জীবন বদলে দিলো এক সিদ্ধান্ত। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর কৃষক জাহাঙ্গীর আলমের চোখে এখন স্বপ্নের ঝিলিক। মাত্র তিন বছর আগেও রাসায়নিক সারের দামের চাপে, ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে হতাশায় ডুবে ছিলেন। ২০২১ সালে এক কৃষি প্রশিক্ষণে অর্গানিক ফার্মিং টেকনিক শব্দটি প্রথম শুনে কৌতূহলী হয়েছিলেন। আজ? তার পাঁচ বিঘা জমিতে শুধু বিষমুক্ত সবজি নয়, ফুল ফোটানো মৌমাছির গুঞ্জন আর মাটির উর্বরতার গন্ধে ভরপুর এক প্রাণবন্ত খামার গড়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, আগের চেয়ে প্রায় ৪০% কম খরচে উৎপাদন করে স্থানীয় বাজারে প্রিমিয়াম দামে বিক্রি করছেন, মাসিক আয় বেড়েছে দ্বিগুণ! জাহাঙ্গীর আলমের মতো হাজারো বাংলাদেশি কৃষক আজ অর্গানিক ফার্মিং টেকনিকে লাভবান হচ্ছেন – শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, প্রকৃতির সাথে সখ্যতা গড়ে টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার মধ্য দিয়েই।
অর্গানিক ফার্মিং টেকনিকে লাভবান হোন – এই শব্দগুচ্ছ শুনলেই অনেকের মনে ভেসে উঠে প্রশ্ন: রাসায়নিক ছাড়া কি চাষ সম্ভব? খরচ বাড়বে না তো? বাজারে দাম কে দেবে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কথা মাথায় রেখে, বিজ্ঞানসম্মত তথ্য আর বাস্তব সফলতার গল্পের আলোকে রচিত এই অনুসন্ধান। এখানে শুধু পদ্ধতি নয়, জানবেন কীভাবে এ পথে হাঁটতে হাঁটতেই টেকসই লাভের মুখ দেখতে পারেন আপনি।
অর্গানিক ফার্মিং: শুধু পদ্ধতি নয়, জীবনবোধের পরিবর্তন
অর্গানিক ফার্মিং কেবলমাত্র রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বর্জনের নাম নয়। এটি একটি সামগ্রিক দর্শন, যেখানে মাটির স্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশের ভারসাম্য এবং মানুষের সুস্থতাকে কেন্দ্রে রেখে কৃষিকাজ পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে এই ধারার জনপ্রিয়তা বাড়ছে মূলত তিনটি কারণে: ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সচেতনতা, রাসায়নিক সারের দামের ঊর্ধ্বগতি এবং জৈব পণ্যের জন্য শহুরে বাজারে উচ্চমূল্যের সুযোগ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (BARI) ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদকারী কৃষকের সংখ্যা গত পাঁচ বছরে প্রায় ৩৫% বেড়েছে, বিশেষ করে সবজি, মসলা ও ফল চাষে।
- কেন লাভবান হবেন?
- খরচ কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে: রাসায়নিক সারের দাম আকাশছোঁয়া। বাংলাদেশে ইউরিয়া সারের দাম গত দুই বছরে প্রায় ৭০% বেড়েছে (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ২০২৪)। অর্গানিক পদ্ধতিতে কৃষক নিজেই তৈরি করেন জৈব সার (গোবর, কম্পোস্ট, ভার্মিকম্পোস্ট, জৈবিক বর্জ্য), নিম বা গাঁদা ফুলের নির্যাস দিয়ে বানান প্রাকৃতিক কীটনাশক। এতে বাহ্যিক ইনপুটের খরচ ৩০-৫০% পর্যন্ত কমে আসে।
- ফসলের দাম পাওয়া যায় অনেক বেশি: বাজারে অর্গানিক সবজি, ফল বা চালের দাম সাধারণ ফসলের চেয়ে ২০% থেকে ১০০% পর্যন্ত বেশি। ঢাকা, চট্টগ্রাম বা খুলনার আধুনিক সুপারশপগুলো এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো (যেমন ‘প্রাণ গো’, ‘চলো ফার্ম’) নিয়মিত উচ্চ দামে অর্গানিক পণ্য ক্রয় করে থাকে।
- মাটির স্বাস্থ্য ফিরে আসে দীর্ঘমেয়াদে: রাসায়নিকের অতিরিক্ত ব্যবহার মাটিকে মেরে ফেলে, জৈব পদার্থ কমিয়ে দেয়। অর্গানিক পদ্ধতি মাটির গঠন, জল ধারণ ক্ষমতা ও উর্বরতা ফিরিয়ে আনে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল ও বাড়ন্ত উৎপাদন নিশ্চিত করে।
- বাজারের চাহিদা তুঙ্গে: শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবার, অভিভাবকরা এখন সন্তানের খাবারের নিরাপত্তায় অতিসতর্ক। বিষমুক্ত, পুষ্টিকর খাবারের চাহিদা প্রতিদিন বাড়ছে।
- জলবায়ু সহনশীলতা বাড়ে: অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করা মাটি বেশি কার্বন সিকোয়েস্টার করে, খরা বা বন্যার মতো চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায়।
অর্গানিক ফার্মিং টেকনিকে লাভবান হবার বিজ্ঞানসম্মত কৌশল: ধাপে ধাপে
অর্গানিক ফার্মিং টেকনিকে লাভবান হোন এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চাইলে শুধু ইচ্ছাশক্তি নয়, দরকার সঠিক জ্ঞান ও পরিকল্পিত বাস্তবায়ন।
মাটি প্রস্তুতি: ভিত্তিটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
অর্গানিক চাষের প্রথম ও প্রধান শর্ত হল স্বাস্থ্যকর মাটি। এখানে ধৈর্য্য চাই।
- মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা: শুরুতে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মৃত্তিকা পরীক্ষাগার বা BARI এর ল্যাবে মাটির নমুনা পরীক্ষা করুন (বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে সুবিধা পাওয়া যায়)। জানুন মাটির pH, জৈব পদার্থের পরিমাণ, পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি।
- জৈব সারের সমাহার:
- কম্পোস্ট: গৃহস্থালির জৈব বর্জ্য (উচ্ছিষ্ট, পাতা), ফসলের অবশিষ্টাংশ, আগাছা ইত্যাদি স্তূপ করে পচিয়ে তৈরি করুন। এটি মাটির গঠন ও জৈব পদার্থ বাড়ায়।
- গোবর সার: অবশ্যই ভালোভাবে পচানো গোবর ব্যবহার করুন। টাটকা গোবর ব্যবহার ক্ষতিকর হতে পারে।
- হরিণ শিং সার (BD 500): একটি জৈব-গতিশীল প্রস্তুতি যা মাটির সক্রিয়তা ও মাইক্রোবায়াল কার্যকলাপ বাড়াতে সাহায্য করে। বাংলাদেশেও এখন প্রশিক্ষণ নিয়ে কৃষকরা এটি তৈরি করছেন।
- জৈবিক বর্জ্য: মাছের কাটা, হাড়গোড়ের গুঁড়ো (Bone Meal), খৈল (নিম, মাড়াই, সরিষা) – এগুলো নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়ামের ভালো উৎস।
- সবুজ সার (Green Manure): ধইঞ্চা, সানহেম্প, সেসবেনিয়া জাতীয় দ্রুত বর্ধনশীল ফসল চাষ করে ফুল ফোটার আগেই মাটিতে চাষ দিয়ে দিলে তা অত্যন্ত কার্যকর জৈব সারে পরিণত হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) ধইঞ্চা চাষের উপর বিশেষ পরামর্শ দিয়ে থাকে।
- মালচিং: জমির মাটি খোলা না রেখে খড়, শুকনো পাতা বা বিশেষ প্লাস্টিক শীট দিয়ে ঢেকে দেওয়া। এটি মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখে, আগাছা কমায় এবং মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
ফসল নির্বাচন ও চাষ পদ্ধতি: সঠিকটা বেছে নিন
- স্থানীয় ও সহনশীল জাত: আপনার এলাকার মাটি ও জলবায়ু উপযোগী, রোগ-পোকামাকড় প্রতিরোধী স্থানীয় জাত (হাইব্রিড নয়) বেছে নিন। BARI, BRRI বা স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে এ সংক্রান্ত পরামর্শ নিন। যেমন: নাটিকেল, কালিজিরা, দেশি টমেটো, পাটশাক, বিভিন্ন ধরনের দেশি লেবু।
- ফসল আবর্তন (Crop Rotation): একই জমিতে বারবার একই ফসল না চাষ করে বিভিন্ন গোত্রের ফসল পালা করে চাষ করুন (যেমন: ডাল ফসল -> শাকসবজি -> ধান)। এটি মাটিতে পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখে এবং নির্দিষ্ট রোগ-পোকার প্রাদুর্ভাব কমায়।
- মিশ্র চাষ (Intercropping/Mixed Cropping): একই জমিতে একাধিক ধরনের ফসল পাশাপাশি চাষ করুন। যেমন: পেঁপে গাছের নিচে পালং শাক বা ধনিয়া, ভুট্টার সাথে লতিরাজ বা বরবটি। এটি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ (এক ফসলের পোকা আরেক ফসলকে আকর্ষণ করে না) এবং ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
- সহচর উদ্ভিদ (Companion Planting): কিছু গাছপালা একসাথে লাগালে তারা একে অপরের উপকার করে। যেমন: টমেটোর পাশে গাঁদা ফুল লাগালে টমেটোর ক্ষতিকর নেমাটোড ও কিছু পোকা দূরে থাকে। তুলসী গাছ বিভিন্ন সবজি বাগানের পাশে ভালো কাজ করে।
প্রাকৃতিক উপায়ে রোগ-পোকা দমন: প্রকৃতিই আপনার মিত্র
- জৈবিক নিয়ন্ত্রণ (Biological Control): প্রকৃতিতে পোকামাকড়ের প্রাকৃতিক শত্রু (Predators & Parasitoids) আছে। যেমন: মাকড়সা, লেডিবার্ড বিটল, ম্যান্টিস, কিছু পরজীবী বোলতা (Trichogramma) ক্ষতিকর পোকার ডিম বা শূককীট খেয়ে ফেলে। এই উপকারী পতঙ্গদের আকর্ষণ করতে ফুলের গাছ (সূর্যমুখী, জিনিয়া, কসমস) বাগানের চারপাশে লাগান।
- বোটানিক্যাল কীটনাশক (Plant Extracts):
- নিম: নিমের বীজের নির্যাস বা নিমের তৈল (Azadirachtin) সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ প্রাকৃতিক কীটনাশক। এটি পোকার খাদ্যাভ্যাস ও বংশবৃদ্ধিতে বাধা দেয়।
- গাঁদা ফুল: গাঁদা ফুলের নির্যাস বা গাছ মাটিতে শিকড় পচা ও নেমাটোড দমনে খুব ভালো।
- তামাক পাতা: সাবধানতার সাথে ব্যবহার করতে হয় (মৌমাছির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে), তবে এফিড, থ্রিপসের বিরুদ্ধে কার্যকর।
- মরিচ-রসুন স্প্রে: কাঁচা মরিচ ও রসুন বেটে পানি দিয়ে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে স্প্রে করা যায়।
- যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ: হাত দিয়ে পোকা সংগ্রহ করে মারা, হলুদ ফাঁদ, ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার। নেট হাউজ বা পলি টানেল তৈরি করে বাহিরের পোকা থেকে ফসল রক্ষা করা।
- স্বাস্থ্যকর মাটি ও গাছ: সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। স্বাস্থ্যকর মাটিতে জন্মানো সবল গাছ রোগ-পোকার আক্রমণ সহজে প্রতিরোধ করতে পারে।
জল ব্যবস্থাপনা: প্রতিটি ফোঁটার সদ্ব্যবহার
- ড্রিপ ইরিগেশন বা ফোঁটা সেচ: এই পদ্ধতিতে গাছের গোড়ায় সরাসরি অল্প অল্প পানি দেওয়া হয়। এতে পানির অপচয় প্রায় ৫০-৬০% কমে, আগাছা কম জন্মায় এবং গাছের গোড়া শুকায় না। বাংলাদেশে সরকারিভাবেও এই প্রযুক্তি উৎসাহিত করা হচ্ছে।
- মালচিং: আগেই বলা হয়েছে, মালচিং মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে, ফলে সেচের প্রয়োজন কমে।
- বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: পুকুর বা ট্যাঙ্কে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা এবং সেচে ব্যবহার করা।
অর্গানিক ফার্মিং টেকনিকে লাভবান হবার বাজার কৌশল: আপনার ফসলের সঠিক মূল্য আদায় করুন
সুন্দরভাবে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করলেই লাভবান হওয়া যায় না। চাই বাজারজাতকরণের সঠিক কৌশল।
- সার্টিফিকেশনের দিকে এগিয়ে যান: বাংলাদেশে এখন “বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্ট স্ট্যান্ডার্ড” (Bangladesh Organic Product Standard – BOPS) আছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং কিছু বেসরকারি সংস্থা (যেমন: Kazi & Kazi Tea Estate, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কিছু উদ্যোগ) সার্টিফিকেশন দিতে শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে স্থানীয়ভাবে বিশ্বাস অর্জন করুন, তারপর আনুষ্ঠানিক সার্টিফিকেশনের দিকে ভাবুন। আপনার উৎপাদন পদ্ধতি, ব্যবহৃত ইনপুটের রেকর্ড রাখুন (Record Keeping)।
- বাজার চিনুন ও তৈরি করুন:
- স্থানীয় হাট-বাজার: স্থানীয় ক্রেতাদের সাথে সরাসরি কথা বলুন, আপনার ফসলের গুণগত মানের ব্যাপারে জানান। দাম একটু বেশি নিলেও ক্রেতারা ধীরে ধীরে বুঝতে শিখবেন।
- কমিউনিটি সাপোর্টেড এগ্রিকালচার (CSA): শহুরে কিছু পরিবারকে সরাসরি আপনার খামারের সদস্য বানান। তারা আগাম টাকা দিয়ে সাবস্ক্রাইব করবে, আপনি তাদের নিয়মিত সতেজ অর্গানিক পণ্য পৌঁছে দেবেন। ঢাকা, চট্টগ্রামে এই মডেল জনপ্রিয় হচ্ছে।
- অনলাইন প্ল্যাটফর্ম: ‘চলো ফার্ম’, ‘প্রাণ গো’, ‘বাংলাদেশ ফার্মার্স মার্কেট’, ‘গ্রীন স্টোর’ এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে অর্গানিক পণ্যের বিশেষ ক্যাটাগরি আছে। এখানে তালিকাভুক্ত হন।
- হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ক্যাটারিং সার্ভিস: অভিজাত হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো নিয়মিত বিষমুক্ত সবজি ও মসলার খোঁজে থাকে। সরাসরি যোগাযোগ করুন।
- অর্গানিক মেলা/হাট: বিভিন্ন সংস্থা নিয়মিত অর্গানিক মেলার আয়োজন করে। সেখানে স্টল নিয়ে অংশ নিন।
- গল্প বলুন, ব্র্যান্ড তৈরি করুন: আপনার খামারের গল্প বলুন। কীভাবে আপনি অর্গানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন, আপনার সংগ্রাম, সাফল্য – এসব শেয়ার করুন (সামাজিক মাধ্যম, পণ্যের লেবেলে)। মানুষ আপনার বিশ্বাসযোগ্যতা ও আন্তরিকতায় আকৃষ্ট হবে। আপনার পণ্যের একটি নাম দিন, সহজে চেনা যায় এমন প্যাকেজিং করুন।
- কৃষক সমবায় গঠন: একা একা বাজারজাতকরণ কঠিন। একই এলাকার কয়েকজন অর্গানিক কৃষক মিলে সমবায় গঠন করুন। উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন – সব ক্ষেত্রে একসাথে কাজ করলে শক্তি ও সম্পদ বাড়বে, খরচ কমবে, দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। শেরপুরে নারী কৃষকদের এমন একটি সমবায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও সরকারি/বেসরকারি সহযোগিতা: একা হাঁটবেন না
অর্গানিকে রূপান্তর সহজ নয়। কিছু বাধা আসবেই:
- প্রাথমিক উৎপাদন হ্রাস: রাসায়নিক থেকে জৈব পদ্ধতিতে যাওয়ার প্রথম ১-২ বছর ফলন কিছুটা কমতে পারে। এটা স্বাভাবিক। ধৈর্য ধরুন, মাটি নিজেকে ঠিক করবে।
- জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের অভাব: সঠিক পদ্ধতি জানা জরুরি।
- শ্রমের প্রয়োজনীয়তা: অর্গানিক পদ্ধতিতে হাতের কাজ (কম্পোস্ট তৈরি, স্প্রে করা, হাত দিয়ে আগাছা পরিষ্কার) কিছুটা বেশি লাগে।
- বাজারজাতকরণের জটিলতা: ভোক্তা আস্থা অর্জন ও প্রিমিয়াম দাম আদায়ে সময় লাগে।
একা লড়বেন না, সহযোগিতা নিন:
- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (DAE): প্রতিটি উপজেলায় অফিস আছে। তারা বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ, মৃত্তিকা পরীক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম তথ্য ও কিছু ক্ষেত্রে বীজ/চারা সরবরাহ করে। তাদের ১৬১২৩ হটলাইনে ফোন করে পরামর্শ নিন।
- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI): অর্গানিক চাষ উপযোগী জাত, জৈব সার ও বালাইনাশক তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। তাদের ওয়েবসাইট ও মাঠ দিবস থেকে তথ্য নিন।
- বেসরকারি সংস্থা (NGOs): প্রশিক্ষণ, বাজার সংযোগ, ক্ষুদ্র ঋণ, প্রযুক্তি প্রদানে সাহায্য করে। যেমন: প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ডভিশন, কারিতাস, উবিনীগ।
- কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) এর গবেষণা ফলাফল ও প্রশিক্ষণ সুবিধা কাজে লাগান।
- অনলাইন জ্ঞানভাণ্ডার: কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট, BARI, BRRI এর ওয়েবসাইটে প্রচুর বাংলায় রিসোর্স পাওয়া যায়। ইউটিউবেও অনেক শিক্ষণীয় ভিডিও আছে (খেয়াল রাখুন উৎস বিশ্বাসযোগ্য কিনা)।
জাহাঙ্গীর আলম বা শেরপুরের নারী কৃষিকদের গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; তা প্রমাণ করে বাংলাদেশের মাটিতে অর্গানিক ফার্মিং টেকনিকে লাভবান হওয়া শুধু সম্ভবই নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একান্ত আবশ্যক। এটা শুধু টাকার লাভের হিসাব নয়, এটা মাটির সুস্থতা, পরিবেশের ভারসাম্য, নিজের ও ভোক্তার সুস্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক উর্বর ভূমি রেখে যাওয়ার দায়বদ্ধতা। হ্যাঁ, শুরুটা কঠিন লাগতে পারে, ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হবে, নতুন শিখতে হবে। কিন্তু মনে রাখবেন, প্রতিটি কম্পোস্টের স্তূপ, প্রতিটি নিমের স্প্রে, প্রতিটি প্রাকৃতিক শত্রুকে আশ্রয় দেওয়া গাছ – এগুলোই আপনার খামারে টেকসই সমৃদ্ধির বীজ বপন করছে। অর্গানিক ফার্মিং টেকনিকে লাভবান হোন – এই পথে পা বাড়ানোর সিদ্ধান্তই হতে পারে আপনার কৃষিজীবনের সবচেয়ে অর্থপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা। আজই স্থানীয় কৃষি অফিসে যোগাযোগ করুন, একজন সফল অর্গানিক কৃষকের খামার পরিদর্শনে যান, ছোট্ট এক টুকরো জমি দিয়ে শুরু করুন। প্রকৃতিই হবে আপনার প্রধান সহায়ক, আর আপনার অধ্যবসায়ই গড়ে তুলবে বিষমুক্ত, লাভজনক ও গর্বিত এক কৃষি ভুবন।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. অর্গানিক ফার্মিং শুরু করতে কত টাকা লাগবে?
অর্গানিক ফার্মিংয়ে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের ওপর নির্ভরতা কমায় দীর্ঘমেয়াদে খরচ কমে। তবে শুরুতে জৈব সার (কম্পোস্ট পিট, ভার্মিকম্পোস্ট ইউনিট), প্রাকৃতিক বালাইনাশক তৈরির সরঞ্জাম, ভালো মানের বীজ ইত্যাদিতে কিছু বিনিয়োগ লাগতে পারে। সরকারি সহায়তা বা ক্ষুদ্র ঋণ নেওয়া যেতে পারে। ধীরে ধীরে নিজেই সব উৎপাদন করে নিলে খরচ আরও কমে আসে।
২. ঘরেই কীভাবে সহজে জৈব সার (কম্পোস্ট) তৈরি করা যায়?
হ্যাঁ, খুব সহজে বাড়িতেই কম্পোস্ট তৈরি করা যায়। একটি প্লাস্টিকের ড্রাম বা কাঠের বাক্স নিন। তাতে পরিবারের রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট (শাকসবজির খোসা, ফলের অবশিষ্ট, চা-কফির ভুসি), শুকনো পাতা, ছোট কাগজের টুকরো স্তরে স্তরে সাজান। প্রতি স্তরের উপর সামান্য মাটি বা পুরোনো কম্পোস্ট ছড়িয়ে দিন। আর্দ্র রাখুন (খুব ভেজা নয়)। ২-৩ মাস পরেই পাবেন উৎকৃষ্ট জৈব সার। নিয়মিত নাড়াচাড়া দিলে গন্ধ হবে না।
৩. অর্গানিক ফসলের বাজারে ভালো দাম পেতে কী করণীয়?
ভালো দাম পেতে ভোক্তার আস্থা অর্জন জরুরি। উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখুন। সম্ভব হলে ছবি/ভিডিও শেয়ার করুন। স্থানীয় বাজারে সরাসরি বিক্রি করে ক্রেতার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলুন। ফেসবুক পেজ খুলে আপনার খামারের গল্প বলুন। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হন। অর্গানিক মেলায় অংশ নিন। সামান্য বাড়তি দামে শুরু করুন, গুণগত মান বজায় রাখলে ক্রেতা ধীরে ধীরে বাড়তি দাম দিতে রাজি হবেন।
৪. বাংলাদেশে অর্গানিক সার্টিফিকেশন পেতে কী করতে হবে?
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক অর্গানিক সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া এখনও বিকাশমান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা (যেমন কাজি অ্যান্ড কাজি টি এস্টেট) সার্টিফিকেশন দেয়। সাধারণত নির্দিষ্ট মান (বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্ট স্ট্যান্ডার্ড – BOPS) মেনে চলতে হয়, খামার পরিদর্শন হয় এবং উৎপাদনের রেকর্ড (কোন সার/বালাইনাশক কখন, কোথায়, কতটা ব্যবহার করা হলো) রাখতে হয়। শুরুতে স্থানীয়ভাবে সততা ও মান দিয়ে আস্থা গড়ে তোলাই ভালো।
৫. অর্গানিক পদ্ধতিতে ধান চাষ কি লাভজনক?
অবশ্যই লাভজনক। জৈব পদ্ধতিতে ধান চাষে রাসায়নিক সারের খরচ প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। নিজের তৈরি জৈব সার ব্যবহার করা যায়। ফলন প্রথম দিকে সামান্য কমলেও, মাটির স্বাস্থ্য ফিরে পেলে ফলন স্থিতিশীল হয়। সবচেয়ে বড় লাভ হল, অর্গানিক চালের বাজার দাম সাধারণ চালের চেয়ে ৫০% থেকে ১০০% পর্যন্ত বেশি। ঢাকাসহ বড় শহরগুলিতে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
৬. অর্গানিক ফার্মিং শেখার জন্য কোথায় প্রশিক্ষণ পাওয়া যাবে?
প্রশিক্ষণের জন্য প্রথমে যোগাযোগ করুন আপনার স্থানীয় কৃষি অফিস (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর – ডিএই) বা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার (এসএএও) সাথে। তারা নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (বাকৃবি, শেকৃবি) বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করে। উবিনীগ, প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশের মতো বেসরকারি সংস্থাগুলোরও প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম আছে। অনলাইনেও অনেক ভালো রিসোর্স পাওয়া যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।