিজেদের ভাগ্যও। অনেকেই তাদেরকে দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন, হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তা।
ভাবিদের হোটেল সস্তা ও সুস্বাদু হাঁসের ভুনা মাংসের জন্য বিখ্যাত। ভাবির মোড় বর্তমানে এতটাই প্রসিদ্ধ যে, এখানে প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক হাঁস রান্না করা হয়, মাসে যা ৬ হাজারের বেশি। এতে মাসে এসব দোকানের গড় বিক্রি ৭০ লাখ টাকা দাঁড়ায়। এখানকার প্রতিটি হোটেলে প্রতিদিন জবাই হয় ৫০ থেকে ৬০টি হাঁস। বেচাবিক্রি হয় দিনে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। তবে সরকারি ছুটির দিনে বেচাবিক্রি আরো বেশি হয়।
শহর থেকে একেবারে অজপাড়াগাঁ ভারত সীমান্তঘেঁষে এই ভাবির মোড়। দেখা যায় হোটেলগুলোতে বসার জায়গা না পেয়ে অনেকেই খাবারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
দিনাজপুর শহর থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে ভারত সীমান্তঘেঁষে বয়ে চলেছে টাঙ্গন নদ। নদের ওপরে নির্মিত হয়েছে সেতুসহ রাবার ড্যাম। এর পশ্চিম প্রান্তে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার রাণীর ঘাট মোড় আর পূর্ব প্রান্তে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার সুপরিচিত স্থান এই ভাবির মোড়। সেতু পার হলেই চোখে পড়বে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। ভ্রমণপিপাসুদের চোখ জুড়াবে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
ভাবিদের হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন সেখানে মোটরসাইকেল, অটোগাড়ি এবং প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসযোগে আসছেন। অনেকে সপরিবারেও আসছেন। হোটেলগুলোতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার খাবারের প্যাকেজ। যে যেমন ইচ্ছা ভাত, হাঁসের মাংস ও বিভিন্ন প্রকার সালাদ, শাকসবজি এবং নানান রকমের ভর্তা খেতে পারেন।
জানা যায়, এই স্থানটির নাম ছিল রাণীর ঘাট। প্রায় ২৫ বছর আগে এই নদীর ঘাটে শুকনো মৌসুমে উত্তোলন হতো বালু। প্রতিদিন এই ঘাটে ৬০ থেকে ৭০টি ট্রাক্টর দিয়ে শ্রমিকরা বালু উত্তোলনের কাজ করতেন। তবে রাণীর ঘাটে ছিল না তখন কোনো চা-নাস্তার দোকান। জীবিকার তাগিদে তখন প্রথম জামাল উদ্দিনের স্ত্রী মাসতারা বেগম একটি চায়ের দোকান দেন। ঘাটের রাস্তাটি ছিল কাঁচা। পরবর্তী সময়ে রাস্তাটি পাকা করার কাজ শুরু হয়। রাস্তার শ্রমিকদের জন্য তার ছোটো হোটেলে শুরু হয় ভাত বিক্রি। শ্রমিকদের অনুরোধে প্রথমে রান্না করেন একটি হাঁসের মাংস। তার হাতের রান্না খেয়ে মুগ্ধ তারা।
এর পর থেকে শুরু হাঁসের মাংস বিক্রি। অল্প দিনের মধ্যে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে মাসতারা বেগমের হাতের সুস্বাদু হাঁসের মাংস রান্নার খবর। পরে তাকে দেখে এলাকার আরো তিন ভাবি হাঁসের মাংসের হোটেল দেন। প্রথম থেকেই এই চার মহিলাকে সবাই ভাবি বলে সম্বোধন করতেন। মূলত তখন থেকে হোটেলগুলোর নাম হয় ভাবির হোটেল। আস্তে আস্তে রাণীর ঘাট নামটি পরিবর্তন হয়ে ভাবির মোড় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এলাকার মানুষের কাছে। দিনাজপুর জেলাসহ আশপাশের সব জেলার মানুষ এই ভাবির মোড়কে চেনে এবং জানে। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন ভাবির মোড়ের ভাবিদের হোটেলে হাঁসের মাংস দিয়ে খাবার খেতে।
এখানকার হোটেল মালিক মাসতারা বেগম বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ এই মোড়ে আমরা হোটেল ব্যবসা করে আসছি। আমরা সব সময় কাস্টমারের মনমতো ও রুচিসম্মত খাবার পরিবেশন করে থাকি। কাস্টমার আমাদের লক্ষ্মী। জীবনে আমরা একসময় অনেক অভাবী এবং অসহায় ছিলাম। বর্তমান হোটেল ব্যবসা করে আমরা সবাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি বলেন, আমরা সবাই মিলেমিশে ব্যবসা করছি। আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, সবাই সবার মতো কর্ম করে খাচ্ছি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাবির মোড়ের কথা জানতে পেরে ঠাকুরগাঁও থেকে এসেছেন মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর পরিবার। এ পরিবারের অপর সদস্য জয়নাল আবেদীন বলেন, জায়গাটি অনেক সুন্দর। ফেসবুকে জানতে পারি, ভাবির মোড়ে মজাদার হাঁসের মাংস পাওয়া যায়। খাবারও মানসম্মত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।