জুমবাংলা ডেস্ক : দেখতে অনেকটা বড় পেঁপেঁর মতো। কিন্তু আদতে এগুলো পেঁপেঁ নয়, লেবু। একেকটি লেবুর ওজন এক থেকে দুই কেজি পর্যন্ত। তবে আকৃতির চেয়েও বিস্ময়কর এর দাম। ভাবা যায়, একটি লেবুর দাম প্রায় ৮০০ টাকা। আর হালি হিসেবে কিনলে প্রতি হালির দাম পড়ে ৩ হাজার টাকা।
সিলেটের বাজারগুলোতে বিক্রি হয় বিশাল আকৃতি আর উচ্চমূল্যের এই লেবুগুলো। দাম যতই হোক, সিলেটে এ লেবুর রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। দেশের বাইরে থাকা সিলেটিদের কাছেও এটি রপ্তানি হয়। তবে এটি সাধারণ কোন লেবু নয়, বিশেষ এক জাতের লেবু। যার নাম- জারা।
সাইট্রাস গোত্রের এই ফল দেশের মধ্যে কেবল সিলেট জেলায়ই চাষ হয়। আর হয় সিলেটের পার্শ্ববর্তী ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে। সিলেটে বছরজুড়েই এর চাহিদা থাকে। দামও থাকে অধিক।
গত রোববার সিলেট নগরের বন্দরবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতি পিস জারা লেবু ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর হালি হিসেবে কিনলে দাম পড়ছে ৩ হাজার টাকা।
জারা লেবুর সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায়। সম্প্রতি এই উপজেলার হরিপুর বাজারে গিয়েও দেখা যায়, প্রতি পিস লেবু আকারভেদে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা হাঁকছেন বিক্রেতা।
জারা কী
জারা একটি লেবু জাতীয় ফল। আর্দ্র ও অম্লীয় মাটি এবং উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে এর ফলন হয়ে থাকে। এই লেবু চাষে প্রচুর বৃষ্টিপাত প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে সিলেটের জৈন্তাপুরে রয়েছে সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র। দীর্ঘদিন ধরে জারা নিয়ে গবেষণা চলছে এই কেন্দ্রে। উদ্ভাবন করা হয়েছে নতুন জাতও।
সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, জারা লেবু সাইট্রাস গোত্রের মধ্যে ‘ইউনিক’ ফল। এর সাথে অন্য কোন জাত মিলবে না। সাইট্রাস গোত্রের আদি তিনটি ফলের মধ্যে রয়েছে কমলা, বাতাবি লেবু ও জারা লেবু। এগুলোর মধ্যে ক্রসিং হয়ে এবং প্রাকৃতিক উপায়ে হাইব্রিড হয়ে পরে আরও অনেক জাত হয়েছে।
স্বাদ ও গন্ধে জারা লেবু ‘ইউনিক’ উল্লেখ করে এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, জারার উৎপত্তি সিলেটের উপরে আসাম ও মেঘালয় এলাকার পাহাড়ে। জারার অনেকগুলো ধরন রয়েছে। এরমধ্যে গোল জারা, গুটি জারা ও পানি জারা সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। সিলেট অঞ্চলে মূলত গুটি ও পানি জারা চাষ হয় বলে জানান তিনি।
বোরহান উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, আমরা ২০১৯ সালে ‘বারি-১’ নামে জারার একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করে উন্মুক্ত করেছি। এখন আরও কয়েকটি জাত নিয়ে কাজ করছি।
সিলেটের মাটিকে জারা চাষের উপযুক্ত জানিয়ে তিনি বলেন, জারা চাষের জন্য টিলা ভূমির অম্লীয় মাটি প্রয়োজন। যেখানে প্রচুর বৃষ্টি হবে। কিন্তু বৃষ্টির পানি জমে থাকবে না। দ্রুত নিষ্কাষন হবে। একারণে সিলেট এই ফল চাষের জন্য উপযুক্ত।
যেভাবে খাওয়া হয়
সাধারণত লেবুর রস খাওয়া হয়ে থাকে। তবে জারা লেবুর খোসা আর চামড়াই বেশি সুস্বাদু। জারা লেবুর চামড়া ও খোসা বেশ পুরু, তবে রসের পরিমাণ খুবই কম। সালাদ হিসাবে জারা লেবুর কদর সবচেয়ে বেশি। এছাড়া জারা দিয়ে আচারও তৈরি করা হয়।
সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বারহান উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, জারা লেবুর খোসা ও চামড়ায় একটি বিশেষ ধরণের মিষ্টি স্বাদ রয়েছে। এছাড়া এর গন্ধও আলাদা। স্বাদ ও গন্ধের কারণে এটি ভোজনরসিকদের প্রিয়।
তিনি বলেন, সাইট্রাস গোত্রের মধ্যে কেবল জারার চামড়াই রান্না করে এবং রান্না ছাড়া খাওয়া যায়।
সিলেটের রন্ধনশিল্পী সেলিনা চৌধুরী বলেন, জারা লেবুর রসের স্বাদ টক আর খোসা মিষ্টি। এর রস বিভিন্ন খাবারের সাথে খাওয়া হয়। এছাড়া তরকারিতেও দেওয় হয়। আর খোসা রান্না ছাড়া সালাদ হিসেবে খাওয়া হয়। এবং মাছ দিয়ে তরকারি রান্না করেও খাওয়া হয়। এছাড়া খোসা দিয়ে আচারও হয় বলে জানান তিনি।
তবে মাংসের সাথে জারার খোসা রান্না করা যায় না জানিয়ে সেলিনা বলেন, এতে মাংসের স্বাদ তেতো হয়ে যায়।
কোথায় চাষ হয়
সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলার টিলাভূমিতে জারা লেবুর চাষ হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় জৈন্তাপুর উপজেলায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সিলেট জেলায় জারা লেবুর প্রায় ১৫০ বাগান রয়েছে। এরমধ্যে জৈন্তাপুর উপজেলায়ই রয়েছে প্রায় ৬০টি বাগান। তবে বছরে কী পরিমাণ জারা উৎপাদন হয় তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই কৃষি অফিসের কাছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের উপ পরিচালক মো. সালাউদ্দিন বলেন, এই লেবু চাষ খুবই লাভজনক। কারণ এর ক্রেতা মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। সিলেটের প্রচুর সংখ্যক মানুষ ইউরোপ-আমেরিকায় থাকেন। তারাই এই লেবুগুলো কিনে নেন। ফলে এগুলো অনেক উচ্চ দামে বিক্রি হয়। তাছাড়া সিলেট ছাড়াও দেশের অন্যান্য স্থানেও এই লেবুর চাহিদা বাড়ছে। ফলে জারা চাষ করে সহজেই লাভবান হওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, সঠিকভাবে পরিচচর্যা করলে চারা রোপণের এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে ফল ধরে। একটি গাছ থেকে অনেক বছর ফলন পাওয়া যায়।
এখন সিলেটের বাইরেও অনেকে ছাদ বাগানে জারা চাষ করছেন বলে জানান তিনি।
জৈন্তাপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি জারা লেবু চাষ হয়। এই ইউনিয়নের বাগেরখাল গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি ৫০ শতক ভূমিতে লেবু চাষ করি। সাধারণ বর্ষাকালে এর ফলন হয়।
আগে কেবল নিজেরা খাওয়ার জন্য চাষ করতেন জানিয়ে সাইফুল বলেন, এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছি। গত বছরও লাখখানেক টাকার জারা বিক্রি করেছি। বাজারেও নিয়ে যেতে হয়নি। বাগান থেকে ব্যবসায়ীরা এসে নিয়ে গেছেন।
এই এলাকার আরেক লেবু চাষী খাইয়রুল ইসলাম বলেন, পরিণত একেকটি গাছে সহস্রাধিক লেবু ধরে থাকে। তবে বৃষ্টি ভালো না হলে ফলন কমে যায়। লেবুতে নানা পোকাও আক্রমণ করে।
কেন এতো দাম
লেবুর জন্য বিখ্যাত জৈন্তাপুরের হরিপুর। সম্প্রতি হরিপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায় বাহার উদ্দিন নামে এক বিক্রেতা নিয়ে বসেছেন গোটা বিশেক জারা লেবু। এদের মধ্যে বড় আকারের প্রতি পিস লেবু ৮০০ টাকা দাম হাঁকছেন তিনি।
লেবুর এতো দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে বাহার বলেন, এখন তো লেবুর মৌসুম না। এটি বর্ষাকালে ভালো পাওয়া যায়। আরও দুই মাস পরে দাম কমবে। এখন নানা জায়গা থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনে আনতে হয়। ফলে বেশি দামে বিক্রিও করতে হয়।
সিলেট নগরের মধ্যে কেবল বন্দরবাজারে গিয়ে জারা লেবু বিক্রি হতে দেখা যায়। এখানে আকৃতিভেদে দামের তারতম্য রয়েছে। বড় আকারের লেবু প্রতিটি ৮০০ টাকা ও ছোট আকারেরগুলো প্রতিটি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এই বাজারের লেবু বিক্রেতা জাহাঙ্গির আলম বলেন, বর্ষা মৌসুমে এসব লেবুর হালি ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু এখন লেবুর মৌসুম না হওয়ায় আমরাই দাম দিয়ে কিনে আনি। ফলে দাম দিয়ে বিক্রি করি।
তিনি বলেন, বন্দরবাজারে বিক্রি হওয়া লেবুগুলো জৈন্তাপুরের বিভিন্ন বাগান থেকে আনা। বাগান থেকে পাইকারী ব্যবসায়ীরা কিনে আনেন। তাদের হাত ঘুরে বন্দরবাজারের খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আসে লেবু।
তবে দাম বৃদ্ধির ভিন্ন কারণ দেখালেন রোববার এই বাজারে জারা লেবু কিনতে আসা ফয়সল আহমদ। তিনি বলেন, এই লেবুগুলোর ক্রেতা সাধারণত প্রবাসীরা। প্রবাসীদের আত্মীস্বজনরা এগুলো কিনে বিদেশে পাঠিয়ে থাকেন। প্রবাসীরা মূল ক্রেতা হওয়ায় ব্যবসায়ীরা দাম অহেতুক অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। একারণে আমরা এগুলো কিনতে পারছি না।
১৫ বছর ধরে বন্ধ রপ্তানি
জারা লেবুসহ সাইট্রাস গোত্রের বিভিন্ন ফল সিলেট থেকে রপ্তানি হতো ইউরোপ ও আমেরিকায়। তবে ১৫ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে রপ্তানি। ক্যাংকারস নামক একধরণের ভাইরাস আক্রমণের কারণে ২০০৭ সালে সাইট্রাস গোত্রের ফল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাজ্যের সরকারী স্বাস্থ্য সংস্থা ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট ফুড রিসার্চ এসোসিয়েশন (ডেফরা)। এখন পর্যন্ত সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়নি।
জালালাবাদ ভেজিটেবল এন্ড ফ্রোজেন ফিশ এক্সপোটার্স গ্রুপের সভাপতি হিজকিল গুলজার জানান, ইউরোপ ও আমেরিকায় জারা লেবু, সাতকরাসহ সাইট্রাস গোত্রের ফলের বড় বাজার রয়েছে। আগে প্রচুর রপ্তানি হতো। এখন দীর্ঘদিন রপ্তানি বন্ধ থাকায় আমরা এই বাজার হারাতে বসেছি।
তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় সাইট্রাস ক্যাংকারস জটিলতা দূর করে সিলেটে সরকারি উদ্যোগে সবজি ও ফল রপ্তানি অঞ্চল স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছি। কৃষকদের সাইট্রাস মুক্ত ফল উৎপাদনে প্রশিক্ষিত করার কথা বলছি। কিন্তু কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
সাইট্রাস গোত্রের ফল ক্যাংকারসমুক্ত করা গেলে বছরে কয়েক শ’ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব বলে জানান এই রপ্তানিকারক।
হিজকিল বলেন, এখন ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে নিজেদের প্রবাসী আত্মীয়স্বজনের কাছে লেবু ও সাতকরা পাঠিয়ে থাকেন। তবে বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি হ০য় না।
সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, বাগান বেশি পুরনো হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিতভাবে বাগান তৈরি, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় না রেখে গাছ লাগানো, নিয়ম মেনে ওষুধ ব্যবহার না করা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব থেকেই সাধারণ সাইট্রাস বাগানে ক্যাংকারস ভাইরাসের বিস্তার ঘটে।
তিনি বলেন, নিজেদের বাগান ক্যাংকারসমুক্ত রাখতে আমরা চাষীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এর ফলে সিলেট অঞ্চলের বেশিরভাগ বাগানই ক্যাংকারসমুক্ত করা গেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।