জুমবাংলা ডেস্ক : ভারতে রপ্তানিমূল্য বেঁধে দেওয়ার খবরে বাংলাদেশে হু হু করে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। দুদিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩০ টাকা পর্যন্ত। এতে আগে থেকে বেড়ে থাকা নিত্যপণ্যটি নিয়ে আরও অস্থিরতা শুরু হয়েছে।
ভারত এমন সময় পেঁয়াজের রপ্তানিমূল্য বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে, যখন বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজ বেশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছিল। প্রতিবেশী দেশের এই সিদ্ধান্ত যেন পেঁয়াজের বাজারে ‘আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া’ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মূলত নিজ দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ ও দাম ঠিক রাখতে রপ্তানির ন্যূনতম মূল্য বেঁধে দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। গতকাল রোববার থেকে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিটন পেঁয়াজের রপ্তানিমূল্য ৮০০ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও এ বর্ধিত দামের পেঁয়াজ এখনো দেশের বাজারে আসেনি। তবে নতুন মূল্যের পেঁয়াজ আসুক বা না আসুক, দাম বাড়ার খবর পেয়েই ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে থাকা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সোমবার (৩০ অক্টোবর) খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়, যা গতকাল রোববার ১০ টাকা কম ছিল। একই পেঁয়াজ (দেশি) গত শুক্র ও শনিবার বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা প্রতিকেজি। শুক্র ও শনিবার ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, যা পরের দিন ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় ওঠে। আমদানি করা এসব পেঁয়াজ আজ সোমবার ১২০ থেকে ১২৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
রামপুরা ভাই ভাই স্টোরের কালাম হোসেন বলেন, ‘রোববার ভারতে দাম বেড়েছে এমন খবরে পাইকারদের কাছ থেকে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে যা ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। আজ আরও দাম বেড়েছে শুনছি।’
তিনি বলেন, ‘দাম বাড়ার খবরে আমদানি করা পেঁয়াজ পাইকারি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। ওইসব পেঁয়াজের দাম দেশি পেঁয়াজের তুলনায় আরও বেশি বেড়েছে।’
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন বলেন, ‘গত সপ্তাহে পূজার ছুটির কারণে বেশ কয়েকদিন বন্দর বন্ধ ছিল। তখন থেকেই পেঁয়াজের ঘাটতি শুরু। এরমধ্যে আমদানিমূল্য বাড়ানোর খবরে বাজার একদম অস্থির হয়ে গেছে। বাজারে পেঁয়াজের সংকট দেখা দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশি পেঁয়াজের মৌসুম শেষের দিকে। এখন আমদানি পেঁয়াজই ভরসা। এই অবস্থায় ভারতের এ সিদ্ধান্ত ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এর আগেও যখন ভারত দাম বাড়িয়েছে, দেশে চড়ামূল্য দিতে হয়েছে। তিনশ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছিল।’
এর আগে ২০১৯ সালে ভারত রপ্তানিমূল্য ৮৫০ টাকা বেঁধে দিয়েছিল। তখন পেঁয়াজের বাজার সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে। সেসময় বাজার সামাল দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে দেশের বড় বড় শিল্পগ্রুপকে পেঁয়াজ আমদানি করতে অনুরোধ করে সরকার। ওই বছর এস আলম ও সিটি গ্রুপ কার্গো বিমান এমনকি যাত্রীবাহী বিমানেও পেঁয়াজ আমদানি করে। আমদানি করা এসব পেঁয়াজ ভর্তুকি মূল্যে টিসিবিকে দিয়ে সারাদেশে বিক্রি করা হয়।
চলতি বছরেও দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত সেপ্টেম্বরে সরকার পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে ৬৪-৬৫ টাকা। তবে সে দাম বাজারে কার্যকর হয়নি কখনো। গত সপ্তাহের আগে পর্যন্ত ৭০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে ছিল দাম। তবে এখন নির্ধারণ করা দামের চেয়ে দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে পেঁয়াজ।
যদিও ভারতে নতুন দাম ঘোষণার পর সেই পেঁয়াজ এখনো দেশে আসেনি। অর্থাৎ আগের দামে আমদানি করা পেঁয়াজই এখন বাজারে। তবুও দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। অর্থাৎ যৌক্তিক কারণ ছাড়াই এভাবে অতিরিক্ত দাম বাড়িয়েছেন কতিপয় ব্যবসায়ী। তারা এই কারসাজি করে ভোক্তার পকেট থেকে স্বল্প সময়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা এও জানিয়েছেন, বাড়তি দামে আমদানি করা পেঁয়াজ আসতে আরও তিন থেকে চারদিন সময় লাগবে। এরমধ্যে বাজারে যত পেঁয়াজ কেনাবেচা হবে তা আগের দামেই কেনা।
জানতে চাইলে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘ভারত মূল্যবৃদ্ধি করলেও নতুন দামের পেঁয়াজ এখনো দেশে আসার কথা না। তবে অসাধু ব্যবসায়ীরা খবর পেয়েই দাম বাড়িয়েছেন। তারা পেঁয়াজের দাম নিয়ে কারসাজি করছেন, অতিরিক্ত মুনাফা করছেন।’
তিনি বলেন, ‘আসলে বাজারে তদারকি সংস্থার কোনো নজরদারি নেই। দাম বেঁধে দিয়েও সেটা তারা কার্যকর করতে পারেনি। এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। পরিস্থিতি এমন হয়েছে- বাজারে যেন কারও নিয়ন্ত্রণ নেই।’
জানা গেছে, ভারতে প্রতিটন পেঁয়াজের দাম ৮০০ ডলার হলে কেজিপ্রতি এর রপ্তানিমূল্য পড়বে ৬৭ রুপি। আগে ভারতের রপ্তানিকারকরা অনির্ধারিত মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারলেও নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশটির ব্যবসায়ীদের সরকার নির্ধারিত দামেই পেঁয়াজ বিক্রি করতে হবে। এর আগে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল। তখন থেকেই বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।
সরকার দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ও উৎপাদনে বেশ সামঞ্জস্যের কথা বললেও মূলত বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার ভারতের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ ৮৬ হাজার টন। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন। দেশে যত পেঁয়াজ উৎপাদন হয় তা থেকে নষ্ট হয়ে যায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ, যা ৮ থেকে ৯ লাখ টন। মোট উৎপাদন থেকে নষ্ট হওয়া পেঁয়াজ বাদ দিলে দেশে উৎপাদিত নিট পেঁয়াজ থাকে ২৪ থেকে ২৫ লাখ টন। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি করা হয় ৭ লাখ ৪৩ হাজার টন পেঁয়াজ।
বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি ও পেঁয়াজ আমদানিকারক হারুন উর রশীদ বলেন, ‘ভারতের এ সিদ্ধান্তে পেঁয়াজের বাজারে আবারও আগুন লেগেছে। ন্যূনতম মূল্য ৮০০ ডলারে আমদানি করলে দেশে আসতে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৯০-১০০ টাকার মতো পড়বে। যা আগে ৪৫-৫৫ টাকার মধ্যে কেনা যেত।’
তিনি বলেন, ‘আগে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির নির্ধারিত মূল্য ছিল টনপ্রতি ৩৫০ ডলার। কিন্তু শনিবার সন্ধ্যায় ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানির ন্যূনতম মূল্য বাড়িয়ে ৮০০ ডলার করেছে। এর ফলে ৩৫০ ডলারে করা এলসিও (ঋণপত্র) বাতিল হয়ে যায়। টনপ্রতি ৮০০ ডলারের পর উভয় দেশে শুল্ক পরিশোধ, পরিবহন খরচ ছাড়াও ঘাটতি হিসাব করে পেঁয়াজের দাম সমন্বয় হয়েছে। বাজারে দাম বেড়েছে।’
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভারতের বিকল্প বাজার খুঁজতে আগে থেকেই আরও ৯টি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া রয়েছে গত আগস্টে। দেশগুলো হলো- চীন, মিশর, পাকিস্তান, কাতার, তুরস্ক, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ওইসব দেশের পেঁয়াজও ক্রমান্বয়ে বাজারে আসবে।
যদিও বাংলাদেশে যতটুকু পেঁয়াজ আমদানি হয়, তার সিংহভাগ আসে ভারত থেকে। এর আগেও বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতির দেওয়া হলেও বাস্তবে সেটা হয়নি। অনুমতির এক চতুর্থাংশ পেঁয়াজও দেশে আনতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। ফলে ভারত থেকে আমদানি ব্যাহত হলে সবসময় বাংলাদেশেও পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।