জুমবাংলা ডেস্ক : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডে (বিডিসিসিএল) জনবল নিয়োগে সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন পদে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের চাকরি পাইয়ে দিতে সুপারিসসহ আবেদনের শর্ত শিথিল, পরীক্ষাকেন্দ্র পরিবর্তনসহ নানা অনিয়মের প্রমাণ এখন স্পষ্ট। নাটোর জেলার বিশেষ করে তার নির্বাচনী আসন সিংড়া উপজেলার অন্তত এক ডজন বাসিন্দাকে শুধু ডাটা সেন্টারেই চাকরি দিয়ে গেছেন টানা তিন মেয়াদের সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী।
যোগ্য প্রার্থীর আবেদনের সুযোগ রহিত করা, এমনকি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের উচ্চ পদে চাকরি দিয়েছেন তিনি।
২০২২ সালে বিডিসিসিএলের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, কারিগরি ও সাধারণ-এ দুই ক্যাটাগরিতে ৪১ পদে নিয়োগের জন্য আগ্রহীদের থেকে অনলাইনে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে শুধু পাঁচটিতে আবেদনের যোগ্যতা শিথিল করা হয়।
সেগুলো হলো ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং), ব্যবস্থাপক (লজিস্টিকস), নিরাপত্তা কর্মকর্তা, স্টোরকিপার ও নিরাপত্তারক্ষী। শুধু আইসিটি বিভাগ ও এর অধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের জন্য শর্ত শিথিল করা হয়েছে তিনটি পদে ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং), ব্যবস্থাপক (লজিস্টিকস) ও স্টোর কিপার।
শিথিলকৃত শর্ত হলো আইসিটি বিভাগ ও এর অধীন দপ্তর এবং সংস্থায় কর্মরত প্রার্থীদের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা বিবেচনায় অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে বয়সসীমা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলযোগ্য।
অবাক করার বিষয়, একই গ্রেড-৫ মর্যাদার ‘ব্যবস্থাপক’ পদ ছিল পাঁচটি, যার শুধু দুটিতেই শিথিল শর্ত আরোপ করা হয়েছে। বাকিগুলোতে এ ধরনের শিথিলতা ছিল না। এই দুটি পদে নিয়োগ পেয়েছেন আইসিটি বিভাগের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী পলকের দুজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। প্রতিমন্ত্রীর তৎকালীন একান্ত সহকারী সচিব (এপিএস) রনজিত কুমার নিয়োগ পান ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং) পদে। ফলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ২২ হাজার টাকা বেতন স্কেলের রনজিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে ৫৫ হাজার টাকা বেতন স্কেলে চাকরি পান।
রনজিতের চাকরি নিয়ে বিতর্ক ছিল আরও। চাকরিতে যোগদানের পরেও রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। ২০২২ সালের অক্টোবরে গঠিত নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিতে সহসভাপতি ছিলেন তিনি। এক সময় সভাপতির অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
রনজিতের মতো বিশেষ সুবিধায় ব্যবস্থাপক (লজিস্টিকস) পদে চাকরি পেয়েছেন তারও ১ গ্রেড নিচে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগকৃত পলকের সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) ইকরামুল হক। ১৬ হাজার টাকার বেতন স্কেলের ইকরাম তিনগুণেরও বেশি, অর্থাৎ ৫০ হাজার টাকা স্কেলের বেতনের চাকরি পান। ব্যবস্থাপক (লজিস্টিক্স) পদে আবেদনের বয়সসীমা ছিল ৩৭ বছর। তবে আবেদনকালে তার বয়স ছিল ৪৫ বছরেরও বেশি।
একই বিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রনজিত, ইকরামসহ ব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) মুরাদ আলম মুনির, ব্যবস্থাপক (হিসাব ও অর্থ) ফিরোজ শরীফ, সহকারী ব্যবস্থাপক (হিসাব ও অর্থ) তৌকির আহমেদ, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সালমা মারিয়া স্মৃতিকে কোনো ধরনের গোয়েন্দা ভেরিফিকেশন ছাড়াই নিয়োগ চূড়ান্ত করে যোগদান করা হয়।
বাকি ৩৫ জনকে ভেরিফিকেশনের নামে প্রায় এক বছর পর নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। এই ছয়জনের মধ্যে সহকারী ব্যবস্থাপক তৌকির আহমেদ আইসিটি বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলমের জামাতা। জিয়াউল আলম পদাধিকার বলে ডাটা সেন্টার কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং নিয়োগ কমিটিরও প্রধান ছিলেন। অন্যদিকে এই নিয়োগ পরীক্ষার একটি বড় অংশ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধীন হলেও ব্যবস্থাপক চারজনের পরীক্ষা হয়েছে আইসিটি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে (বিসিসি)।
অন্যদিকে নাটোরে বাড়ি অথবা শ্বশুড়বাড়ি এমন ব্যক্তিদের দেদারসে চাকরি দিয়েছেন পলক। কখনো কখনো তৎকালীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এবং নেতাদের সুপারিশেও পলক চাকরি বিলিয়েছেন বলে গণমাধ্যমকে আইসিটি বিভাগের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। উপব্যবস্থাপক (ক্লাউড) আরজুমান্দ লুৎফা (শ্বশুড়বাড়ি সিংড়ায়), সহকারী ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং) দোলা সাহা, অফিস সহায়ক রাকিব হোসাইন ও শিবলী নোমান, মালি আহমেদ আলী ও আন্টু প্রামাণিক, গার্ড মোহাম্মদ শাহীন এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী শাওন হাওলাদারের চাকরি হয়েছে পলকের সুপারিশে।
তাদের প্রত্যেকের বাড়ি নাটোর জেলায়। নিরাপত্তা কর্মকর্তা রুস্তম আলীর চাকরির সুপারিশ করেছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম। ব্যবস্থাপক মুরাদ আলম মনিরের চাকরির সুপারিশ করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এক মুখ্য সচিব। সহকারী ব্যবস্থাপক (লজিস্টিকস) এম এম মঈনুল হোসেন পলকের তৎকালীন একান্ত সচিব ও বগুড়ার বর্তমান জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামের আত্মীয়।
এমনকি ব্যবস্থাপক ফিরোজ শরীফ এবং ব্যবস্থাপক (নেটওয়ার্ক ও ট্রান্সমিশন) কামরুজ্জামান বুয়েটের অধীন পরিচালিত নিয়োগ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। কিন্তু তাদের চাকরি দিতে মরিয়া পলকের তৎকালীন প্রশাসন বিসিসির অধীনে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা নিয়ে তাদের ‘কৃতকার্য’ দেখান। পছন্দের ব্যক্তিদের চাহিদামতো পদে বসাতে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দেওয়ার মতো নজিরও রয়েছে বিডিসিসিএলে। সহকারী ব্যবস্থাপক (নেটওয়ার্ক) হীরক মুৎসুদ্দী কামরুজ্জামানের ব্যবস্থাপক (নেটওয়ার্ক ও ট্রান্সমিশন) পদে বুয়েটের অধীন পরীক্ষায় কৃতকার্য হলেও তাকে মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য দেখানো হয়েছে। একইভাবে উপব্যবস্থাপক (ক্লাউড) পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও মৌখিকে বাদে পড়েছেন সহকারী ব্যবস্থাপক (ক্লাউড) শোভন ধর। এই পদেই চাকরি দেওয়া হয় আরজুমান্দ লুৎফাকে।
বিডিসিসিএলে পছন্দের ব্যক্তিদের চাকরি দেওয়ার নজির এটিই প্রথম নয়। ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর একইদিন তিনটি পৃথক স্মারক নম্বরে মোট ২৮টি পদে ৬৭ জনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় বিডিসিসিএল। এগুলোতে শুধু ‘ফোর টায়ার জাতীয় ডাটা সেন্টার স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পে কর্মরতদের আবেদনের সুযোগ রাখা হয়। অর্থাৎ প্রকল্পের বাইরের কাউকে এসব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার, বা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগই দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির জনবল নিয়োগবিধিতে এমন নিয়োগের বিধান নেই। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টায় ও স্বচ্ছ দেখানোর জন্য দরখাস্ত আহ্বানের বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশও করে বিডিসিসিএল। এতে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হয়েছে বলেও অভিমত আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তাদের।
এক কর্মকর্তা ক্ষোভ জানিয়ে দেশের একটি গণমাধ্যমকে জানান, শুধু প্রকল্পের কর্মীদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হলে বড় করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? প্রকল্প অফিসে একটি নোটিশ ঝুলিয়ে দিলেই হতো। অথবা প্রকল্প পরিচালকের মাধ্যমে সবার কাছে ইমেইল করা যেত। রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করে বিজ্ঞাপন দিয়েছে শুধু নিয়োগ প্রক্রিয়াকে খালি চোখে স্বচ্ছ দেখানোর জন্য। এর মাধ্যমে প্রকল্প থেকে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের চাকরি দেওয়া হয়।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, প্রকল্পের সাবেক পরিচালক আবু সাঈদ চৌধুরী প্রথমে সরাসরি বিডিসিসিএলের এমডি পদ বাগিয়ে নেন। পরে সাধারণভাবে এমডি নিয়োগের সময় আইসিটি বিভাগের কন্ট্রোলার অব সার্টিফাইং অথরিটিতে বদলি নিয়ে এই পদে আবেদন করেন আবু সাঈদ। আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে প্রথমে পাঁচজন এবং পরবর্তী সময়ে তিনজনকে সংক্ষিপ্ত বাছাই তালিকায় রাখা হয়। এই নিয়োগে কোনো কমিটি হয়নি বরং বিডিসিসিএল বোর্ড সরাসরি এমডি নিয়োগ করে।
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, বিডিসিসিএলে বোর্ডসহ বিভিন্ন স্তরে নিজের ঘনিষ্ঠজনদের আগেই বসিয়েছিলেন আবু সাঈদ। পরবর্তী সময়ে তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে নিজের এমডি পদের নিয়োগ বাগিয়ে নেন তিনি।
বিডিসিসিএলের নিয়োগের এমন অনিয়ম নিয়ে সে সময়ের এমডি ও বর্তমানে অবসরে থাকা আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের একটি সূত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, নিয়োগ বিতর্ক এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়ে আইন অনুযায়ী কী করা যায়, সে বিষয়টি দেখা হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ অফিসে আসছেন না। অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের অফিসে আর না আসতে বলে দেওয়া হয়েছে। তারা নিজেরা সরে না গেলে (পদত্যাগ) সরিয়ে দেওয়া হবে (চাকরিচ্যুত)।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।