জুমবাংলা ডেস্ক : কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের আটটি লোহার দানবাক্স ৩ মাস ১৩ দিন পর আবারও খোলা হয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দানবাক্সগুলো থেকে এবার ৫ কোটি ৭৮ লাখ ৩২৫ টাকা পাওয়া গেছে। গত শনিবার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখের উপস্থিতিতে দানবাক্স কমিটির আহ্বায়ক ও কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মহুয়া মমতাজের তত্ত্বাবধানে বাক্সগুলো খোলা হয়।
এর আগে চলতি বছরের ৬ মে দানবাক্সগুলো খোলা হয়েছিল। তখন ৪ মাসে ওই দানবাক্সগুলোতে জমা পড়েছিল ১৯ বস্তা টাকা। দিনভর গণনা শেষে এতে টাকার পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯ টাকা। এ ছাড়া জমা পড়েছিল বৈদেশিক মুদ্রা, সোনা ও রুপা।
দানবাক্স থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও সুষ্ঠু তদারকির জন্য কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ৩১ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষে জেলা প্রশাসককে সভাপতি, পৌরসভার মেয়র এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদককে সহসভাপতি এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী, নেজারত ডিপুটি কালেক্টর (এনডিসি), সদর মডেল থানার ওসি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ কমিটি গঠিত। সুশীল সমাজের পক্ষে একজন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া রয়েছে ওয়াকফ স্টেটের অডিটর কর্তৃক সাংবাৎসরিক অডিট ব্যবস্থা। বর্তমানে এটি পাগলা মসজিদ ইসলামিক কমপ্লেক্স নামে পরিচালিত হচ্ছে।
জানা যায়, মানবকল্যাণসহ জেলার বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসার উন্নয়নে পাগলা মসজিদের দানের বিপুল পরিমাণ অর্থের লভ্যাংশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয়ে আসছিল। তবে কয়েক বছর ধরে জেলার বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসার উন্নয়নকাজে টাকা বরাদ্দ বন্ধ রয়েছে। কারণ পাগলা মসজিদ কমপ্লেক্সেকে আন্তর্জাতিকমানের একটি ইসলামিক কমপ্লেক্সে নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে মসজিদ পরিচালনা কমিটি।
জানা যায়, শহরের হয়বতনগর জমিদার পরিবারের দেওয়ান আয়েশা আক্তারের ওয়াকফ করে দেওয়া ১০ শতাংশ জমির ওপর পাগলা মসজিদের গোড়াপত্তন হয়। বর্তমানে প্রায় চার একর জমির ওপর মসজিদ কমপ্লেক্স এবং তিন একর জমির ওপর পাগলা মসজিদ গোরস্তান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মসজিদের ব্যয়ে ২০০২ সালে মসজিদের পাশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা। আর এ বিপুল আয়-ব্যয় প্রতিবছর ওয়াকফ স্টেটের অডিটর কর্তৃক নিয়মিত নিরীক্ষা করা হয়। বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অডিট করা হয়। অডিট কাজ করেন জেলা ওয়াকফ স্টেটের পরিদর্শক।
এসব টাকা ব্যয় হয় যেসব খাতে
মসজিদ কমপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠিত নূরুল কোরআন হাফিজিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম হাফেজ মাওলানা মো. আব্দুল কাদির বলেন, পাগলা মসজিদের অর্থে এই মাদ্রাসার ১৩০ জন অসহায়, পিতৃ-মাতৃহীন এতিম শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। প্রতি মাসে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা শুধু শিক্ষার্থীদের খাবারের পেছনে ব্যয় হয়। শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ভরণপোষণ ব্যয়ও নির্বাহ করা হয় মসজিদের দান থেকে পাওয়া অর্থে। প্রতিবছরই মসজিদের অর্থায়নে নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয় তাদের।
পাগলা মসজিদ কমপ্লেক্সের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাবেক আনসার-ভিডিপি অফিসার মুক্তিযোদ্ধা শওকত উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, এ মসজিদ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব এক সেতুবন্ধ তৈরি করেছে। আর এ ইতিহাস প্রায় আড়াইশ বছরেরও বেশি সময়ের বলে জানা যায়। তিনি বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন এ কমপ্লেক্সটিতে। প্রতি মাসে পাগলা মসজিদের স্টাফ খরচ বাবদ ব্যয় হয় ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ বলেন, দানবাক্স থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থের লভ্যাংশের একটি বিশেষ অংশ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত দরিদ্র, অসহায়-দুস্থ ও এতিম মানুষের চিকিৎসার জন্য এবং এ ধরনের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার জন্য সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি অন্যান্য মসজিদ-মাদ্রাসার উন্নয়নে অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়।
২০২১ অর্থবছরে ১২৪ জন দুরারোগ্য ব্যাধিতে (ক্যান্সার, ব্রেনস্ট্রোক, হার্ট স্ট্রোক, কিডনি রোগ, প্যারালাইসিস ইত্যাদি) আক্রান্ত দরিদ্র ও দুস্থকে চিকিৎসার জন্য এবং দরিদ্র ও দুস্থ মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ার খরচ বাবদ ১৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা পাগলা মসজিদের ফান্ড থেকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া করোনাকালীন সময়ে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, পাগলা মসজিদের দানের টাকায় আন্তর্জাতিকমানের একটি ইসলামি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। কমপ্লেক্সটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে বানানো হবে। এ জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ থেকে ১২০ কোটি টাকা। সেখানে একসঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। ২০০ গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। পাঁচ হাজার নারীর জন্য নামাজের আলাদা ব্যবস্থা থাকবে।
বিগত আড়াই বছরে যে পরিমাণ টাকা জমা পড়েছে দানবাক্সগুলোতে-
২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি দানবাক্সগুলো খুলে পাওয়া গেছে ২ কোটি ৩৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৪৫ টাকা, এরপর ১৯ জুন পাওয়া গেছে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪৯৪ টাকা, একই বছরের ৬ নভেম্বর পাওয়া গেছে রেকর্ড পরিমাণ ৩ কোটি ৭ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৫ টাকা। পরে ২০২২ সালের ১৩ মার্চ পাওয়া গিয়েছিল ৩ কোটি ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার ২৯৫ টাকা, ৩ জুলাই পাওয়া গিয়েছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ ২৭ হাজার ৪১৫ টাকা, একই বছরের ২ অক্টোবর পাওয়া গিয়েছিল ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার ৮৮২ টাকা। ২০২৩ সালে ৭ জানুয়ারিতে পাওয়া গিয়েছিল ৪ কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা। ৬ মে দানবাক্সগুলোতে পাওয়া যায় ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯ টাকা। সবশেষ ১৯ আগস্ট অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দানবাক্সগুলো থেকে ৫ কোটি ৭৮ লাখ ৩২৫ টাকা পাওয়া গেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।