জুমবাংলা ডেস্ক : দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি আবাসন শিল্পেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এতে নির্মাণকাজের প্রধান উপকরণ রডের বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। গত আগস্ট মাসের পর থেকে কোম্পানিভেদে রডের বিক্রি ৫০ শতাংশ কমেছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় দাম কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
দেশের জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন এর চট্রগ্রামের সাংবাদিক নাসির উদ্দিন রকি-র এক প্রতিবেদনে এমনি তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৩ সালের এই সময়ে মানভেদে ৬০ গ্রেডের এমএস রডের দাম ছিল টন ৯৩-৯৫ হাজার টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৭৯-৮৩ হাজার টাকায়। শুধু যে দাম কমেছে তা নয়, রডের চাহিদা কমেছে ৫০ শতাংশ। চাহিদা কমে যাওয়ায় দামও কমেছে।
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীরা জানিয়েছেন, চাহিদা কমায় ৭৫ গ্রেডের প্রতি টন এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮২ হাজার টাকায়। যা গত জুলাই মাস পর্যন্ত ৯৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এই হিসাবে, পাঁচ মাসের ব্যবধানে এমএস রডের দাম টনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। এতে লোকসানের মুখে পড়েছে দেশের ইস্পাত শিল্প। তাদের দাবি, প্রতিটন ৭৫ গ্রেডের রড উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৯৫ হাজার টাকা। ফলে বর্তমানে প্রতিটন বিক্রিতে ১৫ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। তবে চলতি ডিসেম্বর মাসে আগের চার মাসের তুলনায় চাহিদা ১০ শতাংশ বেড়েছে। সামনে আরও বাড়বে বলে আশা স্বত্বাধিকারীদের।
প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বত্বাধিকারীরা বলছেন, আগস্টের পর মেগা প্রকল্প ছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবে সব ধরনের অবকাঠামোর নির্মাণকাজ অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। আগের সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগ কাজ এখনও চালু হয়নি। অনেক ঠিকাদার কাজ ফেলে লাপাত্তা। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ অনেকে আধিপত্য হারিয়ে নির্মাণাধীন কিংবা নির্মাণ পরিকল্পনায় থাকা ব্যক্তিগত-বাণিজ্যিক অবকাঠামো এগিয়ে নিচ্ছেন না। এসব কারণে ইস্পাত খাতের উৎপাদন এবং বিক্রি কমে গেছে। কারণ সরকারি প্রকল্পে রড বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ। বাকি রড বিক্রি হয় ব্যক্তিগত এবং আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। দুই ক্ষেত্রে বিক্রি কমেছে। তবে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু হলে এই পরিস্থিতি কেটে যাবে।
২০২১ সাল থেকে বেড়েছিল রডের দাম
অবশ্য, ২০২১ সাল থেকে দফায় দফায় বেড়ে ২০২২-২৩ সালে পণ্যটির দাম টনে এক লাখ টাকা পার হয়েছিল। পরে কিছুটা কমে ৯৫ হাজারে নেমেছিল। ২০২১ সাল পর্যন্ত ভালো মানের (৬০ গ্রেডের ওপরে) প্রতি টন রড বিক্রি হয়েছে গড়ে সাড়ে ৬৫ হাজার টাকায়। তা ছাড়া বিএসআরএমের ভালো মানের রড বিক্রি হয়েছে ৬৭ হাজার ৫০০ টাকায়। কেএসআরএমের রডের দাম ছিল ৬৭ হাজার টাকা। ওই বছর কাঁচামালের দাম বেড়েছে অজুহাতে পাল্লা দিয়ে দাম বাড়ানো হয়। ওই সময়ে দুই মাসেই বেড়ে যায় ১২-১৩ হাজার টাকা। তাতে বিপাকে পড়েন ব্যক্তি খাতে বাড়ি নির্মাণকারী, আবাসন ব্যবসায়ী ও উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদাররা।
ইস্পাতশিল্পের অবস্থা ভালো নয়
বর্তমানে ইস্পাত খাতের অবস্থা নাজুক বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও রানী রি-রোলিং মিলসের নির্বাহী পরিচালক সুমন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে ইস্পাত শিল্পের অবস্থা নাজুক। আগস্টের পর সরকারি প্রকল্পের অনুমোদন যেমন কমেছে, তেমনি চলমান প্রকল্পগুলোর কাজের গতিও কমে গেছে। কিছু আবার বন্ধ আছে। ফলে রডের বাজারে ক্রেতাদের চাহিদা ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে।’
দেশে ইস্পাত কোম্পানিগুলোর রড উৎপাদনে বছরে সক্ষমতা এক কোটি ২০ লাখ টন জানিয়ে সুমন চৌধুরী বলেন, ‘চাহিদা আছে সর্বোচ্চ ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টন। বর্তমানে চাহিদা ও বিক্রি গত বছর কিংবা অন্যান্য বছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে। দেশে ছোট-বড় ১৯০টির মতো ইস্পাত কারখানা আছে। এর মধ্যে ৪০টি বড়। যেগুলো দেশের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ইস্পাতের চাহিদা পূরণ করে থাকে।’
সুমন চৌধুরী আরও বলেন, ‘রড তৈরির কাঁচামাল হলো পুরোনো লোহার টুকরা। যাকে স্ক্র্যাপ বলা হয়। এই কাঁচামাল সরাসরি আমদানি করে প্রায় ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে দেশীয় উৎপাদকরা। বাকি ৩০ শতাংশ জাহাজভাঙা শিল্প থেকে আসে। উন্নত দেশগুলোতে পুরোনো অবকাঠামো ভাঙার পর এই কাঁচামাল পাওয়া যায়। আবার ইস্পাতের ব্যবহার্য পণ্যও কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। গত বছরের তুলনায় এবার কাঁচামালের দাম কিছুটা কমেছে। গত বছর এই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন কাঁচামালের দাম ছিল ৪৮০ থেকে ৫০০ ডলার। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ ডলারে।’
নির্মাণ প্রকল্পে গতি না বাড়লে ইস্পাতশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে
দেশে স্বয়ংক্রিয় ইস্পাত কারখানা আছে ৪২টি। সনাতন পদ্ধতির কারখানা ১০০-এর কম। ইস্পাত খাতে রডসহ সব ধরনের উৎপাদিত পণ্যের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। দেশে একক খাত হিসেবে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় ইস্পাতশিল্পে। দেশের অন্যতম রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম। প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণ মৌসুমে (নভেম্বর-মার্চ) দিনে গড়ে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টন রড উৎপাদন ও বিক্রি করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি নেমে এসেছে এক হাজার টনের নিচে।
এ ব্যাপারে কেএসআরএম-এর সিনিয়র জিএম (বিক্রয় ও বিপণন) মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দেশে রডের ব্যবহার সব চেয়ে বেশি হয় সরকারি প্রকল্পে। বর্তমানে সরকারি প্রকল্পের কাজ বন্ধ আছে। এজন্য রড বিক্রিও কমেছে। ইতোমধ্যে ৬০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে। গত বছর এই সময়ে কেএসআরএম-এর রডের টন বিক্রি হয়েছিল ৯৩-৯৪ হাজার টাকায়। বর্তমানে ৮১-৮২ হাজারে বিক্রি হচ্ছে।’
ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় আরেক প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম স্টিল লিমিটেড। এই গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘বর্তমানে দেশের ইস্পাতশিল্প সংকটময় সময় পার করছে। আগস্টের পর চাহিদা বলতে গেলে ৫০ শতাংশের মতো কমেছে। চাহিদা কম থাকায় লোকসান দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে আমাদের। নির্মাণ প্রকল্পে গতি না বাড়লে ইস্পাতশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
আগস্টে বিক্রি ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল, নভেম্বর পর্যন্ত এভাবেই ছিল উল্লেখ করে তপন সেনগুপ্ত আরও বলেন, ‘তবে চলতি ডিসেম্বর মাসে আগের মাসগুলোর তুলনায় চাহিদা ১০ শতাংশ বেড়েছে। বলা যায়, ৬০ শতাংশ বিক্রি হচ্ছে। ধীরে ধীরে আবারও রডের বাজার স্বাভাবিক পর্যায়ে যাবে বলে আশা করছি।’
ইস্পাত খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান এইচ এম স্টিলের পরিচালক মো. সরওয়ার আলম বলেন, ‘ইস্পাতশিল্প খারাপ সময় পার করছে। প্রতি সপ্তাহে দুই-তিনবার দাম কমছে। গত তিন মাসে টনপ্রতি দাম কমেছে অন্তত ১৫ হাজার টাকা। আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ৭২ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত চাহিদা কমেছিল। নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে চাহিদা কিছুটা বেড়েছে, তাও ৫০ শতাংশের বেশি নয়।’
নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত উন্নয়নকাজের মৌসুম উল্লেখ করে সরওয়ার আলম বলেন, ‘এই সময়টি শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় রডের চাহিদা বেশি থাকে। এবার সে রকম নেই। দেশে ৭০ শতাংশ রডের চাহিদা থাকে সরকারি উন্নয়নকাজে। বাকি রডের চাহিদা থাকে ব্যক্তি এবং আবাসন খাতে। সরকারি কাজ পুনরায় চালু হলে এবং নতুন প্রকল্প নেওয়া হলে আবারও স্বাভাবিক হবে রডের বাজার।’
রবিবার যে দামে বিক্রি হয়েছে রড
নগরের ষোলশহরের পাইকারি রড বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আলমার্স ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী ইমাম হোসেন বলেন, ‘রবিবার বিএসআরএম স্টিলসের রড মিলগেটে প্রতি টন বিক্রি হয়েছে ৮১ হাজার ৫০০ থেকে ৮২ হাজার, কেএসআরএম ৮১ হাজার ৫০০ টাকা, বায়েজিদ স্টিল ৭৯ হাজার, জিপিএইচ ইস্পাত ৮০ হাজার ও একেএস স্টিল ৮০ হাজার টাকায়। অন্যান্য কোম্পানির রডের টন এক থেকে দুই হাজার টাকা কম-বেশিতে বিক্রি হয়েছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা মিলগেট থেকে নিজ খরচে পরিবহন করে তাদের দোকানে নিয়ে যান। সেক্ষেত্রে প্রতি টনের দাম এক থেকে দুই হাজার টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করেন তারা।’
আগস্টের পর থেকে রড বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘আগে আমরা মাসে বিভিন্ন কোম্পানির ৬০-৭০ টন রড বিক্রি করতাম। এখন ১৫-২০ টন বিক্রি করছি।’
খুচরা বাজারে যে দাম বিক্রি
রাউজানের পাহাড়তলী ইউনিয়নের আল মদিনা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী জিএম খালেদ বলেন, ‘দাম এখনও কমতির দিকে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে টনপ্রতি তিন-চার হাজার টাকা কমেছে। বর্তমানে খুচরায় বিএসআরএম রড বিক্রি হচ্ছে ৮৩ হাজার, কেএসআরএম ৮২ হাজার ৫০০, বায়েজিদ স্টিল ৮০ হাজার, জিপিএইচ ৮২ হাজার এবং একেএস ৮২ হাজার টাকা। তবে দাম কমলেও রড বিক্রি বাড়েনি।’
কমেছে ফ্ল্যাট বিক্রি
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রামে ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমেছে। এমনকি অনেক গ্রাহক আগে বুকিং দেওয়া ফ্ল্যাটের কিস্তিও নিয়মিত পরিশোধ করছেন না। এতে ছোট ও মাঝারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে। এমনটি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের আবাসন প্রতিষ্ঠান সিদরাত-সাইফ ডেভেলপারের ব্যবস্থাপক মো. ফিরোজ আহমেদ।
নির্মাণসামগ্রীর দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাট বুকিং এবং বিক্রি কমেছে জানিয়ে ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘ফ্ল্যাট বুকিং এবং বিক্রি আগের চেয়ে কমেছে। এ কারণে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে না। লোকজন এই খাতে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছেন। আগস্টের পর থেকে আমাদের ফ্ল্যাট বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।’
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।