লাইফস্টাইল ডেস্ক : স্টোররুমের চেয়ে ছোট্ট একটি বন্ধ ঘরে নিজেকে কল্পনা করুন…টিভি, ফোন বা ল্যাপটপ কোনকিছুই নেই। কারো সাথে কথা বলারও অনুমতি নেই। বাইরের জগতের সাথে একমাত্র সংযোগ হল ছোট একটি গর্ত, যেখান থেকে শুধু খাওয়ার সামান্য ব্যবস্থা করা হয়। পরিস্থিতিটা কারাবাসের চেয়ে কোন অংশে কম না, তবে এটি এমন একটি অভিজ্ঞতার অংশ যা শুনলে যে কোন বিবেকবান মানুষের মনকে নাড়া দিবে।
হ্যা পাঠক, পূর্ব এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেক বাবা-মা আজকাল এ পথ বেছে নিয়েছেন। লক্ষ্য হচ্ছে তাদের সন্তানদের একাকিত্ব বা বিষন্নতা অনুধাবন করা। একাকিত্বের জ্বালা যে কতটা ভয়াবহ পীড়াদায়ক তা জানতেই তিনদিনের স্বেচ্ছাকারাবাসের কর্মসূচি গ্রহণ করছেন তারা।
প্রত্যেক বাবা-মায়ের কাছেই সন্তান তাদের প্রাণের চেয়েও মূল্যবান বস্তু। এই সন্তান যদি সামাজিক অস্থিরতা বা কোন কারণে নিজেদের পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে একাকিত্ব বরণ করে তা পিতামাতাদের কাছেই সত্যিই কষ্টের। তাই সন্তানদের এই মানসিক যন্ত্রণা বুঝতে তারাও নির্জন কক্ষে নিজেদের রাখার চিন্তা—ভাবনা করেন। গ্যাংওয়ান প্রদেশের অনেক অভিভাবক এভাবেই বুঝতে চেয়েছেন নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখলে কি মানসিক কষ্ট হয়।
কী আছে এই স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নকরণ কর্মসূচিতে
মূলত এতে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য সেশন, যার মাধ্যমে সংসারের জটিল জীবন থেকে কীভাবে একটু সময় বের করে সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার বন্ধনকে আরো দৃঢ় করা যায়। অল্প অল্প করে সন্তানদের সময় দেওয়ার মাধ্যমে যে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ ঘটানো যায় সে ব্যাপারে ফোকাস করা হয়। সর্বোপরি সন্তানদের উদ্বেগ ও উত্কন্ঠার অনুভূতি জানতে অভিভাবকরা এই কঠিন পথকে বেছে নিয়েছেন। যাতে করে বুঝা যায় তাদের সন্তানরা দিনে দিনে কীভাবে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে।
জিন ইয়ং-হে (ছদ্দনাম) নামে একজন মা বলেছেন, তার ছেলে তিন বছর ধরে তার বেডরুমে ছিল। কলেজ ছাড়ার পর, তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি অবহেলা করেন এবং এমনকি খাবার এড়িয়ে যান। এটি আমার হৃদয় ভেঙ্গে দেয়। আর এ প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে আমি এই স্বেচ্ছা একাকিত্ব কর্মসূচিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছি। সন্তানের ভালোর জন্যই আমি এ পথ বেছে নিয়েছি। আমি মনে করি এর মাধ্যমে আমি নতুন কোন জ্ঞান অর্জন করতে পারবো যা আমার সন্তানের মানসিক বিকাশে সহায়ক হবে।
বাড়ছে বিষন্নতা ও আত্মহত্যার হার
গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে , ১৫ হাজার তরুণের মধ্যে ৫ শতাংশেরও বেশি স্ব-বিচ্ছিন্ন ছিল। সহকর্মীদের চেয়ে তাদের কম জীবন সন্তুষ্টি ও ভগ্ন মানসিক স্বাস্থ্য ছিল। কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর হেলথ অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের গবেষক কিম সেওঙ্গা বলেন, বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। আমরা এর কারণ বের করার চেষ্টা করেছি। মূলত কাজের চাপ, মানসিক চ্যালেঞ্জ ও পারিবারিক প্রত্যাশার ঘাটতি থেকেই এসবের জন্ম নিযেছে। এ কারণে স্ববিচ্ছিন্নকরণ বিষয়টি তাদের মাথায় গেড়ে বসেছে। এ সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় থেকে একসময় তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দেয়।
২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় সমস্ত কিশোর-কিশোরী মৃত্যুর দুই-পঞ্চমাংশ আত্মহত্যার সাথে জড়িত। সরকারকে এই সমস্যাটি মোকাবেলায় একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চালু করতে হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় খরচে ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী প্রত্যেকের প্রতি দুই বছরে একবার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ঘোষণা দিয়েছেন মন্ত্রীরা। দক্ষিণ কোরিয়ার কিয়ুং হি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জেয়ং গো-উন বলেন, কোরিয়ার সমাজে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বড় ধরনের লক্ষ্য অর্জনের চাপ তরুণদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, বিশেষ করে দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার সময়ে।
হোসিও বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক কিম হাই-ওন বলেছেন, যে দক্ষিণ কোরিয়ার যুবকরা একটি ঐতিহ্যগত জীবন পথ অনুসরণ করার চেষ্টা করে। এর মধ্যে রয়েছে ২০ এর পর চাকরি নিশ্চিত করা, ৩০ এ বিয়ে, ৪০ এ সন্তানের বাবা-মা হওয়া। এই পথ থেকে কোন বিচ্যুতি হলেই হতাশার জন্ম নেয়, যার পরিণতি আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটাতে পারে। -বিবিসি অবলম্বনে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।