বিনোদন ডেস্ক : “এই গান ভাষা, ধর্ম, জাতীয়তার সব বাধা ভেঙ্গে ফেলেছে এবং সবার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। ভারত থেকে আমাদের ভালোবাসা।”
ভারতীয় উপমহাদেশে ইন্টারনেটের সবচেয়ে মধুরতম কর্নারে আপনাদের স্বাগতম- আর এটি হচ্ছে কোক স্টুডিও পাকিস্তানের কমেন্ট সেকশন!
‘কোক স্টুডিও’ পাকিস্তানের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা মিউজিক শো, যেটি তৈরি করে বহুজাতিক পানীয় কোম্পানি কোকা কোলা। পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু শিল্পীর গানের অনুষ্ঠান তারা রেকর্ড করেছে, যার মধ্যে আছে অপ্রচলিত অদ্ভুত গান থেকে শুরু করে র্যাপ বা হৃদয় দ্রবীভূত করা কাওয়ালি- এরকম নানা ধরণের গান। পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী লোকগান কিংবা সমৃদ্ধ কবিতার ধারার প্রভাব এসব গানে স্পষ্ট।
কোক স্টুডিও পাকিস্তানে শুরু থেকেই তুমুল জনপ্রিয়, তবে এই অনুষ্ঠানের প্রযোজকদের যেটি সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে, তা হলো, কিভাবে এটি ভারতীয়দেরও মন জয় করেছে। এই দুটি দেশের মধ্যে যে চরম শত্রুতা, তার প্রভাব প্রায়শই সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ওপরও প্রভাব ফেলেছে, অথচ দুটি দেশের রয়েছে অভিন্ন ইতিহাস।
“এমনকি কোক স্টুডিও পাকিস্তানও কোনদিন ভাবেনি তারা ভারত থেকে এত ভালোবাসা পাবে- এতটাই বেশি যে ভারতের নিজস্ব কোক স্টুডিওর চাইতেও বেশি সাফল্য পাবে”, বলছিলেন ভারতের জনপ্রিয় সুরকার শান্তনু মৈত্র। “আমার তো মনে হয় এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা।”
কোক স্টুডিও পাকিস্তানের ইউটিউব চ্যানেল ভারতীয়দের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভরা
পাকিস্তান এবং ভারতের সম্পর্কে যতই উত্তেজনা থাক, দুই দেশের মানুষ সব সময় পরস্পরের শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি একধরনের নৈকট্য অনুভব করেছেন।
কিংবদন্তী পাকিস্তানি সঙ্গীত তারকা গুলাম আলি কিংবা আবিদা পারভীনের গান গুন গুন করে গাইতে শোনা যায় লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে।
অন্যদিকে পাকিস্তানে তো কয়েক প্রজন্মের মানুষ বড়ই হয়েছে ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখে- বলিউডের বহু ছবি সেখানে বক্স অফিসের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। আবার পাকিস্তানের টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটকগুলো ভারতে বেশ জনপ্রিয়।
কিছু বছর আগেও দুই দেশের শিল্পীদের গান বা চলচ্চিত্রে এক সঙ্গে কাজ করতে দেখা গেছে। কিন্তু রাজনৈতিক বৈরিতা যখন সাংস্কৃতিক জগতেও ঢুকে পড়লো, তখন বলিউড পাকিস্তানি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বাদ দিতে শুরু করলো। অন্যদিকে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হলো ভারতীয় চলচ্চিত্র।
কিন্তু এই বৈরিতার মধ্যে কোক স্টুডিও এক ব্যতিক্রম।
পাকিস্তানে কোক স্টুডিওর যাত্রা শুরু সঙ্গীতশিল্পী রোহেইল হায়াতের হাত ধরে- তিনি কোক স্টুডিওর ১৪টি সিরিজের নয়টি প্রযোজনা করেছেন। ১৯৮০র দশকে হায়াত যখন বয়সে তরুণ, তখন পিংক ফ্লয়েড বা ‘ডোরস’ এর গানই তারা বেশি গাইতেন।
“আমরা তখন একটা পশ্চিমা সংস্কৃতির বুদ্বুদের মধ্যেই যেন বাস করতাম,” বলছেন তিনি। “তখন দেশিয় গান শোনা মানে যেন একটা অপরিশীলিত, গ্রাম্য ব্যাপার।
কিন্তু তার এই চিন্তা-ভাবনা একটা বিরাট ধাক্কা খেল, যখন তিনি রাহাত ফতেহ আলি খানের মতো বিখ্যাত কাওয়ালি শিল্পীদের সঙ্গে সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে কাজ শুরু করলেন।
“আমি তখন উপলব্ধি করলাম, আমাদের সঙ্গীতের গভীরতা আসলে কত বেশি। এটি যেন আমার এক বিরাট জাগরণের মুহূর্ত ছিল।”
হায়াত এরপর নানা ধরনের সঙ্গীত নিয়ে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। তার জন্য এটি ছিল এক অসাধারণ অভিযাত্রা।
তিনি পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত নিয়ে গভীর অনুসন্ধান চালালেন, এই সঙ্গীতকে এরপর তিনি নতুনভাবে ইলেকট্রনিক ল্যান্ডস্কেপে নিয়ে আসলেন।
“আমার চিন্তাটা ছিল কীভাবে পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়, তবে এই কাজটা আমি এমনভাবে করতে চেয়েছি যাতে এর রস সবাই আস্বাদন করতে পারে,” বলছিলেন তিনি।
কোকা কোলা ২০০৫ সালে তার এই উদ্যোগে যুক্ত হলো। ব্রাজিলে কোকা কোলা এরকম একটি কাজ করেছিল। সেটিতে অদল-বদল ঘটিয়ে তৈরি হলো কোক স্টুডিও পাকিস্তান।
শুরুতে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। হায়াত জানান, শুরুতেই অনেকেই সংশয় প্রকাশ করছিলেন এবং প্রথম সিরিজে পরীক্ষামূলক-ভাবে তাকে মাত্র তিনটি বা চারটি গান করতে দেয়া হয়। ২০০৮ সালে এসব বাজারে ছাড়া হয়।
“কিন্তু ঐ গানগুলোই শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল, কাজেই দ্বিতীয় সিরিজ যখন শুরু হলো, আমি একেবারে পূর্ণ উদ্যমে নেমে পড়লাম,” বলছিলেন তিনি।
কোক স্টুডিওর যারা ভক্ত, তারা এই অনুষ্ঠানের যে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড বা নিষিদ্ধ মেজাজ, সেটা বেশ পছন্দ করেন। এখানে যে ধারার সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়, সেটা প্রচলিত ধারার বাইরে, ঠিক নির্দিষ্ট কোন ঘরানায় ফেলা যাবে না।
“প্রতিটি গানের পেছনে যে কত ইতিহাস, কত অন্তর লুকিয়ে আছে,” বলছেন একজন ভারতীয় অনুরাগী যিনি বহু বছর ধরে কোক স্টুডিওর গান শুনছেন। “তবে একই সঙ্গে এই গানে আছে সেই ছন্দ-তাল-লয়, যা শুনে কিনা আপনি উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে চাইবেন।”
কোক স্টুডিও পাকিস্তানের সব ধরনের গানই তুলে এনেছে- পপ থেকে শুরু করে কাওয়ালি, তারপর এসব গান তারা পরিবেশন করেছে একটি মাত্র প্ল্যাটফর্মে, বলছেন পাকিস্তানি পপ ব্যান্ড স্ট্রিংস এর প্রধান গায়ক ফয়সল কাপাদিয়া। এই দলটি কোক স্টুডিও পাকিস্তানের চারটি সিরিজ তৈরি করে।
এই গানের অনুষ্ঠানটি যে পুরনো হচ্ছে না, তার কারণ এর নির্মাতারা এটিকে সারাক্ষণই নতুন রূপে নিয়ে আসছেন।
“যখনই একজন নতুন প্রযোজক দায়িত্ব নিচ্ছেন, তখন তারা তাদের নিজস্ব ছাপ নিয়ে আসছেন তাদের সঙ্গীতে। প্রতিটি সিরিজে আপনি একটা আলাদা আমেজ পাচ্ছেন,” বিবিসিকে বলছিলেন মি. কাপাদিয়া।
হায়াত যেখানে ইচ্ছেকৃতভাবে তার সঙ্গীতে একধরনের সাইকেডেলিক আমেজ নিয়ে এসেছেন, তখন ফয়সল কাপাদিয়া খুব বেশি মাত্রায় ব্যবহার করেছেন সুফি সাধক আমির খসরুর ঐতিহ্যবাহী কবিতা, তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন পপ সঙ্গীতের অনেক উপাদান, যেটা তার ব্যান্ড দলের মূল বৈশিষ্ট্য, এবং ক্লাসিক্যাল চলচ্চিত্র সঙ্গীত, যেগুলো শুনে তিনি বড় হয়েছেন।
“এটা অনেকটা জেমস বন্ডের ছবির মতো। যতবার ছবির নায়ক বদলে যায়, ছবির থিম একই থাকলেও এটা দেখার অনুভূতিতে কিন্তু একটা ভিন্নতা পাওয়া যায়,” বলছেন মি. কাপাদিয়া।
হায়াত চেয়েছিলেন সঙ্গীতের খুব বেশি সহজি-করণ না করে কিভাবে একে নতুন করে আবিষ্কার করা যায়।
“কিভাবে আমরা মূল সঙ্গীতের অনেক বেশি কাছাকাছি যেতে পারি এবং একই সঙ্গে পশ্চিমাদের কাছে এই সঙ্গীতকে বোধগম্য করে তুলতে পারে, এটা ছিল তার একটা নিরীক্ষা,” বলছিলেন তিনি।
পাকিস্তানি সঙ্গীত শিল্পী জেব বাঙ্গাস, যিনি কোক স্টুডিওর অনুষ্ঠানে প্রায়শই অংশ নেন, তিনি বলছেন, ভারতে এর জনপ্রিয়তার এটা একটা কারণ।
“ভারতীয়দের কাছে ফিউশন মিউজিক তো নতুন কিছু নয়। আপনি ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালক আর ডি বর্মনের গান দেখুন- তিনি কিন্তু ক্রমাগত জ্যাজ এবং আফ্রো-ফাংক বিট, সুর, লয় তার গানে নিয়ে এসেছেন, এবং ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতের সঙ্গে তার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন,” বলছিলেন তিনি।
তবে কোক স্টুডিও একই সঙ্গে সগৌরবে পাকিস্তানের স্থানীয়, লোকজ সঙ্গীতের ধারাকে এমনভাবে তুলে এনেছে, নতুন রূপ দিয়েছে এবং তা মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছে, যেটা আর আগে এভাবে ঘটেনি।
“এটা, আর তার সঙ্গে খুব চমৎকার, সুচারু শব্দ সীমান্তের সব দিকে মানুষের কল্পনাশক্তিকে ধারণ করতে পেরেছে,” বলছিলেন মি. বাঙ্গাস।
শান্তনু মৈত্রের বিশ্বাস, কোক স্টুডিও ভারতেও এক নতুন পরিবর্তনের হাওয়া নিয়ে এসেছে, যেখানে চলচ্চিত্র, বিশেষ করে বলিউডের সঙ্গীত খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে।
“বলিউড একটা ব্লটিং টেবিলের মতো। এটি যে কোন ভালো জিনিস শুষে নেয়, তারপর সেটা নিজের মতো করে বানায়। এমনকি বিকল্প সঙ্গীত বা এর কথা পর্যন্ত,” বলছিলেন তিনি।
আর বলিউড হচ্ছে একটি দৃশ্য-তাড়িত শিল্প, যেখানে প্রায়শই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আবেগ-সর্বস্ব প্রেমের গানে ঠোঁট মেলাতে দেখা যায় এবং পেছনে থাকে অতিরঞ্জিত পটভূমি।
“এর বিপরীতে কোক স্টুডিওতে সঙ্গীত শিল্পীরাই থাকেন মনোযোগের কেন্দ্রে, এবং আমার মনে হয় সেটাই এখানে একটা বিরাট পার্থক্য করে দিচ্ছে,” বলছেন শান্তনু মৈত্র।
তবে অন্য সবকিছুর চেয়ে এই গানের অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় সাফল্য যেটা, তা হলো প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যেও কিভাবে গানের সংস্কৃতি বিকশিত হতে পারে।
এক বন্ধু যেমন রসিকতা করে বলছিলেন, এটি রুমির প্রবাদতুল্য সেই স্থান, যার অবস্থান ভুল কাজ আর সঠিক কাজের বাইরে কোথাও।
শান্তনু মৈত্রের ধারণা, কোক স্টুডিওর মতো অনুষ্ঠানের সাফল্য ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার আশা দেখাচ্ছে।
“এই সম্পর্কে অনেক অন্ধকার পর্ব আছে, তবে এখানে উজ্জ্বল অনেক পর্বও আছে, এবং যখন এরকম উজ্জ্বল কিছু ঘটে, তখন শিল্পীরা আবার একসঙ্গে কাজ করবে।”
সীমান্তের অপর পারে একই ধরনের মনোভাবের প্রতিধ্বনি শোনা গেল তার সহ-শিল্পীদের কথায়।
জেব বাঙ্গাস ২০১১ সালে শান্তনু মৈত্র এবং অন্যান্য সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে তার “চমৎকার এবং আশ্চর্য” অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে বললেন, “তারা কেবল বন্ধুই হতে চাইছিলেন না, তারা ইচ্ছুক ছিলেন একটা সত্যিকারের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য।”
মি. কাপাদিয়াও ভারতে গিয়ে আবার অনুষ্ঠান করতে খুবই উদগ্রীব।
“ভারতীয় দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা আমরা পেয়েছি, তা চমৎকার। আমরা খুবই ভাগ্যবান।”
ওয়েব সিরিজে বোল্ড দৃশ্যে অভিনয় করে তাক লাগালেন এই অভিনেত্রী
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।