ধর্ম ডেস্ক : জুমাবার মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক উৎসব ও ইবাদতের দিন। জুমআর এ দিনটিকে সাপ্তাহিক ঈদের দিনও বলা হয়। সাধারণ অর্থে জুমাবারকে জুমার দিন বলা হয়। জুমা আরবি শব্দ। আবার শুক্রবারকে ‘ইয়াওমুল জুমা’ বলা হয়। জুমুআ বা জুমা। বাংলায় এর শাব্দিক অর্থ একত্রিত হওয়া, সম্মিলিত হওয়া, কাতারবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি।
পরিভাষায় জুমা বলে, প্রতি শুক্রবার দিনে প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে মসজিদে একত্র হয়ে জামাতের সঙ্গে যে নামাজ ফরজরূপে আদায় করে, সেই নামাজকে জুমার নামাজ বলে। আর সে দিন কে জুমার দিন বলে।
জুমার দিন। মুসলিম উম্মাহর ইবাদত-বন্দেগির নির্ধারিত দিন। দিনটিকে সদরে গ্রহণ করেছেন মুমিন মুসলমান। এ দিনের ফজিলত অনেক বেশি। জুমার দিনের ফজিলতগুলো হাদিসের একাধিক বর্ণনায় ওঠে এসেছে। বিশেষ কারণে দিনটি মর্যাদার দাবি রাখে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সূর্য উঠা দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। এ দিন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এ দিন তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ দিনটিতেই কেয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। (মুসলিম)
১. মুসলিম উম্মাহর জন্য উপহার
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমরা সর্বশেষ উম্মাত কিন্তু কেয়ামতের দিন আমরা হব অগ্রগামী। যদিও সব উম্মাতকে (আসমানি) কিতাব দেওয়া হয়েছে আমাদের আগে, আর আমাদের কিতাব দেওয়া হয়েছে সব উম্মাতের শেষে। এরপর যে দিনটি আল্লাহ আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন, সেদিন সম্পর্কে তিনি আমাদের হেদায়াতও দান করেছেন। সেদিনের ব্যাপারে অন্যান্যরা আমাদের পেছনে রয়েছে, (যেমন)- ইয়াহুদিরা (আমাদের) পরের দিন (শনিবার) এবং খৃষ্টানরা তাদেরও পরের দিন (রোববার)।’ (মুসলিম)
২. কোরবানির সাওয়াব পাওয়ার দিন
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জুমার দিনে ফেরেশতাগণ বিশেষ রেজিস্টার নিয়ে মসজিদের প্রতিটি দরজায় দাঁড়িয়ে যান। তাঁরা মসজিদে আগমনকারী মুসল্লিদের নাম ধারাবাহিকভাবে লিখতে থাকেন। এরপর যখন ইমাম (মিম্বারে) এসে যান, তখন তারা রেজিস্টার বন্ধ করে খুতবা শুনতে থাকেন।
যে সবার আগে মসজিদে প্রবেশ করেন, সে একটি উট আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করার সাওয়াব লাভ করে। যে দুই নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি গরু আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করার সাওয়াব পায়। যে তিন নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি দুম্বা কোরবানি করার সাওয়াব পায়। যে চার নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি মুরগি দান করার সাওয়াব লাভ করে। আর যে পাঁচ নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি ডিম আল্লাহর রাস্তায় দান করার সাওয়াব পায়।’ (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে শাফি, মুসনাদে হুমাইদি)
৩. গুনাহ মাফের দিন
হজরত আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গোসল করে জুমার নামাজে এলো, এরপর সাধ্যমত (সুন্নাত) নামাজ আদায় করলো, এরপর ইমামের খুতবাহ শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকলো; এরপর ইমামের সঙ্গে (জুমার) নামাজ আদায় করল, এতে তার দুই জুমার মধ্যবর্তী দিনসমূহ এবং আরো তিন দিন (মোট ১০ দিনের) গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আর যে ব্যক্তি (অহেতুক) কঙ্কর স্পর্শ করল সে অনর্থক, বাতিল, ঘৃণিত ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য কাজ করলো।’ (মুসলিম)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার নামাজ আদায়ের জন্য উত্তমরূপে অজু করে (মসজিদে) উপস্থিত হয়, এরপর চুপ করে মনোযোগ দিয়ে খুত্ববাহ শুনে, তার (ঐ) জুমা থেকে (পরবর্তী) জুমা পর্যন্ত বরং অতিরিক্ত আরো তিন দিনের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি পাথর কুচি অপসারণ বা নাড়াচাড়া করলো সে অনর্থক কাজ করলো।’ (আবু দাউদ)
হজরত সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিনে সুন্দর করে গোসল করবে, এরপর তেল ব্যবহার করবে এবং সুগন্ধি নেবে, তারপর মসজিদে গমন করবে, দুই মুসল্লির মাঝে জোর করে জায়গা নেবে না, সে নামাজ আদায় করবে এবং ইমাম যখন খুতবা দেবেন, (তখন) চুপ করে মনোযোগসহকারে তাঁর খুতবা শুনবে। দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ে তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (আবু দাউদ)
৪. দোয়া কবুলের দিন
জুমা দিনের ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো এ দিনে এমন একটি সময় রয়েছে যখন দোয়া করলে তা কবুলের আশা করা যায়। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এসেছে-
হজরত আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জুমার দিনের যে মুহুর্তে (দোয়া কুবুল হওয়ার) আশা করা যায় তা আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে তালাশ করো।’ (তিরমিজি, মুসলিম, মিশকাত, তালিকুর রাগিব)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জুমার দিনে একটা এমন সময় আছে, যে সময়ে কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে, অবশ্যই আল্লাহ তাঁকে তা দান করবেন। (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সে মহামূল্যবান সময় কখন?
এ সম্পর্কে ৪৫টা মতামত পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হলো, আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময় দোয়া কবুলের সময়। যা হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সে সময়টি হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা, তিরমিজি)
৫. জুমা না পড়ার পরিণতি
হজরত আবদুল্লাহ ইবনু ওমর ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তারা উভয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার মিম্বারের সিড়িতে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছেন, ‘যারা জুমার নামাজ ত্যাগ করে তাদেরকে এ অভ্যাস বর্জন করতে হবে। নতুবা আল্লাহ তাদের অন্তরে সীল (মোহর) মেরে দিবেন; এরপর তারা গাফিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’ (মুসলিম)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, জুমার দিন আগে আগে মসিজদে যাওয়া। দিনটি ইবাদত-বন্দেগি ও ভালো কাজে অতিবাহিত করা।
শুক্রবার অন্য দিন থেকে কেন আলাদা?
মালেক ইবনে শিহাব থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবনে সাব্বাক থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো এক জুমার দিনে বললেন, ‘হে মুসলিম সম্প্রদায়! আল্লাহ তায়ালা এই দিনটিকে ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও গোটা জগতকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এই ছয় দিনের শেষ দিন ছিল জুম্মার দিন।
জুমার দিনের মৃত্যুর ফজিলত ও রয়েছে।
এই দিনেই হজরত আদম (আ.) সৃজিত হন। এ দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। এবং এ দিনেই জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামানো হয়।
হযরত আদম আ. এর সৃস্টি:
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। এই দিনে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এই দিনে তাকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে। (মুসলিম, হাদিস : ৮৫৪)
কেয়ামত শুক্রবারেই অনুষ্ঠিত হবে?
কেয়ামত এ দিনেই সংঘটিত হবে। আল্লাহ তায়ালা প্রতি সপ্তাহে মানবজাতির সমাবেশ ও ঈদের জন্য এ দিন নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু পূর্ববর্তী উম্মতরা তা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ইসলামে জুম্মার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহপাক কোরআন পাকে ইরশাদ করেন,
‘হে মুমিনগণ জুম্মার দিনে যখন নামাজের আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের উদ্দেশেও দ্রুত ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর’। সূরা জুমা, আয়াত নং-৯।
জুম্মার আজান হলে দ্রুত মসজিদে যাওয়া :
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, মুমিনগণ, জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে দ্রত অগ্রসর হও এবং বেচা-কেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। সূরা- আল জুমা, আয়াত: ৯
জুমার দিনে আজানের আগেই সব কর্মব্যস্ততা ত্যাগ করে জুমু’আর নামায আদায়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করে মসজিদে গমন করা ঈমানী দায়িত্ব।
এ দিনে এমন একটি সময় রয়েছে, সকল দোয়া কবুল হয়। এই দিনের বিশেষ কিছু আমল রয়েছে, যা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যথাসম্ভব দ্রুত মসজিদে যাওয়া। এই দিনের গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে দ্রুত মসজিদে যাওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে দ্রুত ছুটে যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ করো।
এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বোঝো।’ (সুরা জুমআ)
আগে মসজিদে যাওয়ার ফজিলত:
রাসূল (সা.) বলেছেন, জুমার দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা অবস্থান করেন এবং ক্রমানুসারে আগে আগমনকারীদের নাম লিখতে থাকেন।
যে সবার আগে আসে সে ওই ব্যক্তির ন্যায় যে একটি মোটাতাজা উট কোরবানি করে। এরপর যে আসে সে ওই ব্যক্তি যে একটি গাভী কোরবানি করে। এরপর আগমনকারী ব্যক্তি মুরগি দানকারীর ন্যায়। তারপর ইমাম যখন বের হন তখন ফেরেশতাগণ তাদের লেখা বন্ধ করে দেন এবং মনোযোগ সহকারে খুতবা শুনতে থাকেন। (বুখারি, হাদিস : ৯২৯)
ফজিলত পূর্ণ আমল:
মুসনাদে আহমাদ এর ৫৮১ নং হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, আগে আগে মসজিদে গমন করল, হেঁটে মসজিদে গেল, ইমামের কাছাকাছি বসল, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনল, কোনো কথা বলল না, আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রতি কদমে এক বছরের নফল ইবাদতের সওয়াব দান করবেন।
শুক্রবারের নামাজ:
আজানের পরপর নামাজের জন্য মসজিদে প্রবেশ করা উত্তম। এবং মনোযোগের সঙ্গে খুতবা শোনাও ওয়াজিব।
সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করা:
কাহাফ কোরআনের ১৮ নম্বর সূরা। অর্থ- গুহা। মোট আয়াত ১১০।মক্কায় অবতীর্ণ। জুম্মার দিনে সূরা কাহ্ফ তিলাওয়াত করা ফজিলত পূর্ণ আমল।
রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহফ পাঠ করবে তার জন্য দুই জুমা পর্যন্ত নূর উজ্জ্বল করা হবে। (আমালুল ইয়াওমী ওয়াল লাইল, হাদিস : ৯৫২)
দরুদ শরিফ পাঠ করা:
বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করা এবং বেশি বেশি জিকির করা মোস্তাহাব। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন, দিনসমূহের মধ্যে জুমার দিনই সর্বোত্তম।
এই দিনে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। এই দিনে শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে।
এই দিনে সমস্ত সৃষ্টিকে বেহুশ করা হবে। অতএব তোমরা এই দিনে আমার ওপর অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করো। কেননা তোমাদের দরুদ আমার সম্মুখে পেশ করা হয়ে থাকে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৭)
শুক্রবার রাতের আমল:
জুম্মার রাত (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) ও জুম্মার দিনে নবী করিম (সা.) এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠের কথা বলা হয়েছে। এমনিতেই যে কোনো সময়ে একবার দরুদ শরিফ পাঠ করলে আল্লাহ তায়ালা পাঠকারীকে দশটা রহমত দান করেন এবং ফেরেশতারা তার জন্য দশবার রহমতের দোয়া করেন। জুম্মার নামাজের পূর্বে দুই খুতবার মাঝখানে হাত না উঠিয়ে মনে মনে দোয়া করা।
আসরের পরের আমল:
সূর্য ডোবার কিছুক্ষণ আগ থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গুরুত্বের সাথে জিকির, তাসবীহ ও দোয়ায় লিপ্ত থাকা। কারণ এটি শুক্রবার দোয়া কবুলের সময়। এ দিন প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জুমার দিন দিবসসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং তা আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১০৮৪)।
এ দিনে বেশি বেশি দোওয়া পড়ার কথা রাসূল সা. নিজেই বলেছেন।
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জুমার দিনের বারো ঘণ্টার মধ্যে একটি বিশেষ মুহূর্ত এমন আছে যে, তখন কোনো মুসলমান আল্লাহর নিকট যে দোয়া করবে আল্লাহ তা কবুল করেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৮) এছাড়াও জুমার দিনের ফজিলতের হাদিস সমূহ বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ গুলো দ্বারা স্বীকৃত।
সবমিলে পবিত্র জুমার ফজিলত অপরিসীম। উপরে বর্ণিত জুম্মার দিনে করণীয় আমল সমূহ যথাযথভাবে পালন করলে কামিয়াবি আসবে ইনশাআল্লাহ।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল পাক (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন আসর নামাজের পর না উঠে ওই স্থানে বসা অবস্থায় ৮০ বার নিম্নে উল্লেখিত দরুদ শরিফ পাঠ করবে, তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ হবে। এবং ৮০ বছরের নফল ইবাদতের সওয়াব তার আমল নামায় লেখা হবে। (সুবনহান আল্লাহ) দোয়াটি হলো: ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লিম তাসলীমা’ ।
সময় একই হলেও জোহরের সাথে জুমার নামাজের নিয়মগত কিছু পার্থক্য রয়েছে, আর জুমার দিন হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। ইসলামে এ দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ, জুমার আযান হলেই বেচাকেনা বন্ধ করে দাও, আল্লাহর স্মরণে চলো। নবী সা. এ দিনের বিপুল ফজিলত বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন আমলেরও নির্দেশ দিয়েছেন।
যেভাবে এলো জুমার দিন: প্রথম হিজরি সন। নবী সা. মক্কা ছেড়ে মদিনা গেলেন। নবী সা. এর মদিনায় পৌঁছার দিনটি ছিল ইয়াওমুল আরুবা (শুক্রবার)। সেদিন তিনি বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় গেলে জোহর নামাজের সময় হয়। সেখানে তিনি জোহর নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজ আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার নামাজ।
তবে আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় আরও পরে। রাসুলুল্লাহ সা. এর মদিনায় যাওয়ার পর এবং জুমার নামাজ ফরজ হওয়ার আগে একবার মদিনার আনসার সাহাবিরা আলোচনায় বসেন। তারা বললেন, ইহুদিদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট রয়েছে, যে দিনে তারা সবাই একত্র হয়। নাসারারাও সপ্তাহে একদিন একত্র হয়। সুতরাং আমাদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন, যে দিনে আমরা সবাই সমবেত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করব, নামাজ আদায় করব। অতঃপর তারা আলোচনায় বললেন, শনিবার ইহুদিদের আর রোববার নাসারাদের জন্য নির্ধারিত। অবশেষে তারা ইয়াওমুল আরুবা শুক্রবারকে গ্রহণ করলেন এবং তারাই এদিনকে ‘জুমার দিন নামকরণ করলেন। (সীরাতুল মুস্তাফা ও দারসে তিরমিজি)
কোরআনে জুমার দিন:
জুমার দিন ও জুমার নামাজের গুরুত্ব স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও কোরআনে তুলে ধরেছেন। জুমার নামাজ আদায়ের ব্যাপারে ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আযান দেয়া হয়, তোমরা আল্লাহর স্মরণে দ্রুত চলো এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ খোঁজ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সুরা জুমআ : আয়াত ৯-১০)
হাদিসে জুমার দিন:
হজরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে অজু করল, অতঃপর জুমা পড়তে এলো এবং মনোযোগ সহকারে নীরব থেকে খুতবাহ শুনলো, সে ব্যক্তির এই জুমা ও (আগামী) জুমআর মধ্যেকার এবং অতিরিক্ত আরও তিন দিনের (ছোট) পাপসমূহ মাফ করে দেয়া হলো। আর যে ব্যক্তি (খুৎবাহ্ চলাকালীন সময়ে) কাঁকর স্পর্শ করল, সে অনর্থক কাজ করল। (অর্থাৎ সে জুমার সওয়াব ধ্বংস করে দিল।) (মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ এর নামাজ অধ্যায়)
জুমার নামাজের বিধান:
শুক্রবার জুমার নামাজকে ফরজ করা হয়েছে। জুমার দুই রাকাত ফরজ নামাজ ও ইমামের খুতবাকে জোহরের চার রাকাত ফরজ নামাজের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। হজরত তারেক ইবনে শিহাব রা. থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালেগ বাচ্চা ও অসুস্থ ব্যক্তি এই চার প্রকার মানুষ ছাড়া সকল মুসলমানের ওপর জুমার নামাজ জামাতে আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য (ফরজ)। (আবু দাউদ : ১০৬৭, মুসতাদরেকে হাকেম : ১০৬২, আস্-সুনানুল কাবীর : ৫৫৮৭)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া জুমার নামাজ বর্জন করবে, তার নাম মুনাফিক হিসেবে এমন দফতরে লিপিবদ্ধ হবে, যা মুছে ফেলা হবে না এবং পরিবর্তনও করা যাবে না। (তাফসিরে মাজহারি, খ- : ৯, পৃষ্ঠা : ২৮৩) হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এ মর্মে হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সা. যে সমস্ত লোক জুমার নামাজ থেকে দূরে থাকে (পড়ে না) তাদের সম্পর্কে বলেছেন, নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছা হয় যে আমি কাউকে নামাজ পড়ানোর আদেশ করি, সে মানুষকে নামাজ পড়াক। অতঃপর যে সমস্ত লোক জুমার নামাজ পড়ে না, আমি তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিই। (মুসলিম : ৬৫২, মুসনাদে আহমাদ : ৩৮১৬, মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা : ৫৫৩৯, আসু-সুনানুল কুবরা : ৪৯৩৫)
জুমার দিনের নিষিদ্ধ কাজ:
জুমার দিনে মূলত আযানের পর থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়টিতে কিছু ফরজ বিধান রয়েছে। এ সময়টিতে কিছু বিধান মেনে চলতে হবে। শরীয়ত বর্হিভূত কোনো কাজ করা যাবে না। যেমন আযান হয়ে যাওয়ার পরও ব্যবসা বা অনর্থক কাজে ব্যস্ত থাকা। উপস্থিত মুসল্লিদের জন্য খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। তাই খুতবা চলাকালে নিরর্থক কাজে লিপ্ত থাকা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, জুমার দিন খুতবা প্রদানের সময় যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে বলো, চুপ করো তখন তুমি অনর্থক কথাই বললে। (সহিহ বোখারি: ১/১২৮)
বর্ণিত হাদিসের মাধ্যমে সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণ হয়, খুতবার সময় চুপচাপ ভাবে খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব এবং কথাবার্তা বলা হারাম। অনুরূপ খুতবার সময় সুন্নত-নফল নামাজ পড়াও বৈধ নয়। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হবেন, তখন নামাজ পড়বে না, কথাও বলবে না। (মেশকাত: ৩/৪৩২)
ফিকাহ শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ফাতাওয়ায়ে শামীতে একটি মূলনীতি উল্লেখ হয়েছে, যেসব কর্ম নামাজের মধ্যে হারাম, তা খুতবা চলাকালীন সময়ও হারাম। যেমন: কথাবার্তা বলা, পানাহার করা ইত্যাদি। (ফাতাওয়ায়ে শামি: ৩/৩৫)
জুমার দিনের বিশেষ আমল:
জুমার দিনের সীমাহীন ফজিলত রয়েছে। নবী সা. বিভিন্ন হাদিসে এসব ফজিলতের কথা তুলে ধরেছেন। বোখারি শরিফের হাদিসে রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো পুরুষ যখন জুমার দিন গোসল করে, সাধ্যমত পবিত্রতা অর্জন করে, তেল ব্যবহার করে বা ঘরে যে সুগন্ধি আছে তা ব্যবহার করে, তারপর (জুমার জন্য) বের হয় এবং (বসার জন্য) দুই জনকে আলাদা করে না, এরপর সাধ্যমত নামায পড়ে এবং ইমাম যখন কথা বলে তখন চুপ থাকে, তাহলে অন্য জুমা পর্যন্ত তার (গুনাহ) মাফ করা হয়।
বিভিন্ন হাদিসেরভিত্তিতে ফেকাহবিদরা সেসব আমলকে নির্দিষ্ট করেছেন। ১. জুমার দিন গোসল করা। যাদের ওপর জুমা ফরজ তাদের জন্য এ দিনে গোসল করাকে রাসুল সা ওয়াজিব করেছেন। তবে আহনাফদের মাযহাব অনুযায়ী সুন্নত। ২. পরিচ্ছন্নতার অংশহিসেবে সেদিন নখ ও চুলকাটা একটি ভালো কাজ। ৩. জুমার সালাতের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার (বুখারি) ৪. মিসওয়াক করা। (ইবনে মাজাহ) ৫. গায়ে তেল ব্যবহার করা। (বুখারি) ৬. উত্তম পোশাক পরিধান করে জুমা আদায় করা। (ইবনে মাজাহ) ৭. মুসল্লিদের ইমামের দিকে মুখ করে বসা। (তিরমিযি) ৮. পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া। (আবু দাউদ) ৯. জুম্মার দিনও জুম্মার রাতে বেশি বেশি দুরুদ পাঠ। (আবু দাউদ: ১০৪৭) ১০. এ দিন বেশি বেশি দোয়া করা। (বুখারি) ১১. মুসুল্লীদের ফাঁক করে মসজিদে সামনের দিকে এগিয়ে না যাওয়া। (বুখারি) ১২. জুমার দিনসূরা কাহাফ পড়া। পাঠকারীর জন্য আল্লাহ তায়ালা দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়কে আলোকিত করে দেন।
জুমার দিন দোয়া কবুলে সময়:
জুমাবারের ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এই দিনে এমন একটা সময় আছে, যখন মুমিন বান্দা কোনো দোয়া করলে মহান আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, জুমার দিনে একটা এমন সময় আছে, যে সময়ে কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে তা দান করবেন। (সহীহ মুসলিম : ৮৫২, মুসনাদে আহমাদ : ৭১৫১, আস্-সুনানুল কুবরা : ১০২৩৪) জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সে মহামূল্যবান সময় কোনটা? এ সম্পর্কে ৪৫টা মতামত পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হলো, আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দোয়া কবুলের সময়। হজরত আনাস (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, জুমার দিনের কাঙ্ক্ষিত সময়টা হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা : ৫৪৬০, তিরমিজি : ৪৮৯)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জুমার দিনের হক আদায় করে ইবাদত-বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।জুমাবার মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক উৎসব ও ইবাদতের দিন। জুমআর এ দিনটিকে সাপ্তাহিক ঈদের দিনও বলা হয়। সাধারণ অর্থে জুমাবারকে জুমার দিন বলা হয়। জুমা আরবি শব্দ। আবার শুক্রবারকে ‘ইয়াওমুল জুমা’ বলা হয়। জুমুআ বা জুমা। বাংলায় এর শাব্দিক অর্থ একত্রিত হওয়া, সম্মিলিত হওয়া, কাতারবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি।
পরিভাষায় জুমা বলে, প্রতি শুক্রবার দিনে প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে মসজিদে একত্র হয়ে জামাতের সঙ্গে যে নামাজ ফরজরূপে আদায় করে, সেই নামাজকে জুমার নামাজ বলে। আর সে দিন কে জুমার দিন বলে।
জুমার দিন। মুসলিম উম্মাহর ইবাদত-বন্দেগির নির্ধারিত দিন। দিনটিকে সদরে গ্রহণ করেছেন মুমিন মুসলমান। এ দিনের ফজিলত অনেক বেশি। জুমার দিনের ফজিলতগুলো হাদিসের একাধিক বর্ণনায় ওঠে এসেছে। বিশেষ কারণে দিনটি মর্যাদার দাবি রাখে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সূর্য উঠা দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। এ দিন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এ দিন তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ দিনটিতেই কেয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। (মুসলিম)
১. মুসলিম উম্মাহর জন্য উপহার
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমরা সর্বশেষ উম্মাত কিন্তু কেয়ামতের দিন আমরা হব অগ্রগামী। যদিও সব উম্মাতকে (আসমানি) কিতাব দেওয়া হয়েছে আমাদের আগে, আর আমাদের কিতাব দেওয়া হয়েছে সব উম্মাতের শেষে। এরপর যে দিনটি আল্লাহ আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন, সেদিন সম্পর্কে তিনি আমাদের হেদায়াতও দান করেছেন। সেদিনের ব্যাপারে অন্যান্যরা আমাদের পেছনে রয়েছে, (যেমন)- ইয়াহুদিরা (আমাদের) পরের দিন (শনিবার) এবং খৃষ্টানরা তাদেরও পরের দিন (রোববার)।’ (মুসলিম)
২. কোরবানির সাওয়াব পাওয়ার দিন
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জুমার দিনে ফেরেশতাগণ বিশেষ রেজিস্টার নিয়ে মসজিদের প্রতিটি দরজায় দাঁড়িয়ে যান। তাঁরা মসজিদে আগমনকারী মুসল্লিদের নাম ধারাবাহিকভাবে লিখতে থাকেন। এরপর যখন ইমাম (মিম্বারে) এসে যান, তখন তারা রেজিস্টার বন্ধ করে খুতবা শুনতে থাকেন।
যে সবার আগে মসজিদে প্রবেশ করেন, সে একটি উট আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করার সাওয়াব লাভ করে। যে দুই নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি গরু আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করার সাওয়াব পায়। যে তিন নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি দুম্বা কোরবানি করার সাওয়াব পায়। যে চার নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি মুরগি দান করার সাওয়াব লাভ করে। আর যে পাঁচ নম্বরে প্রবেশ করে, সে একটি ডিম আল্লাহর রাস্তায় দান করার সাওয়াব পায়।’ (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে শাফি, মুসনাদে হুমাইদি)
৩. গুনাহ মাফের দিন
হজরত আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গোসল করে জুমার নামাজে এলো, এরপর সাধ্যমত (সুন্নাত) নামাজ আদায় করলো, এরপর ইমামের খুতবাহ শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকলো; এরপর ইমামের সঙ্গে (জুমার) নামাজ আদায় করল, এতে তার দুই জুমার মধ্যবর্তী দিনসমূহ এবং আরো তিন দিন (মোট ১০ দিনের) গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আর যে ব্যক্তি (অহেতুক) কঙ্কর স্পর্শ করল সে অনর্থক, বাতিল, ঘৃণিত ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য কাজ করলো।’ (মুসলিম)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার নামাজ আদায়ের জন্য উত্তমরূপে অজু করে (মসজিদে) উপস্থিত হয়, এরপর চুপ করে মনোযোগ দিয়ে খুত্ববাহ শুনে, তার (ঐ) জুমা থেকে (পরবর্তী) জুমা পর্যন্ত বরং অতিরিক্ত আরো তিন দিনের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি পাথর কুচি অপসারণ বা নাড়াচাড়া করলো সে অনর্থক কাজ করলো।’ (আবু দাউদ)
হজরত সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিনে সুন্দর করে গোসল করবে, এরপর তেল ব্যবহার করবে এবং সুগন্ধি নেবে, তারপর মসজিদে গমন করবে, দুই মুসল্লির মাঝে জোর করে জায়গা নেবে না, সে নামাজ আদায় করবে এবং ইমাম যখন খুতবা দেবেন, (তখন) চুপ করে মনোযোগসহকারে তাঁর খুতবা শুনবে। দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ে তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (আবু দাউদ)
৪. দোয়া কবুলের দিন
জুমা দিনের ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো এ দিনে এমন একটি সময় রয়েছে যখন দোয়া করলে তা কবুলের আশা করা যায়। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এসেছে-
হজরত আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জুমার দিনের যে মুহুর্তে (দোয়া কুবুল হওয়ার) আশা করা যায় তা আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে তালাশ করো।’ (তিরমিজি, মুসলিম, মিশকাত, তালিকুর রাগিব)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জুমার দিনে একটা এমন সময় আছে, যে সময়ে কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে, অবশ্যই আল্লাহ তাঁকে তা দান করবেন। (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সে মহামূল্যবান সময় কখন?
এ সম্পর্কে ৪৫টা মতামত পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হলো, আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময় দোয়া কবুলের সময়। যা হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সে সময়টি হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা, তিরমিজি)
৫. জুমা না পড়ার পরিণতি
হজরত আবদুল্লাহ ইবনু ওমর ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তারা উভয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার মিম্বারের সিড়িতে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছেন, ‘যারা জুমার নামাজ ত্যাগ করে তাদেরকে এ অভ্যাস বর্জন করতে হবে। নতুবা আল্লাহ তাদের অন্তরে সীল (মোহর) মেরে দিবেন; এরপর তারা গাফিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’ (মুসলিম)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, জুমার দিন আগে আগে মসিজদে যাওয়া। দিনটি ইবাদত-বন্দেগি ও ভালো কাজে অতিবাহিত করা।
শুক্রবার অন্য দিন থেকে কেন আলাদা?
মালেক ইবনে শিহাব থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবনে সাব্বাক থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো এক জুমার দিনে বললেন, ‘হে মুসলিম সম্প্রদায়! আল্লাহ তায়ালা এই দিনটিকে ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও গোটা জগতকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এই ছয় দিনের শেষ দিন ছিল জুম্মার দিন।
জুমার দিনের মৃত্যুর ফজিলত ও রয়েছে।
এই দিনেই হজরত আদম (আ.) সৃজিত হন। এ দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। এবং এ দিনেই জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামানো হয়।
হযরত আদম আ. এর সৃস্টি:
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। এই দিনে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এই দিনে তাকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে। (মুসলিম, হাদিস : ৮৫৪)
কেয়ামত শুক্রবারেই অনুষ্ঠিত হবে
কেয়ামত এ দিনেই সংঘটিত হবে। আল্লাহ তায়ালা প্রতি সপ্তাহে মানবজাতির সমাবেশ ও ঈদের জন্য এ দিন নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু পূর্ববর্তী উম্মতরা তা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ইসলামে জুম্মার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহপাক কোরআন পাকে ইরশাদ করেন,
‘হে মুমিনগণ জুম্মার দিনে যখন নামাজের আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের উদ্দেশেও দ্রুত ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর’। সূরা জুমা, আয়াত নং-৯।
জুম্মার আজান হলে দ্রুত মসজিদে যাওয়া
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, মুমিনগণ, জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে দ্রত অগ্রসর হও এবং বেচা-কেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। সূরা- আল জুমা, আয়াত: ৯
জুমার দিনে আজানের আগেই সব কর্মব্যস্ততা ত্যাগ করে জুমু’আর নামায আদায়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করে মসজিদে গমন করা ঈমানী দায়িত্ব।
এ দিনে এমন একটি সময় রয়েছে, সকল দোয়া কবুল হয়। এই দিনের বিশেষ কিছু আমল রয়েছে, যা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যথাসম্ভব দ্রুত মসজিদে যাওয়া। এই দিনের গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে দ্রুত মসজিদে যাওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে দ্রুত ছুটে যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ করো।
এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বোঝো।’ (সুরা জুমআ)
আগে মসজিদে যাওয়ার ফজিলত:
রাসূল (সা.) বলেছেন, জুমার দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা অবস্থান করেন এবং ক্রমানুসারে আগে আগমনকারীদের নাম লিখতে থাকেন।
যে সবার আগে আসে সে ওই ব্যক্তির ন্যায় যে একটি মোটাতাজা উট কোরবানি করে। এরপর যে আসে সে ওই ব্যক্তি যে একটি গাভী কোরবানি করে। এরপর আগমনকারী ব্যক্তি মুরগি দানকারীর ন্যায়। তারপর ইমাম যখন বের হন তখন ফেরেশতাগণ তাদের লেখা বন্ধ করে দেন এবং মনোযোগ সহকারে খুতবা শুনতে থাকেন। (বুখারি, হাদিস : ৯২৯)
ফজিলত পূর্ণ আমল:
মুসনাদে আহমাদ এর ৫৮১ নং হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, আগে আগে মসজিদে গমন করল, হেঁটে মসজিদে গেল, ইমামের কাছাকাছি বসল, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনল, কোনো কথা বলল না, আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রতি কদমে এক বছরের নফল ইবাদতের সওয়াব দান করবেন।
শুক্রবারের নামাজ:
আজানের পরপর নামাজের জন্য মসজিদে প্রবেশ করা উত্তম। এবং মনোযোগের সঙ্গে খুতবা শোনাও ওয়াজিব।
সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করা:
কাহাফ কোরআনের ১৮ নম্বর সূরা। অর্থ- গুহা। মোট আয়াত ১১০।মক্কায় অবতীর্ণ। জুম্মার দিনে সূরা কাহ্ফ তিলাওয়াত করা ফজিলত পূর্ণ আমল।
রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহফ পাঠ করবে তার জন্য দুই জুমা পর্যন্ত নূর উজ্জ্বল করা হবে। (আমালুল ইয়াওমী ওয়াল লাইল, হাদিস : ৯৫২)
দরুদ শরিফ পাঠ করা:
বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করা এবং বেশি বেশি জিকির করা মোস্তাহাব। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন, দিনসমূহের মধ্যে জুমার দিনই সর্বোত্তম।
এই দিনে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। এই দিনে শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে।
এই দিনে সমস্ত সৃষ্টিকে বেহুশ করা হবে। অতএব তোমরা এই দিনে আমার ওপর অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করো। কেননা তোমাদের দরুদ আমার সম্মুখে পেশ করা হয়ে থাকে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৭)
শুক্রবার রাতের আমল:
জুম্মার রাত (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) ও জুম্মার দিনে নবী করিম (সা.) এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠের কথা বলা হয়েছে। এমনিতেই যে কোনো সময়ে একবার দরুদ শরিফ পাঠ করলে আল্লাহ তায়ালা পাঠকারীকে দশটা রহমত দান করেন এবং ফেরেশতারা তার জন্য দশবার রহমতের দোয়া করেন। জুম্মার নামাজের পূর্বে দুই খুতবার মাঝখানে হাত না উঠিয়ে মনে মনে দোয়া করা।
আসরের পরের আমল:
সূর্য ডোবার কিছুক্ষণ আগ থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গুরুত্বের সাথে জিকির, তাসবীহ ও দোয়ায় লিপ্ত থাকা। কারণ এটি শুক্রবার দোয়া কবুলের সময়। এ দিন প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জুমার দিন দিবসসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং তা আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১০৮৪)।
এ দিনে বেশি বেশি দোওয়া পড়ার কথা রাসূল সা. নিজেই বলেছেন।
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জুমার দিনের বারো ঘণ্টার মধ্যে একটি বিশেষ মুহূর্ত এমন আছে যে, তখন কোনো মুসলমান আল্লাহর নিকট যে দোয়া করবে আল্লাহ তা কবুল করেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৮) এছাড়াও জুমার দিনের ফজিলতের হাদিস সমূহ বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ গুলো দ্বারা স্বীকৃত।
সবমিলে পবিত্র জুমার ফজিলত অপরিসীম। উপরে বর্ণিত জুম্মার দিনে করণীয় আমল সমূহ যথাযথভাবে পালন করলে কামিয়াবি আসবে ইনশাআল্লাহ।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল পাক (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন আসর নামাজের পর না উঠে ওই স্থানে বসা অবস্থায় ৮০ বার নিম্নে উল্লেখিত দরুদ শরিফ পাঠ করবে, তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ হবে। এবং ৮০ বছরের নফল ইবাদতের সওয়াব তার আমল নামায় লেখা হবে। (সুবনহান আল্লাহ) দোয়াটি হলো: ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আলা আলিহী ওয়াসাল্লিম তাসলীমা’ ।
সময় একই হলেও জোহরের সাথে জুমার নামাজের নিয়মগত কিছু পার্থক্য রয়েছে, আর জুমার দিন হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। ইসলামে এ দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ, জুমার আযান হলেই বেচাকেনা বন্ধ করে দাও, আল্লাহর স্মরণে চলো। নবী সা. এ দিনের বিপুল ফজিলত বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন আমলেরও নির্দেশ দিয়েছেন।
যেভাবে এলো জুমার দিন: প্রথম হিজরি সন। নবী সা. মক্কা ছেড়ে মদিনা গেলেন। নবী সা. এর মদিনায় পৌঁছার দিনটি ছিল ইয়াওমুল আরুবা (শুক্রবার)। সেদিন তিনি বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় গেলে জোহর নামাজের সময় হয়। সেখানে তিনি জোহর নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজ আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার নামাজ।
তবে আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় আরও পরে। রাসুলুল্লাহ সা. এর মদিনায় যাওয়ার পর এবং জুমার নামাজ ফরজ হওয়ার আগে একবার মদিনার আনসার সাহাবিরা আলোচনায় বসেন। তারা বললেন, ইহুদিদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট রয়েছে, যে দিনে তারা সবাই একত্র হয়। নাসারারাও সপ্তাহে একদিন একত্র হয়। সুতরাং আমাদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন, যে দিনে আমরা সবাই সমবেত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করব, নামাজ আদায় করব। অতঃপর তারা আলোচনায় বললেন, শনিবার ইহুদিদের আর রোববার নাসারাদের জন্য নির্ধারিত। অবশেষে তারা ইয়াওমুল আরুবা শুক্রবারকে গ্রহণ করলেন এবং তারাই এদিনকে ‘জুমার দিন নামকরণ করলেন। (সীরাতুল মুস্তাফা ও দারসে তিরমিজি)
কোরআনে জুমার দিন:
জুমার দিন ও জুমার নামাজের গুরুত্ব স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও কোরআনে তুলে ধরেছেন। জুমার নামাজ আদায়ের ব্যাপারে ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আযান দেয়া হয়, তোমরা আল্লাহর স্মরণে দ্রুত চলো এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ খোঁজ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সুরা জুমআ : আয়াত ৯-১০)
হাদিসে জুমার দিন:
হজরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে অজু করল, অতঃপর জুমা পড়তে এলো এবং মনোযোগ সহকারে নীরব থেকে খুতবাহ শুনলো, সে ব্যক্তির এই জুমা ও (আগামী) জুমআর মধ্যেকার এবং অতিরিক্ত আরও তিন দিনের (ছোট) পাপসমূহ মাফ করে দেয়া হলো। আর যে ব্যক্তি (খুৎবাহ্ চলাকালীন সময়ে) কাঁকর স্পর্শ করল, সে অনর্থক কাজ করল। (অর্থাৎ সে জুমার সওয়াব ধ্বংস করে দিল।) (মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ এর নামাজ অধ্যায়)
জুমার নামাজের বিধান:
শুক্রবার জুমার নামাজকে ফরজ করা হয়েছে। জুমার দুই রাকাত ফরজ নামাজ ও ইমামের খুতবাকে জোহরের চার রাকাত ফরজ নামাজের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। হজরত তারেক ইবনে শিহাব রা. থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালেগ বাচ্চা ও অসুস্থ ব্যক্তি এই চার প্রকার মানুষ ছাড়া সকল মুসলমানের ওপর জুমার নামাজ জামাতে আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য (ফরজ)। (আবু দাউদ : ১০৬৭, মুসতাদরেকে হাকেম : ১০৬২, আস্-সুনানুল কাবীর : ৫৫৮৭)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া জুমার নামাজ বর্জন করবে, তার নাম মুনাফিক হিসেবে এমন দফতরে লিপিবদ্ধ হবে, যা মুছে ফেলা হবে না এবং পরিবর্তনও করা যাবে না। (তাফসিরে মাজহারি, খ- : ৯, পৃষ্ঠা : ২৮৩) হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এ মর্মে হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সা. যে সমস্ত লোক জুমার নামাজ থেকে দূরে থাকে (পড়ে না) তাদের সম্পর্কে বলেছেন, নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছা হয় যে আমি কাউকে নামাজ পড়ানোর আদেশ করি, সে মানুষকে নামাজ পড়াক। অতঃপর যে সমস্ত লোক জুমার নামাজ পড়ে না, আমি তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিই। (মুসলিম : ৬৫২, মুসনাদে আহমাদ : ৩৮১৬, মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা : ৫৫৩৯, আসু-সুনানুল কুবরা : ৪৯৩৫)
জুমার দিনের নিষিদ্ধ কাজ:
জুমার দিনে মূলত আযানের পর থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়টিতে কিছু ফরজ বিধান রয়েছে। এ সময়টিতে কিছু বিধান মেনে চলতে হবে। শরীয়ত বর্হিভূত কোনো কাজ করা যাবে না। যেমন আযান হয়ে যাওয়ার পরও ব্যবসা বা অনর্থক কাজে ব্যস্ত থাকা। উপস্থিত মুসল্লিদের জন্য খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। তাই খুতবা চলাকালে নিরর্থক কাজে লিপ্ত থাকা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, জুমার দিন খুতবা প্রদানের সময় যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে বলো, চুপ করো তখন তুমি অনর্থক কথাই বললে। (সহিহ বোখারি: ১/১২৮)
বর্ণিত হাদিসের মাধ্যমে সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণ হয়, খুতবার সময় চুপচাপ ভাবে খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব এবং কথাবার্তা বলা হারাম। অনুরূপ খুতবার সময় সুন্নত-নফল নামাজ পড়াও বৈধ নয়। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হবেন, তখন নামাজ পড়বে না, কথাও বলবে না। (মেশকাত: ৩/৪৩২)
ফিকাহ শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ফাতাওয়ায়ে শামীতে একটি মূলনীতি উল্লেখ হয়েছে, যেসব কর্ম নামাজের মধ্যে হারাম, তা খুতবা চলাকালীন সময়ও হারাম। যেমন: কথাবার্তা বলা, পানাহার করা ইত্যাদি। (ফাতাওয়ায়ে শামি: ৩/৩৫)
জুমার দিনের বিশেষ আমল:
জুমার দিনের সীমাহীন ফজিলত রয়েছে। নবী সা. বিভিন্ন হাদিসে এসব ফজিলতের কথা তুলে ধরেছেন। বোখারি শরিফের হাদিসে রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো পুরুষ যখন জুমার দিন গোসল করে, সাধ্যমত পবিত্রতা অর্জন করে, তেল ব্যবহার করে বা ঘরে যে সুগন্ধি আছে তা ব্যবহার করে, তারপর (জুমার জন্য) বের হয় এবং (বসার জন্য) দুই জনকে আলাদা করে না, এরপর সাধ্যমত নামায পড়ে এবং ইমাম যখন কথা বলে তখন চুপ থাকে, তাহলে অন্য জুমা পর্যন্ত তার (গুনাহ) মাফ করা হয়।
বিভিন্ন হাদিসেরভিত্তিতে ফেকাহবিদরা সেসব আমলকে নির্দিষ্ট করেছেন। ১. জুমার দিন গোসল করা। যাদের ওপর জুমা ফরজ তাদের জন্য এ দিনে গোসল করাকে রাসুল সা ওয়াজিব করেছেন। তবে আহনাফদের মাযহাব অনুযায়ী সুন্নত। ২. পরিচ্ছন্নতার অংশহিসেবে সেদিন নখ ও চুলকাটা একটি ভালো কাজ। ৩. জুমার সালাতের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার (বুখারি) ৪. মিসওয়াক করা। (ইবনে মাজাহ) ৫. গায়ে তেল ব্যবহার করা। (বুখারি) ৬. উত্তম পোশাক পরিধান করে জুমা আদায় করা। (ইবনে মাজাহ) ৭. মুসল্লিদের ইমামের দিকে মুখ করে বসা। (তিরমিযি) ৮. পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া। (আবু দাউদ) ৯. জুম্মার দিনও জুম্মার রাতে বেশি বেশি দুরুদ পাঠ। (আবু দাউদ: ১০৪৭) ১০. এ দিন বেশি বেশি দোয়া করা। (বুখারি) ১১. মুসুল্লীদের ফাঁক করে মসজিদে সামনের দিকে এগিয়ে না যাওয়া। (বুখারি) ১২. জুমার দিনসূরা কাহাফ পড়া। পাঠকারীর জন্য আল্লাহ তায়ালা দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়কে আলোকিত করে দেন।
জুমার দিন দোয়া কবুলে সময়:
জুমাবারের ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এই দিনে এমন একটা সময় আছে, যখন মুমিন বান্দা কোনো দোয়া করলে মহান আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, জুমার দিনে একটা এমন সময় আছে, যে সময়ে কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে তা দান করবেন। (সহীহ মুসলিম : ৮৫২, মুসনাদে আহমাদ : ৭১৫১, আস্-সুনানুল কুবরা : ১০২৩৪) জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সে মহামূল্যবান সময় কোনটা? এ সম্পর্কে ৪৫টা মতামত পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হলো, আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দোয়া কবুলের সময়। হজরত আনাস (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, জুমার দিনের কাঙ্ক্ষিত সময়টা হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা : ৫৪৬০, তিরমিজি : ৪৮৯)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জুমার দিনের হক আদায় করে ইবাদত-বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।