লাইফস্টাইল ডেস্ক : অশরীরী অভিজ্ঞতা কি মনের ভুল? নাকি এতেও আছে বিজ্ঞানমনস্ক উত্তর? একা একটি ঘরে থাকলে আমাদের মাঝেমধ্যেই মনে হয়, ঘরে হয়তো কেউ আছে। প্রকৃতপক্ষে এমন অনুভূতি কেন হয়, জানেন? অনেক সময় আমরা ভাবি, মনের ভুল। আবার অনেকেই ভাবেন, মনের ভুল নয়। বাস্তব। খবর বিবিসির।
কী বলছে বিজ্ঞান?
আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে ভূতপ্রেতের গল্প আর কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু এ সম্পর্কে কী বলছে বিজ্ঞান? বিজ্ঞান বলছে, এটা দুইয়ের মধ্যে একটা কিছু। কিন্তু কী সেটা? এই অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করতে গেলে ব্যাখ্যা করা জরুরি। কেননা ব্যাখ্যা ভিন্ন কেউ বিষয়টা বিশ্বাস করতে চান না। গবেষকরা জানিয়েছেন, এ ধরনের অশরীরী উপস্থিতির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।
ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বেন অল্ডারসন-ডে বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন। সোসাইটি ফর সাইকিকাল রির্সাচ (এসপিআর) ‘সেন্সাস অব হ্যালুসিনেশন্স’ অর্থাৎ অলীক দর্শন কিংবা শ্রবণের বিষয়ে তাদের এ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে যে জরিপ চালানো হয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ১৭ সহস্রাধিক লোকের ওপর।
কোনো অশরীরী বা অলৌকিক কিছু এসে আগাম নোটিশ দিয়ে যাচ্ছে যে, একটা মৃত্যু ঘটতে চলেছে, আপাতদৃষ্টিতে অবাস্তব এমন অভিজ্ঞতা কত মানুষের জীবনে ঘটেছে তা জানাই ছিলো জরিপের মূল লক্ষ্য। এতে দেখা গেছে, অনেকে এধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন ও এ সংখ্যা উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। অর্থাৎ জরিপে প্রতি ৪৩ জনের মধ্যে একজন এমন অভিজ্ঞতার কথা বলেন।
সংস্থাটি থেকে এর আগে ১৮৮৬ সালে ভূত দেখার ওপর পৃথক একটি প্রকাশনা বের হয়। যাতে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন ও কবি আলফ্রেড লর্ড টেনিসনেরও উল্লেখ ছিলো।
সেখানে ৭০১টি বিচিত্র ঘটনার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়, যার মধ্যে ছিল টেলিপ্যাথি বা কোনো ধরনের ইন্দ্রিয় ব্যবহার না করে অপরের মন পড়তে পারা, প্রিমোনিশন বা কিছু ঘটতে চলেছে আগে থেকেই তা জানা ও এরকম আরো নানা ধরনের আপাত অবাস্তব বা অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার বিবরণ। যেমন, সেখানে ছিল ইংল্যান্ডের প্লিমাথ এলাকার ড্যাভেনপোর্ট শহরের একজন ধর্মযাজক পিএইচ নিউনহামের নিউজিল্যান্ড সফরে যাবার এক কাহিনি। যাত্রার আগের রাতে কোনো এক অশরীরী তাকে বলেছিল পরদিন ভোরে ওই জাহাজে রওনা না হতে।
পরে তিনি জানতে পারেন ওই জাহাজ ডুবে সব যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তখন এসপিআর প্রকাশিত প্রবন্ধটি সমালোচিত হয় এমন সব ‘উদ্ভট, ভুতুড়ে ও অবৈজ্ঞানিক কাহিনিকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য।’
এসপিআর পরে ১৮৯৪ সালে যে জরিপটি চালায় তা নিয়ে যদিও সেভাবে সমালোচনা বা সন্দেহ প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু অনেকে একথা বলতে ছাড়েনি যে জরিপে তারাই শুধু উত্তর দিয়েছে যারা মনে করে তাদের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেকে বলেছিলো ‘কার মাথা খারাপ হয়েছে যে এমন জরিপে সাড়া দেবে!’
কিন্তু এখনো বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘরে ঘরে এধরনের অভিজ্ঞতার কথা শোনা যায়। ফলে আধুনিক বিজ্ঞান এখন বিষয়টা বুঝতে চেয়েছে ও তার ব্যাখ্যা দিয়েছে।
গবেষণা সংস্থা এসপিআর যেসব ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করেছিলো, তার বেশিরভাগই ছিলো মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষায় ‘হিপনোগগিয়া’। এটি হলো পুরো ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের মানসিক মুহূর্ত- অর্থাৎ জেগে থাকা আর ঘুম আসার মধ্যবর্তী সময়ের অলীক বা অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার অনুভূতি।
উনবিংশ শতাব্দীর বেশ কিছু ধর্মীয় অভিজ্ঞতার কথা নথিবদ্ধ আছে যেগুলোর ভিত্তি হিসেবে মনে করা হয় হিপনোগগিয়া অবস্থায় দেখা স্বপ্নের অনুভূতি। তবে অশরীরী কিছুর উপস্থিতির সঙ্গে জোরালো যোগাযোগ রয়েছে ‘স্লিপ প্যারালিসিসের’ যে অভিজ্ঞতা, মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, প্রায় সাত শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জীবদ্দশায় অন্তত একবার ঘটে।
‘স্লিপ প্যারালিসিস’ হলো ঘুমের সময়কার এমন একটা অবস্থা যখন আমাদের মাংসপেশিগুলোর নড়াচড়া থেমে যায়, সেগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক থাকে সজাগ আর সক্রিয়। এটা এমন একটা অবস্থা যখন আপনি প্রকৃতপক্ষে জেগে আছেন, কিন্তু নড়তে পারছেন না, কথা বলতে বা চোখ খুলতে পারছেন না।
বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, যাদের স্লিপ প্যারালিসিস হয়, তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশই দাবি করে থাকেন যে, তাদের ঘরে সম্ভবত কেউ আছে।
ভিক্টোরীয় যুগের যেসব অভিজ্ঞতার ঘটনা এসপিআর নথিবদ্ধ করেছিল সেগুলোর বেশিরভাগই ভয়ংকর বা ক্ষতিকর ছিলো না। বেশিরভাগই ছিলো ভালো লাগার অভিজ্ঞতা। কিন্তু বর্তমানে স্লিপ প্যারালিসিসের যেসব অনুভূতির কথা শোনা গেছে সেগুলো ভয়ংকর বা নৃশংস কিছু দেখার অভিজ্ঞতা।
রাতে অশরীরী কিছুর উপস্থিতি নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে নানা বিশ্বাস প্রচলিত আছে। যেমন, আমরা বলি ঘুমের মধ্যে ভূতে পাওয়া বা জিনে ধরা (আরো সোজা ভাষায় বলতে গেলে বোবায় ধরা)। পর্তুগালে বিশ্বাস আছে ‘হাতে ফুটো কোনো অপদেবতা’ স্বপ্নের মধ্যে বুকে চেপে বসে, পশ্চিম আফ্রিকার ইউরোবারা এই প্রক্রিয়াকে বলে ওগান অরু যা ঘুমের মধ্যে কোন ভূতের উপদ্রব। নাইজিরীয়রা বিশ্বাস করেন, ঘুমের মধ্যে শরীরে অপঘাতে মৃত কেউ ভর করলে এমন অবস্থা হয়।
কিন্তু ঘুমের মধ্যে পেশি অচল হয়ে গেলে কারো উপস্থিতি অনুভব হয় কেন?
দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও মতদ্বৈততা থাকলেও গবেষকরা বলছেন, এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে মানুষ যখন জেগে ওঠার চেষ্টা করে তখন মনের মধ্যে তারা বিশেষ একটা কিছুকে অবলম্বন করতে চায়। তাই তারা কিছু একটা দেখে বা শোনে। এই স্লিপ প্যারালিসিস অনেকের জন্য বেশ ভয়ের একটা অভিজ্ঞতা।
ঘুম গবেষক জে অ্যালেন চেইনি ও টড জিরার্ড ২০০৭ সালে যুক্তি দেন যে ঘুমের মধ্যেকার প্যারালাইজড বা পেশির জড় অবস্থা থেকে যখন আমরা জাগি তখন আমরা একটা ভয়ের অবস্থায় থাকি- আমাদের মন বলে কিছু একটা খারাপ ঘটবে। মনের ভেতরে একটা শূন্য অবস্থা তৈরি হয়।
এ অবস্থায় সেই শূন্য স্থানে একটা ছবি বা পরিস্থিতি তৈরির সুযোগ মস্তিষ্কে গড়ে ওঠে।
অপর ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে এধরনের অশরীরী কিছুর অস্তিত্ব বা এধরনের অনুভূতি শুধু যে হিপনোগগিয়া অবস্থায় ও ঘুমের মধ্যকার প্যারালিসিসের সময় হচ্ছে তাই নয়, এমনটাও দেখা গেছে যে পার্কিন্সন ও সাইকোসিস রোগে, মুত্যুর মুখোমুখি পড়ার সময় ও প্রিয়জনের মৃত্যুর পর মানুষের এমন অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা হয়েছে। যেমন, ২০০৬ সালে নিউরোলজিস্ট শাহার আর্জি ও তার সহকর্মীরা এক পরীক্ষায় এক নারীর মস্তিষ্কের এক বিশেষ অংশে বৈদ্যুতিক কারেন্ট পাঠিয়ে তার সামনে একটি ‘ছায়া মূর্তি’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
ওই নারীর শরীর যে অবস্থানে রয়েছে তার প্রতিবিম্ব হিসাবে আসে ওই ছায়ামূর্তি। ওই পরীক্ষায় দেখা যায় মস্তিষ্কের বিশেষ ওই অংশটি উদ্দীপিত হলে তা অনুভূতি ও শারীরিক অবয়ব তৈরি করতে পারে। এদিকে, ২০১৪ সালে পর পর চালানো কয়েকটি পরীক্ষায় আরো দেখা যায় যে, মানুষ তার ইন্দ্রিয় দিয়ে যা দেখার প্রত্যাশা করছে তা এমনকি সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রেও বদলে দেয়া সম্ভব।
যেমন, গবেষকরা রোবট ব্যবহার করে তার চলাফেরার সঙ্গে মানুষের চলাফেরায় সামঞ্জস্য তৈরি করে দেখেছেন, মানুষ যখন ওই রোবটের গতিবিধির সাথে একাত্ম হয়ে যায়, তখন হঠাৎ করে রোবটের চলাফেরায় সামান্য হেরফের ঘটালে মানুষ মনে করে রোবটটা তো ছিল। অর্থাৎ রোবট না থাকলেও মানুষ ধরে নেয় রোবট আছে- যেটা হ্যালুসিনেশন- মানসিক বিভ্রম।
এই গবেষকরা অশরীরী কিছুর দেখার প্রক্রিয়ার পেছনে এটাকেই যুক্তি হিসাবে তুলে ধরছেন। অর্থাৎ স্লিপ প্যারালিসিসের সময় আমাদের শরীর ও মস্তিষ্কের কাজ যেহেতু বিঘ্নিত হয় তার ফলে তৈরি হয় একটা হ্যালুসিনেশন আর সেটাই আমাদের চারপাশে – বিশেষ করে আমাদের পেছনে অশরীরী ছায়ার মত কিছুর উপস্থিতি তৈরি করে।
আমরা ভাবি ঘরে অন্য কেউ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঘরে ‘অন্য কেউ’ আমরাই- আমাদের মনের ভাবনার ফসল।
মনস্তত্ত্ববিদ ড. বেন অল্ডারসন-ডে তার এই গবেষণা নিবন্ধে বলেন, ২০২২ সালে তার নিজস্ব গবেষণায় অশরীরী বস্তুর উপস্থিতি নিয়ে তিনি রোগীদের দেয়া বিবরণ, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার বিবরণ এবং খেলাধুলার জগতেও এ ধরনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা তুলনা করে দেখেন। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই হ্যালুসিনেশন বা কিছু দেখার অভিজ্ঞতা আছে।
তিনি দেখেন সবগুলো ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতার বেশ কিছু মিল রয়েছে। যেমন, সব ক্ষেত্রেই যাদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে তারা কারোর উপস্থিতি অনুভব করেছেন তাদের একেবারেই পেছনে।
তিনটি গোষ্ঠীর মানুষই এই ‘দেখাকে’ ঘুমের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বর্ণনা করেছেন। তারা আরো বলেন, মানসিক আবেগের মুহূর্তে এই ‘দেখার’ ঘটনা ঘটেছে। যেমন, দুঃখের মুহূর্তে বা প্রিয়জনের মৃত্যুর সময়। যদিও মানুষ অশরীরীর উপস্থিতি অনুভব করে এসেছে আজ বহু শতাব্দী ধরে, কিন্তু এ নিয়ে যথাযথ বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়েছে সবে।
আরো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়ত আমাদের সাধারণ কোনো একটা ব্যাখ্যা দেবে অথবা কেন কেউ কেউ ঘরের মধ্যে অশরীরী কারো উপস্থিতি টের পান, সেটি নিয়ে আসবে নতুন নতুন একাধিক তত্ত্ব।
আপাতত বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, মানুষজন ভূতপ্রেত কিংবা অশরীরী দেখার যেসব কাহিনি শোনান, তারা মৃত মানুষের অশরীরী প্রেতাত্মা নয়, এমনকি তারা জিন কিংবা ভূতপ্রেতও নয়। তারা মানুষের মস্তিষ্কের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অবচেতনভাব উঠে আসা কিছু প্রতিচ্ছবি। দ্য কনভারসেশন নামে এক গবেষণা ওয়েবসাইটে ড. বেন অল্ডারসন-ডে’র গবেষণা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।